৯ জানুয়ারী: ইমারত আলী থমকে দাঁড়িয়ে গেল তেমাথার মোড়ে। একটা লম্বা-চওড়া পিচ বোর্ডের ফলকে নোটিশের মতো লেখা: ভবন নির্মাণসম্পর্কিত তথ্যাদি। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের স্মারক নম্বর, মালিক ও নির্মাণকারী এবং কনসালট্যান্টের নাম ও ঠিকানা; স্থপতি ও প্রকৌশলীর নাম, ঠিকানা ও রেজিস্টার নম্বর। জমির অবস্থান, মৌজা, খতিয়ান ও সেক্টর। কাজ আরম্ভ করার ও কাজ সমাপ্তির সম্ভাব্য তারিখসমূহ।
নির্মিতব্য ভবনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা।পরিবেশবান্ধব এবং সুলভে টেকসই হবে স্থাপনাটি। সব বিদেশি ফিটিংস ও ফিক্সারস।ছাদে রুফগার্ডেন, ল্যান্ডস্কেপ গার্ডেন, জগিং ট্র্যাক, বারবিকিউ স্পেস।জল-লিলির পুষ্করিণীসহ রক ফাউনটেইন। দুটো এলিভেটর আর একটু দ্রুতগতির স্ট্রেচ লিফট, ইউরোপিয়ান সমস্ত সংযোগবিন্দুকে স্পর্শ করবে। চওড়া সবুজ গাছপালায় ঘেরা ব্যালকনিসমেত বারান্দা। আলো ও আড়াআড়ি বাতাস চলাচলের জন্য প্রতিটি ঘরে ফ্রেঞ্চ উইনডো। অভ্যন্তরের সর্বত্র এয়ারকন্ডিশন, সিসি টিভি। ফায়ার হাইড্রেন্টসহ ফায়ার ডিটেক্টশন সিসটেম।
ইমারত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ল। পড়া শেষ হলে উচ্চকণ্ঠে হাসল। এদিক-ওদিক কেউ দেখেছে কি না দেখে বিড়বিড় করল, শুধু হেলিপ্যাডটা নেই।
বাড়ির সব নাম দেখে ইমারতের মজা লাগে। পাকিস্তান আমলে ছিল সব ধ্রুপদি ফারসি নাম: আশিয়ান, কাকেশান, গুলফেশান, হাওয়া মহল, মকসুদ মঞ্জিল ইত্যাদি ইত্যাদি।বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাভাষায় নামের কী বাহার! দেশের যত নদ-নদী আছে তাদের নামে ব্যাংক-বিমা প্রতিষ্ঠান। বাড়ির নামে কত রকমের আদর-আদিখ্যেতা: ফেরা, সাঁঝের মায়া, আদর্শ কুটির, কুঞ্জ, বীথি ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর ফের দুটো দশক যেতে না যেতেই ইংরেজি নামের ধুম: ক্যাসাব্লাঙ্কা, গোল্ডেন টাওয়ার, ব্যাসিলিকা, গ্রিন গার্ডেন ইত্যাদি ইত্যাদি। চীনা প্রভাব বাড়লে কি তাহলে বাড়ির নাম হবে হংকং হাইটস, সাংহাই গার্ডেন, বাদালিং টাওয়ার, প্যান্ডা গার্ডেন, কুনমিন ফরেস্ট, সিচুয়ান, দংজিমেন, ইয়ুয়েলিয়াংশান, হুয়াংপু পার্ক, মান মো ইত্যাদি?
