ঢাকা (০৮ জানুয়ারী) : মেয়াদের প্রথম চার বছরে স্বাস্থ্যখাতে দেওয়া কথা রাখতে পারেনি আওয়ামী লীগ সরকার। নির্বাচনের পূর্বে ঝুড়িভর্তি প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন নগন্য। জনগনের স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন না হলেও পদোন্নতি আর সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে সরকারদলীয় চিকিৎসকদের অবস্থার উন্নতি ঠিকই হয়েছে। প্রতি অর্থবছরেই ধারাবাহিকভাবে স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দও কমেছে। সরকারদলীয় চিকিৎসক সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) চিকিৎসক নিয়োগে বাণিজ্য, মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে ভুল সিদ্ধান্ত ও পরে বিরুপ প্রতিক্রিয়ার মুখে তা প্রত্যাহার, জয়পুরহাটের হতদরিদ্র মানুষের কিডনি বিক্রি, কমিউনিটি ক্লিনিকে স্বাস্থ্যকর্মীদের অপরিকল্পিত নিয়োগ, বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ) নির্বাচনে স্বাচিপের কারচুপির জয়লাভ, ওষুধ নীতি ও জনসংখ্যা নীতি প্রণয়ন করতে না পারা, বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর লাগামহীন ভর্তি ফি, গ্রামে সরকারি চিকিৎসকদের অনুপস্থিতি, এ সবকিছুই স্বাস্থ্য খাতে সরকারের সফলতার চেয়ে ব্যর্থতার পাল্লাকেই ভারী করেছে।
জাতীয় বাজেটের আকৃতি বড় হলেও ২০১২-১৩ অর্থবছরে আগের মতোই স্বাস্থ্য খাত অবহেলিত। বাজেটে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা খাতে ৯ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, যা প্রস্তাবিত মোট বাজেটের ৪.৮৭ শতাংশ। এ বাজেট ২০১১-১২ অর্থবছরের চেয়ে দশমিক ২৩ শতাংশ কম।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ প্রতি অর্থবছরেই কমছে। গত ২০০৫-০৬ বছরে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ। ২০১১-১২ সালের প্রস্তাবিত বাজেটে আরও কমে এ বরাদ্দ দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ১ শতাংশে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছিল, সকলের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পূর্বতন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রণীত জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি পুনর্মূল্যায়ন করে যুগের চাহিদা অনুযায়ী নবায়ন করা হবে। অবশেষে গত মার্চে এ প্রস্তাবটি মন্ত্রিসভায় উত্থাপন এবং সংসদে প্রস্তাবিত স্বাস্থ্যনীতি অবহিত করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আ ফ ম রুহুল হক।
নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামীলীগ সরকারের ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে নেয়া পদক্ষেপের সূত্র ধরে ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক চালুর প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু এ পর্যন্ত সরকারি হিসেবে ১১ হাজার ২৬২টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়েছে। জমি সংক্রান্ত জটিলতার কারনে বাকি কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো নির্মাণ সম্ভব হচ্ছে না বলে সরকারের তরফে দাবি করা হয়েছে।
২০১১ সালের অক্টোবর মাসে ১৩ হাজার কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেয় সরকার। অবশ্য নিয়োগ পরিকল্পনায় ত্রুটির কারণে বহু কমিউনিটি ক্লিনিকে চাকরিপ্রাপ্তরা এখন অন্য চাকুরিতে যোগ দেয়ায় পদগুলো শূণ্য হয়ে পড়েছে।
