ঢাকা (০৭জানুয়ারী) : হঠাৎপরিচিত এক বড় ভাই সে দিন ফোন দিলেন। ফোন করে তিনি একজন পরিচালকের নাম বললেন। আর বললেন, “আমার ছোট বোন অভিনয় করতে চায়। ফেসবুকে তার একজন পরিচালকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। এ পরিচালক কেমন? তুমি কি তার সম্পর্কে আমাকে জানাতে পারবা?”
আমি তাকে জানালাম এ নামে কোনো নির্মাতাকে চিনি না। তারপরেও খবর নেবো। কয়েকজন পরিচালকের কাছে ঐ পরিচালকের নাম বললাম, কেউ চিনলেন না। এরকম অনেক নির্মাতাকেই আজকাল ফেসবুকে দেখা যায়। তাদের ফেসবুক আইডিতে গিয়ে দেখা যায় কেউ হয়তো অমুক অডিও ভিজুয়্যালের প্রধান নির্বাহী (সিইও), কেউ তমুক প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের এমডি ইত্যাদি।
এসব নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নির্মাতা ও প্রযোজকরা নানা ধরনের ক্রাইম করে যাচ্ছেন নিরবে। আর তাদের জালে আটকা পড়ছেন অনেক সহজ সরল ও স্বপ্নবাজ নারী। যে নারী স্বপ্ন দেখে একদিন মিডিয়ার বড় নায়িকা হবেন বা মডেল হবেন। আর তাদের এই স্বপ্নকে পুঁজি করে একদল অসাধু ব্যক্তি নির্মাতা বা প্রযোজক সেজে নিজেদের ফাঁদে ফেলতে চায় নারীদের।
তেমনি কয়েকজন নারীর সঙ্গে এরই মধ্যে কথা হয়। তাদের একজন সুমি [ছদ্ম নাম] তিনি বলেন, “একজন পরিচালকের সঙ্গে ফেসবুকে কথা হয় আমার। তারপর তিনি আমাকে তার নতুন একটি নাটকে অভিনয়ের কথা বলেন। আমি রাজি হই। কিন্তু যখন আমি শুটিং স্পটে গেলাম। দেখলাম কেউ নেই। পরিচালক আমাকে তার রুমে বসতে বলেন। এরপর আমি অবস্থা খারাপ দেখে কৌশলে সেখান থেকে চলে আসি।”
এ মেয়েটি হয়তো কৌশল করে চলে আসতে পেরেছেন। কিন্তু অধিকাংশ মেয়ে তা পারেন না। তারা যৌন হয়রানির স্বীকার হন। বলা যায়, এক রকম ধর্ষণের স্বীকার হন তারা। কিন্তু সমাজ আর পরিবারের কথা ভেবে কোনো কিছু প্রকাশ করে না। থানায় মামলাও হয় না। আর এতে করে এ ধরনের ভুয়া নামধারী নির্মাতারা আরো সুযোগ পেয়ে যায়। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো মেয়ে মিডিয়ায় কাজ করতে এসে যৌন হয়রানির স্বীকার হচ্ছে।
এতো গেল একটা দিক। অনেক প্রতিষ্ঠাতা নির্মাতা আছেন, ফেসবুকে যাদের অসংখ্যা ফেইক (ভুয়া) আইডি আছে। কোনটা আসল ব্যক্তির আইডি আর কোনটা নকল ব্যক্তির, এ পার্থক্যটা না বুঝতে পেরে অনেই ফাঁদে পা দেন। কিন্তু যখন নির্মাতার মুখোমুখি হন তখন আর কিছুই করার থাকে না। এভাবে অভিনয়ে কথা বলে টাকা পয়সা হাতিয়ে নেওয়ারও খবর পাওয়া যায় প্রায়ই।
নির্মাতা অরণ্য আনোয়ার ফোন দিলেন একদিন। ফোন করে তিনি বললেন ‘শোন অরণ্য আনোয়ার তো গ্রেফতার।’ আমি একটু অবাক হলাম। ফোন নাম্বারটা আবার দেখে নিলাম। না ঠিকই তো আছে। তাকে বললাম ঘটনা কি বলেন তো ? তিনি বলেন, “এক ব্যক্তি অরণ্য আনোয়র নামে এতদিন মেয়েদের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিল। বিভিন্ন জনের কাছ থেকে আমার নাম করে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সে নিজেকে নির্মাতা অরণ্য আনোয়ার দাবি করে। আমি থানায় মামলা করেছিলাম। এবার সে ধরা পড়েছে।”
এ ঘটনা শুধু অরণ্য আনোয়ারের সঙ্গেই ঘটে নাই। আরো অনেকেরই সঙ্গে ঘটেছে। নির্মাতা মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজও এ ঘটনার স্বীকার হয়েছেন। প্রায় বিভিন্ন অভিনেত্রী ও তরুণীদের ফোন করে একটি লোক বলতেন, “আমি নির্মাতা রাজ। আপনাকে আমার নাটকে কাজ দেবো, বলে কুপ্রস্তাব দিতো।”
