৯ জানুয়ারি, ২০১৩।।
সরকার সমর্থক বিমান শ্রমিক লীগের (সিবিএ) আকস্মিক ধর্মঘটে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের প্রধান কার্যালয় অচল হয়ে পড়েছিল গতকাল। বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে দাবি না মানার জের ধরে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর অচল করে দিতে সকাল থেকে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়েছিল। বিমান শ্রমিক লীগ সভাপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহারসহ সাত দফা দাবিতে সোমবার সকাল থেকে বলাকা ভবনে অবস্থান ধর্মঘট শুরু হয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর আশ্বাসে দুপুরে ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়। এর আগে সিবিএর পক্ষ থেকে তড়িঘড়ি করে শাহজালাল বিমানবন্দরের মতো বিশ্বের অন্যান্য দেশে থাকা বিমান স্টেশনের কার্যক্রম বন্ধ রাখতে টেলেক্স পাঠানো হয়েছিল। আন্দোলনকারীরা আহার ভাতা ও ইউনিফর্ম, ভারত থেকে আনা বিমানের সেটআপ বাস্তবায়ন, এক শ’ ভাগ চিকিৎসা ভাতা, কর্মচারীদের ব্যক্তিগত টিপি বাস্তবায়ন এবং পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করা কর্মচারীদের স্থায়ী করার দাবির বাস্তবায়ন চান। এসব দাবি নিয়ে রোববার এমডির সাথে বৈঠকে বসেন নেতারা। কিন্তু সেখানে কোনো সুরাহা না হওয়ায় সোমবার শুরু হয় ঘেরাও এবং অবস্থান ধর্মঘট। কর্তৃপক্ষ অবশ্য জানান, সিবিএ’র ডাকা অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটের সাথে সব ইউনিয়ন ও অ্যাসোসিয়েশনের একাত্মতা নেই এবং তারা নিয়মবহির্ভূত আন্দোলনকে সমর্থন করে না। নিয়মনীতিমাফিক আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করা যেতে পারে।
এই অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট শুরুর আগে থেকেই বিমানের অবস্থা শোচনীয়। নিয়মিত বিভিন্ন রুটের ফাইট শিডিউল দুই সপ্তাহ ধরে বিপর্যস্ত থাকায় হাজার হাজার যাত্রীকে দেশে ও বিদেশের বিভিন্ন বিমানবন্দরে চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে হয়। উড়োজাহাজ বহরের অবস্থাও হয়ে পড়েছে শোচনীয়। সম্প্রতি যোগ হওয়া অত্যাধুনিক বোয়িং ৭৭৭ যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে এক সপ্তাহ ধরে উড়তে না পেরে পড়ে আছে। আরো তিনটি উড়োজাহাজে ধরা পড়েছে যান্ত্রিক ত্রুটি। ফলে মালয়েশিয়া, দুবাই, মাস্কাট, কাঠমান্ডু, লন্ডনসহ বিভিন্ন রুটের শিডিউলে মারাত্মক বিপর্যয় দেখা দেয়। বিমানের শীর্ষপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তার বেপরোয়া দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে বিমানবহরে থাকা এয়ারক্র্যাফটের অবস্থা ক্রমেই বেহাল হয়ে পড়ছে। যান্ত্রিক ত্রুটি অথবা অন্য সমস্যা ধরা পড়লেও সেটি সহজে সারানো হয় না। উপরন্তু যন্ত্রাংশ আনার নামে কর্মকর্তারা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। বিমানের বহরে যে দু’টি বোয়িং-৭৭৭, দু’টি লিজ বোয়িং-৭৩৭, দু’টি এয়ারবাস এবং দু’টি ডিসি-১০ রয়েছে, তার মধ্যে তিনটিতে টেকনিক্যাল সমস্যা দেখা দিলে পুরো ফাইট শিডিউল লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। এই চিত্র যেন বিমানে অনেকটাই নিত্যরূপ নিয়েছে।
জাতীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইন্স বিমানের ব্যাপক সম্ভ^াবনা থাকা সত্ত্বেও কোনো সরকারের আমলেই এর বিপর্যয় এড়ানো যায়নি। শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তাদের একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তের কারণে হাজার হাজার যাত্রীকে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এতে বিমানের ইমেজ ুণœ হচ্ছে। অনেকেই একবার দুর্ভোগের মুখে পড়ে আর বিমানমুখী হতে চান না। নানা আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের কারণে লোকসান দিতে দিতে বিমান যেন আত্মবিলুপ্তির পথেই এগিয়ে যাচ্ছে।
আমরা মনে করি, এর পরও বিমানের সব সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়নি। বিমানকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে স্বাধীনভাবে চলতে দিলে এটি অন্য অনেক এয়ারলাইন্সের মতো লাভজনকভাবে পরিচালিত হতে পারবে। তবে প্রত্যেক সরকার জাতীয় এই প্রতিষ্ঠানকে যেভাবে সঙ্কীর্ণ স্বার্থে ব্যবহার করতে চেয়েছে এবং বারবার সরকার-সমর্থক একটি স্বার্থচক্রের হাতে যেভাবে এটি বন্দী হয়ে পড়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কর্মচারীদের ন্যায্য কোনো দাবি থাকলে সেটি অবশ্যই বিবেচনাযোগ্য। একই সাথে সংস্থাটিকে বাঁচাতে এটিকে রাজনৈতিক সঙ্কীর্ণতা, দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতা থেকে মুক্ত করে ব্যবসায়িক বিবেচনাকে প্রাধান্য দিয়ে চালাতে হবে। নতুন উড়োজাহাজ কেনা বা লিজ নেয়ার ক্ষেত্রেও একই বিবেচনায় কাজ করতে হবে। বিমানের চেয়ারম্যান, এমডি অথবা সিবিএÑ কারো অন্যায্য স্বার্থ বা হঠকারিতার কাছে জাতীয় পতাকাবাহী গৌরবময় একটি প্রতিষ্ঠানকে বন্দী হতে দেয়া কোনোভাবেই সমীচীন হবে না।