স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগে দলীয় প্রাধান্য স্বাস্থ্যখাতের ভাবমূর্তি নষ্ট করে। কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগের ব্যাপারে ২০১০ সালেই গোপালগঞ্জে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীর একটি বক্তৃতা সারাদেশে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় তোলে। সে সময় তিনি বলেছিলেন, ‘আগামীতে কমিউনিটি ক্লিনিকে ১৩ হাজার ৩’শ ৫০ জন কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হবে। দলের পরীক্ষিত কর্মী ছাড়া বাইরের কাউকে এ চাকরি দেওয়া হবে না। এরই মধ্যে এ ব্যাপারে সিস্টেম করা হয়েছে। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে কাউকে চাকরি দেওয়া হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
শুধু কমিউনিটি ক্লিনিক নয়, চার বছরের স্বাস্থ্য সেক্টরের বিভিন্ন নিয়োগ এবং পদোন্নতিতে সরকার দলীয় চিকিৎসক সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) দাপটে মূল্যায়িত হননি অনেক জ্যেষ্ঠ এবং মেধাবী চিকিৎসক।স্বাস্থ্যখাতের নিয়োগ নিয়ে স্বাচিপের জোর জবরদস্তি ছিল সরকারের সমালোচনার অন্যতম জায়গা।
আওয়ামী সরকারের বিভিন্ন সময়ে ডিপার্টমেন্টাল প্রমোশন কমিটির (ডিপিসি) মাধ্যমে সহকারী ও সহযোগী অধ্যাপক পদের শিক্ষক চিকিৎসকদের পদোন্নতির ফলাফলে দেখা যায় সরকারদলীয় চিকিৎসক সংগঠন স্বাচিপের নেতা-কর্মীদের দাপট।
পদোন্নতি প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও অস্বচ্ছতার অভিযোগ আনেন বাংলাদেশ বিসিএস ক্যাডার চিকিৎসক অ্যাসোসিয়েশন নেতারা। ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী চিকিৎসক নেতারাও পদোন্নতি পেয়েছেন বলে অভিযোগ করেন তারা। আবার সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকদের ডিঙিয়ে নবীন চিকিৎসকদের পদোন্নতি হয়েছে।
শুধু নিয়োগ বা পদোন্নতি নয়, স্বাস্থ্যখাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ) নির্বাচনে কারচুপির আশ্রয় নিয়ে স্বাচিপের প্রার্থী মাহমুদুল হাসান সভাপতি ও ইকবাল আর্সনাল মহসচিব নির্বাচিত হন। চিকিৎসকদের নির্বাচনে এ ধরনের কারচুপি হতাশ করে দেশের সর্বস্তরের নাগরিককে।
নির্বাচনী ইশতেহারে পুষ্টি, শিশু ও মাতৃমঙ্গল নিশ্চিত করার যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, সে ক্ষেত্রেও খুব বেশি সফলতা আসেনি বর্তমান সরকারের আমলে।
সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও গত দু’দশকে পুষ্টির অভাবে শিশু মুত্যু হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। তবে দেশে প্রসবকালীন মা ও শিশু মৃত্যুর হার এখনও উদ্বেগজনক। দেশে বর্তমানে মাত্র ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ গর্ভবতী মা প্রসবের সময় চিকিৎসক, সেবিকা অথবা প্রশিক্ষিত ধাত্রীর সহযোগিতা পেয়ে থাকেন।
অবশ্য চার বছরে স্বাস্থ্যখাতে সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্যের মধ্যে রয়েছে মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাসে চূড়ান্ত করে গেজেট প্রকাশ। এর ফলে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ২০১১ সালের শুরুতেই, ১১ জানুয়ারি এ সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করা হয়। এর ফলে সরকারি চাকরিতে কর্মরত নারীরা মাতৃত্বকালীন ছুটি ৬ মাস ভোগ করছেন। আগে তারা ছুটি পেতেন চার মাস।
নির্বাচনী ইশতেহারে জনসংখ্যা নীতি যুগোপযোগী করা, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার কথা থাকলেও জনসংখ্যা নীতির খসড়া মন্ত্রীসভায় অনুমোদন করাতেই সময় পেরিয়ে গেছে ৪ বছর। সবশেষ গত ৮ নভেম্বর স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছিলেন জনসংখ্যা নীতি আগামী সংসদ অধিবেশনেই পাস করা হবে।