আর এর সবই ফেসবুকের মাধ্যমে ছড়িয়েছে। অভিনেত্রী পূর্ণিমা, মৌসুমী, পপি, মোনালিসা, তিশা, প্রভা, ভাবনা, জ্যোতিকা জ্যোতি, শখ, মীম, সারিকাসহ অনেকেরই ভুয়া ফেসবুক আইডি রয়েছে। আর এসব ফেসবুক আইডি নিয়ে রীতিমত যন্ত্রণায় আছেন এ অভিনেত্রীরা। এক একজনের নামে কয়েকটি করে ভুয়া আইডি রয়েছে। তারা নিজেরাও জানেন না এগুলো কে বা কারা করেছে। এইসব আইডি দিয়ে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে প্রতারণা করছে আর একটি প্রতারক চক্র।
নতুন যারা অভিনয় করতে আগ্রহী বা মিডিয়ার কাজ করতে চান তাদের ফেসবুক নির্ভর ভুয়া নির্মাতা, প্রযোজক এবং অভিনয় শিল্পীদের কাছ থেকে দূরে থাকতেই পরামর্শ দিয়েছেন অভিজ্ঞজনেরা।
এ বিষয়ে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা হয় অভিনেতা ও নির্মাতা আবুল হায়াতের সঙ্গে তিনি বলেন, “এসব খবর আমি শুনি। আজকাল কত কি হচ্ছে চারদিকে। তবে আমি বলবো, যে ছেলেটি বা যে মেয়েটি অভিনয় করতে চায় বা শিল্পী হতে চায় সে প্রথমে যে কাজটি করবে তা হলো কোন একটি প্রতিষ্ঠিত মঞ্চদল বা কোন একটি প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানে গিয়ে আগে নিজে অভিনয়টা শিখে নেবে। নিজেকে তৈরি করবে। এখানে হুটহাট করে কিছু করা যাবে না। আমাদের এখানে শুধুমাত্র অভিনয় শেখানোর জন্য ভালো প্রতিষ্ঠান হয়নি তারপরেও যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে একটু দেখে শুনে সেখানে গিয়ে নিজেকে তৈরি করে নিতে পারে। আর সঠিক মানুষ এবং সঠিক জায়গাটিতে যেতে হবে।”
শেষ করি, একটা গল্প বলে। আমি একজন নারীকে চিনি। এক শুটিং স্পটে তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তিনি তেমন কোনো পরিচিত শিল্পী নন। তবে এখন তাকে নাটকে দেখা যায়। মেয়েটি একটি প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করতো। সেখানেই পরিচয় হয় একজন প্রযোজকের সঙ্গে। প্রযোজক তাকে বলেন, “আরে তুমি তো অনেক সুন্দর। অভিনয় করতে পারো তো?”
মেয়েটির মাথায় ঢুকে পড়ে অভিনয়ের পোকা। সে স্বপ্ন দেখতে থাকে অভিনেত্রী হবে। দেশের মানুষ তাকে চিনবে। এই ভাবনায় তার ঘুম আর হয় না। সংসারে অভাব থাকবে না। স্বামী সন্তানের কথাও চিন্তা করে। স্বামী তাকে অনুমতি দেয় অভিনয় করার। ছোট্ট বাচ্চাকে রেখে মেয়েটি জীবনের প্রথম অভিনয় করতে যায়। সে দিন তার কত আনন্দ! ঢাকার বাইরে তার শুটিং। দু`একদিন থাকতে হবে। অনেক স্বপ্ন নিয়ে গিয়েছিল মেয়েটি। কিন্তু তার স্বপ্ন চোরাবালিতে হারিয়ে যায়। এ কয়দিন তার সঙ্গে যা ঘটেছে তার বর্ণনা এখানে দেওয়া যাবে না। তারপর যেন ভাবলেশহীন হয়ে পড়ে মেয়েটি। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে।
সে নাটক আর শেষ হয়নি। কিন্তু মেয়েটি এর শেষ দেখতে চায়। এই ভাবনা থেকে সে এবার নিয়মিত অভিনয় করার সিদ্ধান্ত নেয়। আর এভাবেই নিজের অজান্তে মেয়েটি চোরাবালিতে পড়ে যান। এখনো তিনি উঠতে পারেননি। গত চার-পাঁচ বছর ধরে তিনি কাজ করছেন। কিন্তু এখন অনেকেই তাকে নাটকে নেয়। তবে অভিনয়ের জন্য নয়। পরিচালক আর প্রযোজকের মন খুশি করার জন্য। নাটকে হয়তো দু-একটা দৃশ্যে অভিনয় করার সুযোগও পান।
এই মেয়েটির মতো অসংখ্য মেয়ে আছে যারা আজ এই ফাঁদে পা দিয়ে কেউ হয়েছে কলগার্ল, আর অনেকেই মাদকের দুনিয়ায় নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন। জীবন আপনার। সিদ্বান্ত আপনাকেই নিতে হবে। ফেসবুকের এই চোরা ফাঁদে পা দিয়ে নিজের জীবন আর স্বপ্নটার মৃত্যু হতে দিতে পারেন না আপনি। তাই সাবধান হে স্বপ্নবাজ তরুণী।
নিউজরুম