ইমারত সেই কিশোর বয়সে বাপের হাত ধরে ঢাকায় এসেছিল শহর দেখতে। স্কুলের ছেলেরা তাকে মেরামত বলে ভেংচি কাটত। ওদের ছেড়ে শহরে এসে সে স্বস্তির নিস্তার পেল। সর্দার মিস্ত্রি ওর বাবা। তাকে খোয়া ভাঙার কাজ দেওয়া হলো, যাতে সে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারে। খোয়া ভাঙার কাজ তার এত ভালো লাগল যে সে তা আজও ছাড়তে পারেনি। মানুষ বিড়ি খাওয়া বা পান-জর্দা ছাড়তে পারে না।এখন সে ছয় ছেলেমেয়ের বাবা। ঈদের ছুটিতে বাড়ি গিয়ে সপ্তাহ তিনেক কাটিয়ে আসে।ইতিমধ্যে তার স্ত্রী গর্ভবতী হলে তার আর কোনো খাঁই-খাঁকতি-আবদার থাকে না।
ইমারত আলীর নিজের দক্ষতা সম্পর্কে দারুণ আস্থা। একটা আস্ত ইট কুন্নির এক চোপ সমান দুই ভাগ করতে পারে। সে ওলন ছাড়া শুধু তাকিয়ে বলতে পারে, পাঁয়নি ঠিক হয়েছে, নাকি বাঁকাচোরা হয়ে গেছে।
ফজরের আজানের আগে তার ঘুম ভাঙে। তখন ভাতে আলু বা চালে-ভাতে খিচুড়ি চাপিয়ে সে রান্নার বন্দোবস্ত করে। দেশ থেকে ঘিয়ের বয়াম থেকে এক চামচ খাবারে ঢেলে দিয়ে ঢেকুর তুলে তার খাওয়া শেষ করে।অন্য রাজমিস্ত্রিরা আসার আগে পান চিবুতে চিবুতে সে খোয়া ভাঙা শুরু করে বাড়ি বানানোর তদারকির কাজে হাত দেয় সকাল ১০টার দিকে। আজ ইমারত চুলা জ্বালায়নি।রান্না চড়ায়নি। আজ বাজারে গিয়ে চায়ে পাউরুটি ভিজিয়ে সে তার নাশতা শেষ করবে।গত রাতে প্রফেসর সাহেব হার্টফেল করে মারা গেছেন। তাঁরই ছয়তলা বাড়ি ইমারত দেখাশোনা করছিল। এ পর্যন্ত ছাপান্ন তলা বাড়ি বানিয়েছে। কাজের নেশায় অবসর নিতে পারছে না। প্রফেসর সাহেবও কাজপাগলা ছিলেন।
প্রফেসর আহমেদ সুবহান বাংলার অধ্যাপক। বরাবর পরীক্ষায় ভালো করেছেন। তাঁর সমসাময়িক অনেক স্কলারশিপে বিদেশে গেলেও তিনি দেশে থেকে গেছেন মায়ের মায়ায়। মায়ের তিনি একমাত্র ছেলে, আদরের ধন। তাঁর জন্য মা ঢুঁড়ে ঢুঁড়ে লালটুকুকে একটা রাঙা বউ নিয়ে এলেন। লক্ষ্মী বউ শাশুড়িকে জ্বালায় না, শাশুড়ির ছেলেকে পোষ মানিয়েছে।বিদেশে না গেলেও স্কলারশিপে যাঁরা গেছেন তাঁদের চেয়ে টাকা-পয়সা জিনিসপত্র কিছু কম করেননি। দেশে থেকেও সব বিদেশের সামগ্রী কিনেছেন। সংসারে দুই ছেলে আর এক মেয়ে। মেয়েটি বিয়ে করে জামাইয়ের সঙ্গে নিউজিল্যান্ডে থাকে। দুই ছেলের একজন কানাডার টরন্টোয়, আরেকজন যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহামায়।
দুই ছেলেই বাপের লাইনে গিয়ে এখন টেনিয়রপ্রাপ্ত অধ্যাপক।