আর্সেনিক সমস্যা সমাধান করে ২০১১ সালের মধ্যে সবার জন্য নিরাপদ সুপেয় পানি এবং ২০১৩ সালের মধ্যে প্রতি বাড়িতে স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করা হবে বলে ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো আওয়ামীলীগ। এছাড়া ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক ঘোষনা দিয়েছিলেন ২০১৩ সালের মধ্যে সকলের জন্যে স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে। ২০১১ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে স্যানিটেশন স্থাপনের জন্য বেসরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
এছাড়া নির্বাচনী ইশতেহারে আরও প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, মানসম্পন্ন ওষুধ উৎপাদনে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন ও রফতানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে ওষুধনীতি আরও যুগোপযোগী করার বিষয়ে। পাশাপাশি হোমিওপ্যাথি, ইউনানি ও আয়ূর্বেদসহ দেশজ চিকিৎসা শিক্ষা এবং ভেষজ ওষুধের মানোন্নয়নে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার অঙ্গীকারও করা হয়েছিলো।
অথচ চার বছর চলে গেলেও ১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধনীতির এখনো সংস্কারের কোনো নাম গন্ধ নেই। ওষুধের বাজার নিয়ন্ত্রণ, ভেজাল ও নকল ওষুধ উৎপাদনকারীদের শাস্তি, ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করায় যথাযথ অবদান রাখতে পারছে না এই নীতি। এছাড়াও হোমিওপ্যাথ চিকিৎসার উন্নয়নেও তেমন কোন পদক্ষেপ নেয়নি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
ফলে দেশের ২৫৮টি ওষুধ কোম্পানির মধ্যে মাত্র ৪০টির ওষুধ মানসম্মত হলেও বাকি অধিকাংশ ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ করা হয় না। এ সুযোগে জীবন রক্ষাকারী বিভিন্ন ওষুধের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দফায় দফায় মূল্য বৃদ্ধি করা হচ্ছে নিয়মিত বিরতিতেই।
বিভিন্ন কোম্পানি মেয়াদোত্তীর্ণ ও নিম্নমানের ওষুধ বাজারে ছাড়ছে। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি দীর্ঘ যাচাই-বাছাইয়ের পর ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের কাছে ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ প্রস্তুতকারী ৬২টি কোম্পানির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করলেও অজ্ঞাত কারণে অধিদফতর এখন পর্যন্ত কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
২০১১ সালের জুলাই মাসে ওইসব কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে স্থায়ী কমিটি। কোন পদক্ষেপ না নেওয়াতে আবারও ২০১২ সালের এপ্রিলে ৩ মাসের মধ্যে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করে কমিটি। কিন্তু দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করে, বরং আরো ৯টি নতুন ওষুধ কোম্পানিকে অনুমোদন দেয় অধিদপ্তর।
মন্ত্রণালয়ের এ ধরনের যথেচ্ছাচারিতায় রীতিমত হতবাক সংসদীয় কমিটি। ২০১২ সালের ১১ অক্টোবর কমিটির ২৯তম সভায় সভাপতি শেখ ফজলুল করিম সেলিম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন,“স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যা ইচ্ছা তাই করছে। কোনো নিয়ম-নীতি মানছে না।”
চিকিৎসকের অভাব, কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার অভিযোগে বিভিন্ন সময় সংসদে দলীয় এমপিদের সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আ ফ ম রুহুল হককে।
এর মধ্যে ২০১২ সালের ৩ জুলাই সংসদে ভুল চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত চিকিৎসকদের পক্ষে মন্তব্য করতে গিয়ে এমপিদের তীব্র ক্ষোভের মুখে পড়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আ ফ ম রুহুল হক। ৭ ফেব্রুয়ারি নিজেদের নির্বাচনী এলাকার হাসপাতালের বেহাল দশা বর্ণনা করে কয়েকজন এমপি বলেন, “এসব নিয়ে প্রশ্ন করে মন্ত্রীকে লজ্জা দিতে চাই না। কারণ এখন লজ্জাতে প্রিজারভেটিভ দেওয়া থাকে।”
