ফিরে দেখা অর্থনীতি-২০১২ হলমার্ক-ডেসটিনি আর নতুন ব্যাংক!

0
141
Print Friendly, PDF & Email

ঢাকা (০৯জানুয়ারী) : ঢাকা: বিদায়ী বছর ২০১২ ব্যাংকিংখাত তথা সামগ্রিক অর্থনৈতিক খাত কেটেছে নানা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে।

হলমার্ক কেলেঙ্কারি, ডেসটিনির প্রতারণা, ব্যাংকের পরিচালকের পদ শূন্য হওয়া, নতুন ব্যাংকের অনুমোদন, ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট, বাংলাদেশ ব্যাংক-অর্থ মন্ত্রণালয় টানাপোড়েন, ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর, ব্যাংকিংখাতে মূলধন ঘাটতি, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি ছিল বছর জুড়ে সামগ্রিক অর্থনীতির আলোচনার কেন্দ্র।

এর ফলে, অর্থনীতি মোকাবেলা করে ঝুঁকি। তবে এত সব ঝুঁকির মধ্যে প্রবাসী আয় বৃদ্ধি, বছরের শেষদিকে মূল্যস্ফীতির নিম্নমুখি প্রবণতা, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিসহ অর্থনীতির সূচকের বেশ কিছু ইতিবাচক প্রবৃদ্ধিও ছিল।

হলমার্ক কেলেঙ্কারি:

ব্যাংকিং খাতে আলোচিত বিষয় ছিল সোনালী ব্যাংকের একটি শাখা থেকে হলমার্ক গ্রুপের জালিয়াতির মাধ্যমে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা তুলে নেওয়ার ঘটনা।

সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা হোটেল শাখায় ভুয়া ঋণপত্র বিলের মাধ্যমে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় হলমার্ক।

এ ঘটনার সঙ্গে ব্যাংক কর্মকর্তা ছাড়াও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের লোকজন জড়িত থাকার বিষয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ডা. মোদাচ্ছের আলীর নামও উঠে আসে অভিযোগের তালিকায়। দুদক তাকে এ নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করে।

আলোচিত এ ঘটনায় বাদ যাননি সোনালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ূন কবির। এ ঘটনার পর নানা সমস্যার মুখে পড়ে দেশের ব্যাংকিংখাত। ঋণপত্র খুলতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অতি সতর্কতার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে আছে।

শুধু এ ঘটনাই নয়, হলমার্কসহ ব্যাংকিং খাতে দুই বছরের ১০ হাজার কোটি টাকার জালিয়াতি বেরিয়ে আসে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব ঘটনায় শক্তিশালী অবস্থান নেয়। বিশেষ করে হলমার্কের ঘটনা বেরিয়ে আসার পর সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদ পুনর্গঠনের সুপারিশ করে আগস্ট মাসে অর্থমন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

এ ঘটনা নিয়ে অর্থমন্ত্রণালয়-বাংলাদেশ ব্যাংকের টানাপোড়েন ছিল আলোচনায়। তবে শেষ পর্যন্ত মামলা করে দুদক। আটক হন হলমার্কের এমডি তানভীর মাহমুদসহ সংশ্লিষ্টরা। তবে অভিযোগের তীর থাকা পরিচালকরা রেহাই পেয়ে যান। তাদের দুদক কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদ করলেও মামলায় তাদের অভিযুক্ত করা হয়নি।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অনিয়ম ও পরিচালক:

হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর একে একে জনতা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক এবং বিশেষায়িত আরও কয়েকটি ব্যাংকের অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে আসতে থাকে।

অন্যদিকে, এসব ঘটনার মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, অগ্রণী ও জনতা ব্যাংকের ২৯ পরিচালকের পদ শূন্য হয়। তিন মাস পরিচালক শূন্য থাকার পর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে আবারও সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালক নিয়োগ করে।

বিশেষায়িত ব্যাংকেরও শূন্য পরিচালক পদেও পরিচালক নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপণ জারি করে অর্থমন্ত্রণালয়।

প্রসঙ্গ ডেসিটিনি:

মাল্টি লেবেল কোম্পানি ডেসটিনির অর্থ পাচার সংক্রান্ত প্রতিবেদন তৈরি করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্ট ইউনিট। পরে এ ঘটনায় মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

আটক করা হয় ডেসটিরি শীর্ষ কর্তাদের। অন্যদিকে, সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামেন ডেসটিনির কর্মীরা। তবে তারা বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেননি। ডেসটিনিতে প্রশাসক নিয়োগ নিয়োগ দেওয়ার সিদান্ত নেয় সরকার।

তবে বিদায়ী বছরে এর কোনো সুরাহা করতে পারেনি সরকার। ঝুলে রয়েছে ডেসটিরি বিষয়টি। আড়ালে ঢেকে গেল শেষ পর্যন্ত।

নতুন ব্যাংক:
বিদায়ী বছরে আলোচিত ছিল ৯ ব্যাংকের অনুমোদন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দিন খান আলমগীর, সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসসহ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ব্যাংকের আবেদন করেন।

