(৭ জানুয়ারী):২০০৮ সালের শেষ দিকে। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে অন্যান্য দলের মতো একটি নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ। তার শিরোনাম চমক সৃষ্টিকারী: ‘দিনবদলের সনদ’। সেই নির্বাচনে দলটির ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পেছনে ‘দিনবদলের সনদের’ বড় রকমের প্রভাব ছিল বলে অনেকের ধারণা। দলটি ক্ষমতায় গেলে কী করবে তার অঙ্গীকার ছিল ওই নির্বাচনী ইশতেহারে। সে অঙ্গীকারের ভিত্তিতেই যখন জনগণ ভোট দেয়, তখন সেটিকে জনগণের সঙ্গে দলটির চুক্তি বলেই গণ্য করা চলে। যেসব ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ছিল, জনপ্রশাসন তার অন্যতম।
জনপ্রশাসন নিয়ে অঙ্গীকার ছিল অনেক। একটি হলো প্রশাসনের দলীয়করণ। দিনবদলের সনদে বলা হয়, ‘দলীয়করণমুক্ত অরাজনৈতিক গণমুখী প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করা হবে। যোগ্যতা, জ্যেষ্ঠতা ও মেধার ভিত্তিতে সব নিয়োগ ও পদোন্নতি নিশ্চিত করা হবে।’ আমরা দেখছি, শুধু সচিবালয়কেন্দ্রিক পদেই এ চার বছরে সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিব পদে কয়েক দফায় এক হাজার ৮৪৩ জন কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়েছেন। এটা করতে গিয়ে ১৯৮২ থেকে ১৫শ বিসিএস ব্যাচ পর্যন্ত অতিক্রান্ত হয়েছেন ৯৩২ জন কর্মকর্তা। অনুপাত হিসেবে এটাকে অস্বাভাবিক বলা যাবে না। তবে অস্বাভাবিক হচ্ছে অতিক্রান্ত কর্মকর্তারা অনেকেই মেধাতালিকায় পদোন্নতি প্রাপ্তদের ওপরে। চাকরিজীবনে নিষ্ঠা ও দক্ষতার ছাপ এবং সততার সুখ্যাতিও আছে অনেকের। এখন অবশ্য দায়িত্বশীল মহল থেকে বলা হচ্ছে, শুধু যোগ্যতা, জ্যেষ্ঠতা ও মেধা থাকলেই হবে না; থাকতে হবে দেশপ্রেম।দেশপ্রেমবর্জিত কোনো ব্যক্তির চাকরিতে প্রবেশের বা টিকে থাকার কোনো সুযোগই নেই। কিন্তু বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদনে ‘দেশপ্রেমে’র জন্য কোনো নম্বর নেই।তাহলে কোনো কর্মকর্তার দেশপ্রেম যাচাই-বাছাই করা হবে কীভাবে? কারা তা করবেন? তা ছাড়া এই মানদণ্ডটির কথা তো দিনবদলের সনদেও নেই। এ ধরনের মানদণ্ডের কথা নেই পদোন্নতি-সংক্রান্ত বিধিমালায়ও। তাহলে কি নিছকই রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত কারণে এ মানদণ্ডে বাদ দেওয়া হচ্ছে না অনেক যোগ্য কর্মকর্তাকে? আর সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে তুলনামূলকভাবে কম যোগ্য কর্মকর্তাকে উচ্চপদে আসীন করার। শূন্য পদসংখ্যার অনেক বেশি পদোন্নতি দেওয়ার ফলে পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যককে মূল পদে পদায়ন করা যায়নি। পদবির উন্নতি হলেও কাজ করতে হচ্ছে অধস্তন আসনে। সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না প্রাধিকার অনুসারে। বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) রয়েছেন সচিব থেকে সহকারী সচিব পর্যায়ে প্রায় ৬০০ জন। ওএসডিদের বেশ কিছু এ অবস্থায় আছেন বছর চারেক। এসব থেকে তো মনে করার কোনো কারণ নেই যে দিনবদলের সনদ এ ক্ষেত্রে বাস্তবায়নের কোনো সদিচ্ছা আছে। এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য কোনো অর্থ, জমি, সময় কিংবা বৈদেশিক কারিগরি সহায়তার আবশ্যকতাও নেই। একমাত্র আবশ্যকতা রাজনৈতিক সদিচ্ছা। আবার দিনবদলের সনদে উল্লেখ না থাকলেও সরকারি চাকরির বয়স বৃদ্ধিতে আপাত কিছু সমস্যার সৃষ্টি করলেও সুফল দেবে নিকট ভবিষ্যতে।
অঙ্গীকার ছিল, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে রাজনীতির প্রভাবমুক্ত, আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তোলা হবে।’ আধুনিক যুগোপযোগী করতে হয়তো টাকা ও কিছু সময়ের প্রশ্ন রয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে কতিপয় ইতিবাচক পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়েছে কি? এসব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মুখ্য পুলিশ বাহিনীতে সর্বোচ্চ থেকে সর্বনিম্ন সব ক্ষেত্রে বিপর্যয়কর দলীয়করণ করা হয়েছে। কোনো রাখঢাক নেই এতে।রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণরত রাজনৈতিক নেতাদের রাজপথে প্রহারকারী পুলিশ কর্মকর্তা অনেককে ডিঙিয়ে পদোন্নতি পান বিগত জোট সরকারের সময়ের মতোই। ঘটে ভালো পদায়ন। এতে অবনমিত হয় পেশাদারিত্ব। ধারাবাহিকতা আগের জোট সরকারেরই।তাহলে দিনবদলের সনদ রইল কোথায়?