প্রফেসর সাহেবের মা মারা গেছেন। ছেলেমেয়েরা বিদেশে। যাঁর গবেষণা করার কথা ছিল, এখন তাঁর প্রধান কাজ পরীক্ষার খাতা দেখা। প্রফেসর সাহেব বলতেন, তিনি ইমারত আলীর মতো কেবল খোয়াই ভাঙছেন। কেন যে তিনি ছয়তলা বাড়ি বানাচ্ছেন তা তিনি নিজেও জানেন না। অন্যদের দেখাদেখি এই কাজ হাতে নিয়েছেন। ইমারত আলীর ওপর তার পূর্ণ ভরসা। কোনো খিচ বা ঝামেলা হয়নি।
সেদিন প্রফেসর সাহেব গুড়গুড়ি টানছেন। তাঁর স্ত্রী ঘরে ঢুকতেই মিষ্টি জর্দার গন্ধে ঘরটা ম-ম করে উঠল।ঘরের চতুর্দিকে পরীক্ষার খাতা আর খাতা। কাজে গাফিলতি নেই বলে তাঁর নিমন্ত্রণ দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে।
অধ্যাপক সাহেবকে যখন পরীক্ষার প্রথম প্রশ্ন করতে দেওয়া হলো, তখন তাঁকে বলা হলো, ‘প্রশ্ন সহজ করবেন, যাতে পরীক্ষার্থীরা সহজে উত্তর দিতে পারে। তাতে আপনিও বেশি চিন্তাভাবনা না করে পরীক্ষার খাতা সহজে দেখতে পারেন। যত বেশি খাতা দেখতে পারবেন, তত বেশি টাকা।’
প্রথমে এই কথাগুলো শুনে অধ্যাপক সাহেব একটু থমকে গিয়েছিলেন।কিন্তু এসব কথা আর তেমন গায়ে লাগে না, মনে ধরে না। লেখাপড়া, অধ্যাপনা, পরীক্ষায় পরীক্ষাপত্র নির্ধারণ, খাতা দেখা—এখন সব যেন আরও টাকা পাওয়ার একটা একটা ধাপ।
সেদিন সন্ধ্যার পরে যখন ঘরটা জর্দার গন্ধে ভরে গেছে, তখন কাজের ছেলেটা জানাল, একজন ছাত্র স্যারের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। প্রফেসর সাহেবের অনুমতি পেয়ে ছেলেটা ঘরে ঢুকল। কেমন উষ্কখুষ্ক ভাব। সে কাঁচুমাচু করে বলল, ‘স্যার, আপনার কাছে আমার খাতা আছে।’
যেন কিছুই জানেন না, এমন ভাব করে প্রফেসর সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কেমন করে জানলে?’
ছেলেটা নিরুত্তর। ওকে আর কোনো প্রশ্ন না করে তিনি বললেন, ‘সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছ?’
ছেলেটা নিরুত্তর দাঁড়িয়ে রইল।
প্রফেসর সাহেব ইতিমধ্যে ঘামতে শুরু করেছেন। তিনি ভাবলেন, ছেলেটা হয়তো একটাও উত্তর লেখেনি। তিনি দুশ্চিন্তা করলেন, ছেলেটা হয়তো ফাঁকা খাতাটায় উত্তর লিখে দিতে চাইবে কিংবা ঘরে নিয়ে গিয়ে কাউকে দিয়ে উত্তর লিখিয়ে নেবে। আজকাল এত কিছু হচ্ছে। প্রফেসর সাহেব ঘামছেন আর ঘামছেন। হঠাৎ‘সালাম, সালাম’ বলে কাজের ছেলেটিকে ডাক দিয়ে তিনি তার চেয়ার থেকে ঘরের মেঝেতে ঢলে পড়ে গেলেন। ডাক শুনে তাঁর ঘরে ঢুকতেই আবার মিষ্টি জর্দার গন্ধ পাওয়া গেল। আগন্তুক ছাত্রটা ইতিমধ্যে চলে গেছে। প্রফেসর সাহেবের আর জ্ঞান ফেরেনি। তাঁকে আর খোয়া ভাঙতে হবে না।
ইমারত আলী আজ খোয়া ভাঙা বন্ধ করেছে। সে এবার নবাবগঞ্জে ফিরে যাবে। অনেক হয়েছে।