এপ্রিলে দেশীয় মালিকানায় ৬টি আর প্রবাসী বাংলাদেশিদের মালিকানায় ৩টি মোট ৯টি ব্যাংকের অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ বিশ্বব্যাংক এর বিপক্ষে ছিল।

কিন্তু অর্থমন্ত্রী একাধিকার বলেন, “নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়ার সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক। গত সেপ্টেম্বর মাসে ৯ ব্যাংককে লেটার অব ইনটেন (এলওআই) দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে ৭ ব্যাংকের নথিপত্র জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) যাচাই-বাছাই শুরু করে।

তবে নতুন এই ব্যাংকগুলো মূলধনের টাকা জোগাড় করতে উদ্যোক্তা পরিচালক খুঁজতে থাকে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকা অবস্থায় মহীউদ্দিন খান আলমগীরের ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে।

ব্যাংকিং খাত:

বিদায়ী বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে বেশির ভাগ বাণিজ্যিক ব্যাংক মুনাফা করতে পারেনি। ব্যাংকিংখাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যায় ৭ হাজার কোটি টাকা। মূলধন ঘাটতি দেখা দেয় ৭ বাণিজ্যিক ব্যাংকের।

হলমার্কের কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বাড়ে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। আর তারল্য সংকট ছিল দৃশ্যমান।

বেড়ে যায় ব্যাংকের সুদের হার। ব্যবসায়ীদর শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি একে আজাদ (সাবেক) বছর জুড়ে বলতে থাকেন তারল্য সংকটে তারা ঋণ পাচ্ছেন না। তারল্য সংকট মেটাতে ব্যাংকগুলো আন্তঃব্যাংকিং কলমানি বাজারের দারস্থ হয়।

প্রতিদিন কলমানি বাজারে গড়ে লেনদেন হয় ৬ হাজার কোটি টাকা। দীর্ঘ দিন ধরে কলমানি সুদের হার ১২ শতাংশের নিচে থাকলেও ডিসেম্বর মাসে কলমানি সুদের হার ১৪ শতাংশে উঠে যায়।

২৩টি প্রাইমারি ডিলার ব্যাংক বিশেষ রেপোর মাধ্যমেও তারল্য সহায়তা নিতে থাকে। গড়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এসব ব্যাংককে সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা তারল্য সহায়তা প্রদান করে।

অন্যদিকে, মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরতে বাজার থেকে অতিরিক্ত তারল্য উত্তোলনের জন্য ৩০ দিন মেয়াদী ‘বাংলাদেশ ব্যাংক বিল’ প্রবর্তন করে। এর মাধ্যমে ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা তুলে নেয়।

ডলার পরিস্থিতি:

ডলারের দাম স্থিতিশীল রাখা, প্রবাসীদের বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহ প্রদান, রফতানিকারকদের প্রণোদনা দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পর্যাপ্ত পরিমাণ ডলার কিনে নেয়।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে মজুদ হতে থাকে ডলার। এ কারণে এক বছরের ব্যবধানে ডলারের দাম ৪ টাকা কমে যায়। খেলাপি ঋণ আদায় কম হওয়া, প্রাইমারি ব্যাংকগুলোর সরকারি বন্ডে অতিরিক্ত ২১ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের কারণে বেসরকারিখাতে ঋণ প্রবাহ কমে যায়।

তবে সরকারের ঋণের স্থিতি ডিসেম্বর মাসে ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।

বিদায়ী বছরে জুন মাসে খেলাপি ঋণ ও প্রভিশনিংয়ের নতুন নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে খেলাপি ঋণ পুনতফসিলের সময় কমিয়ে আনার কারণে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। নতুন নীতিমালায় ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ৪ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। পরে আগস্ট মাস পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক এই নীতিমালার ৪ দফা ব্যাখ্যা দেয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থমন্ত্রীর টানাপোড়েন:

হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ২৭ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে।

চিঠিতে তিনি পর্ষদকে দায়ী করেন। একই সঙ্গে আরেকটি চিঠি দিয়ে সোনালী ব্যাংকের এমডিকে দায়ী ৩১ কর্মকর্তাকে বহিষ্কার করতে বলেন।

তবে অর্থমন্ত্রী ২৯ আগস্ট এক অনুষ্ঠানে বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক এটি করতে পারে না।” বিষয়টি নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে।

তবে হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনা সঠিক সময়ে কেন বাংলাদেশ ব্যাংক শনাক্ত করতে পারেনি তার জন্য তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি ব্যর্থতার কথা বলেন।

অপরদিকে, বিশিষ্ট জনেরা হলমার্ক কেলেঙ্কারি বের হওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্ত্বশাসনের কথা তোলেন। তারা প্রয়োজনে ব্যাংক কোম্পানি আইনের আবারও সংশোধনের অভিমত দেন।

নিউজরুম

শেয়ার করুন