পুলিশ সংস্কার ও সিভিল সার্ভিস নিয়ে দুটো আইন করার বিষয়ে দিনবদলের সনদে সুস্পষ্টভাবে কিছু বলা হয়নি। এ দুটো আইন নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অনেকেই উৎসাহী। তবে অন্যান্য বাস্তবতা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন না হলে এ-জাতীয় আইন কোনো সুফল দেবে না। অপ্রিয় হলেও বলতে হয়, আইনি স্বাধীনতা কোনো সুফল দেয়নি দুর্নীতি দমন কমিশনকে। এমনকি সংবিধান দ্বারা সুরক্ষিত নির্বাচন কমিশনের কিছু অতীত ইতিহাসও অভিন্ন। কয়েকজন প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে অকালে বিদায় নিতে হয়েছে জনগণের চাপের মুখে। ঠিক তেমনই ২০০৭ সালের সূচনায় বিদায় নিতে হয়েছে গোটা নির্বাচন কমিশনকে। সুতরাং সরকার না চাইলে আইন হলেই প্রশাসন কিংবা পুলিশ তাদের প্রভাববলয়ের বাইরে যেতে পারবে বলে যাঁরা মনে করেন, এই নিবন্ধকার তাঁদের সঙ্গে একমত হতে অক্ষম। আবার জানা যাচ্ছে, সিভিল সার্ভিস আইনে বিভিন্ন পর্যায়ে সরাসরি উচ্চ পদে (লেটারাল এন্ট্রির মাধ্যমে) নিয়োগের বিধান রাখা হবে। এমনিতেই রাষ্ট্রপতির কোটায় যেকোনো পর্যায়ে কাউকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া যায়। আর এ ধরনের আইনি বিধান থাকলে প্রশাসনে অধিকতর রাজনীতিকীকরণ ঘটবে, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। বর্তমান কোটাব্যবস্থার (সংরক্ষিত ৫৫ শতাংশ) আরও সম্প্রসারণের বিধান নাকি সে আইনে থাকছে। এককথায় বলা যায়, এ-জাতীয় আইন সিভিল সার্ভিসের উন্নয়নের পরিবর্তে এর কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার মতোই হতে পারে।
দুর্নীতি দমন সম্পর্কে দিনবদলের সনদে অনেক কথাই লেখা আছে। এর একটি হচ্ছে, দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে কমিশনকে শক্তিশালী করতে হবে। এ নিয়ে লেখা আর বলা অনেক হয়েছে।শুধু বলা যায়, সাধারণ মানুষের কাছে কমিশনটির স্বাধীন সত্তা প্রশ্নবিদ্ধ।ক্ষমতায় আসীন কিংবা তাদের পৃষ্ঠপোষকতাধন্য ব্যক্তিদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে কমিশনের সক্ষমতা সম্পর্কে সংশয়বাদী সবাই। ‘রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তরে ঘুষ ও দুর্নীতি উচ্ছেদের’ অঙ্গীকার করা হয়েছিল। কিছু সেবা খাতের ওপর সাম্প্রতিক টিআইবি জরিপে দুর্নীতির ব্যাপকতা হ্রাস পাওয়ার তথ্য এসেছে। এটা প্রশংসনীয়। তবে প্রশংসা ম্লানও হয়ে যায় শেয়ারবাজার ধস, হল-মার্ক, ডেসটিনির মতো বড় বড় দুর্নীতির ফলে। এসব বিষয়ে যথার্থ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে দৃঢ়তা লক্ষণীয় নয়। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি হয়নি বলে সরকারের অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তি বলছেন। কিন্তু দুদক তো প্রাথমিক তদন্তে দুর্নীতি প্রচেষ্টার প্রমাণ পেয়েই মামলা করেছে। তবে মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের তালিকা প্রশ্নবিদ্ধ। এর ফলাফল সম্পর্কে কেউ কেউ আশাবাদী হতে পারছে না।