সর্বশেষ ২২ নভেম্বরও একই অভিযোগে সংসদ সদস্যদের তোপের মুখে পড়ে, স্বাস্থ্যখাতের বেহাল দশা করে করণীয় সম্পর্কে সকলের পরামর্শ চান রুহুল হক।
নির্বাচনী ইশতেহারে জনগনের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার কথা থাকলেও সারাদেশে এখনো পাঁচ হাজার ৭৩১ জন চিকিৎসক ও তিন হাজারের বেশি নার্সের পদ শূন্য রয়েছে বলে এইদিন সংসদে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। একই সঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, চিকিৎসক, সেবিকা, স্বাস্থ্যকর্মীসহ স্বাস্থ্যখাতে ৫৯ হাজার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, ২০১২ সালে চিকিৎসকরাও ভুগেছেন নিরাপত্তাহীনতায়। আগস্ট মাসে ডাকাতদের হাতে নিহত হন বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) নির্বাহী সদস্য ও রাজধানীর জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. নারায়ণ চন্দ্র দত্ত।
২০১২ সালের প্রথম দিকেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। ১৭ জানুয়ারি এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা মেডিকেল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করার ঘোষণা দেন। প্রধানমন্ত্রীর এমন ঘোষণার পর তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে আন্দোলন শুরু করে। কর্মচারীরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেন। পরে ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে পহেলা মার্চ পর্যন্ত দুই ঘণ্টা করে কর্মবিরতি পালন করে আন্দোলনকারীরা। আন্দোলনের মুখে বিষয়টি নিয়ে আর নাক গলাচ্ছে না মন্ত্রণালয়।
দেশে ভাইরাস জনিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে গত কয়েক বছরে। ২০১০ সালের আগস্ট থেকে অক্টোবর এবং ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে অ্যানথ্রাক্স ও নিপাহ ভাইরাসের প্রার্দুভাব দেখা যায়। এছাড়াও ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকার বাজারে বার্ড ফ্লুতে আক্রান্ত হয় এক ব্যক্তি।
নিপাহ ভাইরাসে ২০১২ সালেও ৬ জন মারা যান। যা জনমনে ভীতির সঞ্চার করে। কিন্তু এসব রোগের মৌসুমের পূর্বে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের কোন ধরনের জনসচেতনতামূলক প্রচারণা দেখা যায়নি।
২০১২ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে সবচেয়ে বেশি জবাবদিহিতা করতে হয়েছে পরীক্ষার মাত্র দু মাস আগে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়ে। বছরের ১২ আগস্ট ‘এবার থেকে কোনো ভর্তি পরীক্ষা নয়, এসএসসি ও এইচএসসির জিপিএ’র ভিত্তিতে মেডিকেল ও ডেন্টালে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে বলে ঘোষণা দেন মন্ত্রী। ঘোষণার পরপর তার বিরুদ্ধে সারা দেশে আন্দোলন শুরু করে মেডিকেল ভর্তিচ্ছুরা।
আন্দোলনের মুখে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সরকার। এ নিয়ে আদালতে রিটও হয়। গত ১০ সেপ্টেম্বর আদালতের এক আদেশে পরীক্ষার মাধ্যমে মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তির নির্দেশনার পর ২৩ নভেম্বর পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
অপরিকল্পিতভাবে এ ধরনের হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং সিদ্ধান্তের পক্ষে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সাফাই গাওয়ার প্রচেষ্টা সরকারকে ব্যাপক সমালোচনার মুখে ফেলে।
তবে ২০১১ সাল থেকে নতুন কয়েকটি সরকারি মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তি শুরু হয়েছে এবং কয়েকটিতে আসনও বৃদ্ধি করা হয়েছে।
বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজগুলোর ভর্তি ফি ও টিউশন ফি নিয়ন্ত্রণ ও মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করার কথা থাকলেও এর খুব অল্পই বাস্তবায়ন করতে পেরেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। অথচ নতুন করে রাজধানীতে আরো ৭টি এবং ঢাকার বাইরে আরো ৪টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপনে নীতিগত অনুমোদন প্রদান করেছে মন্ত্রণালয়।
ঢাকা শহরে ৭টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপনের অনুমোদন দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।
এদিকে ২০১২ সালের ২৫ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজে ইন্টার্নি চিকিৎসক-কর্মচারীদের হামলায় ১৫ জন সংবাদকর্মী আহত হওয়ার ঘটনায় দেশবাসী নিন্দা জানায় চিকিৎসকদের।
এ সময় সাংবাদিকদের একটি গাড়ি, মোটরসাইকেল এবং ক্যামেরা ভাংচুর করে তারা।
আওয়ামী সরকারের ৪ বছরে স্বাস্থ্যখাতে সবচেয়ে ট্রাজিক ঘটনার মধ্যে রয়েছে ২০১১ সালের আগস্টে জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার ১৮টি গ্রামে হতদরিদ্র মানুষের কিডনি বিক্রির ঘটনা উন্মোচন। এ ঘটনার ফলাফলে দেশে এখনো কিডনি প্রতিস্থাপন স্বাভাবিক হয়নি।
এছাড়াও ২০১১ সালের জুন মাসে বেসরকারি ডাক্তারদের চিকিৎসা ফি ও প্যাথলজি পরীক্ষার চার্জের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নের কাজ শুরু হলেও সেটি এখনো অন্ধকারে।
২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক ঘোষণায় স্বাস্থ্যখাতে অনুদানের জন্যে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার কথা বলেন। এছাড়া স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে যদি কেউ অনুদান দেন, তাহলে তিনি কর ছাড়ের সুবিধা পাবেন বলে ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী।
স্বাস্থ্যখাতের চলমান যেসব সমস্যা রয়েছে সেগুলোর উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি গত চার বছরে। দেশে আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল তৈরিসহ স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বরাদ্দ বাড়লেও দরিদ্ররা বরাবরই স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছেন।
এছাড়া গত চার বছরে স্বাস্থ্যখাতে সরকারের পরিকল্পিত নীতি ও বরাদ্দের অভাব, চিকিৎসক স্বল্পতা, স্বাস্থ্য সচেতনতা ও কার্যক্রমের অভাব চোখে পড়েছে । দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে জনবল সঙ্কট, অপর্যাপ্ত বাজেট, অপ্রতুল সেবা, দরিদ্রবান্ধব সেবার অপ্রতুলতা, উপকরণ, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির অভাব, অবকাঠামো সঙ্কট, দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও স্বাস্থ্য খাতে বড় মাপের দুর্নীতিকেই দায়ী করেছেন।
স্বাস্থ্যখাতে সরকারের সফলতার মধ্যে রয়েছে, দেশের ৬টি সিটি করপোরেশন এবং ৫টি পৌরসভায় ২৭টি নগর মাতৃসদন, ১৬৭টি নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও ৬৫৬টি স্যাটেলাইট ক্লিনিকের মাধ্যমে দরিদ্র নগরবাসীকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান। এছাড়া এ সময়ের মধ্যে ১১ হাজার ৪০৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করা হয়েছে। জন্ম নিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহারের হার ২০০৭ সাল থেকে ২০১১ সালের মধ্যে ৫৬ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে।
পর্যায়ক্রমে সব উপজেলা হাসপাতালকে ৫০ শয্যায় এবং সব জেলা হাসপাতালকে ২৫০ শয্যায় উন্নীতকরণের কাজ শুরু হয়েছে। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের ৪৮২টি হাসপাতালে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। ৮শ’টি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া হয়েছে।
নিউজরুম