দিনবদলের সনদে আরও অঙ্গীকার আছে, ‘সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ শক্ত হাতে দমন করা হবে।’ জঙ্গিবাদ দমনে কঠোরতা প্রদর্শন করা হয়েছে। তবে সন্ত্রাসী, বিশেষ করে নিজেদের সমর্থক ছাত্রসংগঠনের সন্ত্রাসী নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভূমিকা হতাশাব্যঞ্জক। ক্ষেত্রবিশেষে মনে হয়, একে প্রণোদনাই দেওয়া হচ্ছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের অঙ্গীকার ছিল। কিন্তু মাত্রার হেরফের হলেও তা চলছে এনকাউন্টার, গুম ইত্যাদি কোনো না-কোনো নামে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে। তবে জেলখানায় চার নেতার হত্যার পুনর্বিচারের জোরদার প্রচেষ্টা লক্ষণীয় হচ্ছে না। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলাটিও নিষ্পত্তি হয়নি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকার প্রতিপালনে সরকারের সদিচ্ছাই লক্ষণীয়। যারা এ বিচারের বিপক্ষে, তারা একে প্রশ্নবিদ্ধ করতে সচেষ্ট হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে একে অকারণ প্রশ্নবিদ্ধকরণে সরকারের উচ্চপদে আসীন কিছু ব্যক্তির অযাচিত বক্তব্য দুঃখজনক। আশা রাখব, বিষয়টি দ্রুত আইনানুগভাবে নিষ্পত্তি হবে।
যেখানে যেটুকু সাফল্য, তার প্রশংসা সরকারের প্রাপ্য। আর ব্যর্থতার ক্ষেত্রেও গ্রহণযোগ্য যুক্তির ঘাটতি রয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। তবে প্রশাসনের সর্বাঙ্গে দলীয়করণের ফলে আজ প্রতিষ্ঠানটির দক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ, কার্যকারিতা গৌণ এবং গ্রহণযোগ্যতা ন্যূনতম পর্যায়ে।অথচ গণতান্ত্রিক দেশে, বিশেষ করে সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রশাসনকে রাষ্ট্রযন্ত্রের ইস্পাত কাঠামোর মতো বিবেচনা করা হয়। অথচ আমরা জেনেশুনে ক্রমান্বয়ে তাকে দুর্বল করছি। এমনিতেই বেতন-ভাতার অপ্রতুলতা, যথাযথ মর্যাদা না থাকা, বৈষম্যমূলক কোটাব্যবস্থার ফলে মেধাবীরা সরকারি চাকরিতে আসার আকর্ষণ হারিয়ে ফেলছেন। তা সত্ত্বেও অতীতের গৌরবোজ্জ্বল উত্তরাধিকারের মোহে কিছু কিছু মেধাবী তরুণ-তরুণী এখনো চলে আসছেন এ চাকরিগুলোতে। বেসরকারি খাতে উচ্চ বেতনে চাকরি করা কেউ কেউ আসছেন, এটাও দেখা যায়। সরকারের সচিব পদে বেশ কিছু মেধাবী, দক্ষ ও চৌকস কর্মকর্তা সবার নজর কাড়ে। আর এর বিপরীতটার সংখ্যাও নেহাত কম নয়। যথাযথ যাচাই-বাছাই হয়নি তাঁদের পদায়নে। বুদ্ধিদীপ্ত দৃষ্টিভঙ্গি, দায়িত্বে নিবেদিত ও পরিশ্রমী, নেতৃত্বের গুণাবলি আর সততার সুনাম থাকলে একজন অভিজ্ঞ ও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে সচিব করার কথা। এ ধরনের বেশ কিছু কর্মকর্তাকে বছরের পর বছর অধস্তন পদে কিংবা ওএসডি রেখে তুলনামূলক নিম্নমানের ও কনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের দায়িত্বশীল পদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে কতিপয় ক্ষেত্রে। ফল যা হওয়ার, তা-ই হচ্ছে এবং হবে।
জনপ্রশাসন নিয়ে দিনবদলের সনদ একটি নতুন প্রত্যাশার সূচনা করেছিল। প্রত্যাশা ছিল দলীয়করণমুক্ত অরাজনৈতিক প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। যোগ্যতা, মেধা ও জ্যেষ্ঠতাই হবে পদোন্নতির ভিত্তি। দুর্নীতি হ্রাস পাবে উল্লেখযোগ্য মাত্রায়। কিন্তু বর্তমান সমাজচিত্রটিতে এর কোনো প্রতিফলনই লক্ষণীয় নয়। বরং বিপরীত চিত্রটাই প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। এটা ঠিক, এর আগের জোট সরকারও এ ধরনের কাজ করেছিল নির্বিচারে। গণিতের সংখ্যা বিচারে কোনটা কম আর কোনটা বেশি, তা বলার সুযোগ নেই। আর সে জন্যই তো দিনবদলের সনদ মানুষ লুফে নিয়েছিল। দেখেছিল নতুন স্বপ্ন। সরকারের মেয়াদ চার বছর চলে যাওয়ার পর সে স্বপ্ন ভঙ্গ হতে বাকিই আর থাকে কী? শেষ বছরটিতে তারা কি বিষয়টি খতিয়ে দেখবে? একটি বছর তো একেবারেই কম সময় নয়। আর আশা নিয়েই তো ব্যক্তি কেন, সমাজও টিকে থাকে। সে আশা নিয়েই রইলাম।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।