বেনাপোল (৫জানুয়ারী) : দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল যশোরের বেনাপোল-শার্শা সীমান্তে গত ৪ বছরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে ২৬ বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। এসময় পাশবিক নির্যাতনের শিকার ও গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছে আরও শতাধিক যুবক।
পুটখালী সীমান্ত ওপারে ভারতের ঘোনার বিল সেখানকার মানুষের কাছে বাংলাদেশিদের মৃত্যু উপত্যকা হিসেবে পরিচিত।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল সীমান্তের ১০ জেলার মধ্যে যশোরের বেনাপোল সীমান্তে সম্প্রতি বিএসএফের হিংস্রতা অনেক বেড়েছে। এ সীমান্তে একই দিনে বিএসএফের গুলিতে ৩ বাংলাদেশি নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এদিকে, বিএসএফের গুলিতে ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে একই দিন এক বাবাও হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন।
দফায় দফায় পতাকা বৈঠক ছাড়াও দু’দেশের উচ্চ পর্যায়ের সীমান্ত বৈঠক হয় সেসময়। এসব বৈঠকে হত্যা ও নির্যাতন বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিলেও কোনোটাই রক্ষা করেনি বিএসএফ।
গত ৪ বছরে শার্শা সীমান্তে যে ২৬ বাংলাদেশি নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে ১০ জনকে গুলি করে এবং ১৬ জনকে বৈদ্যুতিক শকসহ অমানবিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হত্যার পর লাশ টেনে হিঁচড়ে সীমান্ত নদী ইছামতিতে ফেলে দেয় তারা। পরে মৃতদেহ ভেসে উঠলে পুটখালী সীমান্তের ওপারে ভারতের ঘোনার বিলে লাশ ফেলে দেয়। এ বিলটিকে সেখানকার মানুষ বাংলাদেশিদের মৃত্যু উপত্যকা হিসেবে চেনে।
সর্বশেষ ২০১২ সালের ৪ নভেম্বর শার্শার অগ্রভুলোট গ্রামের শরিফ (৩০), রাজা (২৮), শওকত (২৫) ও আমীর (৩২) নামে বাংলাদেশি চার গরু ব্যবসায়ীকে গুলি করে আহত করে বিএসএফ সদস্যরা।২৭ অক্টোবর বেনাপোল পৌরসভার ভবারবেড় গ্রামের ফল ব্যবসায়ী ইশারতকে (২৫) ধরে নিয়ে যায় তারা। এসময় তারা ২টি গ্রেনেড হামলা চালায়।
২৪ অক্টোবর বেনাপোল চেকপোস্ট সীমান্তে ফল ব্যবসায়ীদের লক্ষ করে ১ রাউন্ড গুলি ও ২টি গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটায়।
১৪ সেপ্টম্বর সকালে বিএসএফের তাড়া খেয়ে ভয়ে পানিতে ডুবে মারা যায় দৌলতপুর গ্রামের আলমগীর হোসেন (৩২)। ০২ জুলাই বেনাপোল সীমান্তের ওপারে কালিয়ানি সীমান্তে অজ্ঞাতপরিচয় বাংলাদেশি যুবক ভারত থেকে চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরার সময় তাকে গুলি করে হত্যা করে। পরে লাশ সনাক্তের জন্য বিজিবি সদস্যকে চিঠি পাঠায়। এরপর ০৮ জুন বেনাপোল সীমান্তে জয় শিকদারকে (২৭) গুলি করে হত্যা করা হয়।
১১ জুন অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের লক্ষ করে ৩টি গ্রেনেড বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। ২৬ এপ্রিল বেনাপোল চেকপোস্ট সীমান্তে ৭টি গ্রেনেড ছোড়ে, ২৪ এপ্রিল একই সীমান্তে ১টি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। ১৮ জানুয়ারি বেনাপোল চেকপোস্ট সীমান্তে ৪টি গ্রেনেড বিস্ফোরণে আহত হয় সামিউল ইসলাম ও মোস্তফা নামে দুই বাংলাদেশি যুবক।
২০১১ সালে বেনাপোলের ধান্যখোলা সীমান্তে রাশেদুল ইসলাম (২২) নামে এক বাংলাদেশিকে বাংলাদেশেরই ভূখণ্ডে গুলি করে হত্যা করে।
১২ ফেব্রুয়ারি পুটখালী গ্রামের আব্দুল জলিল (৩৫) ও অজ্ঞাতপরিচয় অপর এক গরু ব্যবসায়ীকে কালিয়ানি ক্যাম্পে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে ও বৈদ্যুতিক শক দিয়ে হত্যা করে।
১৭ ফেব্রুয়ারি পুটখালি সীমান্তে ইসরাফিল (৩০) নামে বাংলাদেশি এক গরু ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে হত্যা করে। ২৮ ফেব্রুয়ারি পুটখালী সীমান্তে আনোয়ার আলী (৩৮) নামে বাংলাদেশি এক গরু ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে জখম করে ইছামতি নদীতে ফেলে দেয়।
২৫ ফেব্রুয়ারি শার্শার রুদ্রপুর গ্রামের মিজানুর রহমান (৩০) ও ৩০ মার্চ বিকেলে বেনাপোলের পুটখালি সীমান্তে বুলবুল আহমেদ (২২) নামে বাংলাদেশি ২ গরু ব্যবসায়ীকে খুঁচিয়ে ও পিটিয়ে জখম করা হয়। ১৫ এপ্রিল ভোরে সাদীপুর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে আহত হন মামুনুর রহমান মুন্না (২৩)।
১ জুন ধান্যখোলা সীমান্তে আব্দুল আলীমকে (৩৩) গুলি করে হত্যা করে। ১৬ জুন একই সীমান্তে সাইফুল ইসলাম (৩৫), শাহিন আলী (৩০) ও জুলফিকার আলী (৩২) নামে তিনজনকে পিটিয়ে গুরুতর জখম করে।
৩ সেপ্টেম্বর বেনাপোল চেকপোস্টের ওপারে বিএসএফের গুলি ও দায়ের কোপে মজনু ওরফে মাখন মজনু নামে এক ঘাট মালিক নিহত হন। ১৬ নভেম্বর পুটখালি সীমান্তে বাতেন আহম্মেদকে (২৫) গুলি করে হত্যা করে। ৩০ নভেম্বর পাঁচভুলোট সীমান্তে তরিকুল ইসলামকে (২০) পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
৯ ডিসেম্বর গোগা সীমান্তে মনির হোসেন (৩৫) ও আশানুর রহমান (৩০) নামে দু’জনকে গুলি করে আহত করে। ১৯ ডিসেম্বর বেনাপোল পৌরসভার কাগজপুকুর গ্রামের শফিয়ারকে (৩০) পিটিয়ে হত্যা করে তারা।
২০১০ সালের ২০ ডিসেম্বর পুটখালী সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির লাশ নদীতে ভাসতে দেখা যায়। ১১ ডিসেম্বর গাতিপাড়া গ্রামের আমীরকে (৩০) পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
১৫ নভেম্বর ধান্যখোলা গ্রামের গফফারকে (৩৫), ৯ সেপ্টম্বর শিকড়ি গ্রামের আব্দুল ওয়াবের ছেলে মজনুকে ও ২৪ আগস্ট পুটখালী গ্রামের হাবিবকে (৩২) গুলি করে হত্যা করে।
২৫ আগস্ট ইছামতি নদীতে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির লাশ ভাসতে দেখা যায়। ২ আগস্ট পুটখালী গ্রামের লিটনকে (২৫) বৈদ্যুতিক শক দিয়ে হত্যা করে। ৫ আগস্ট বেনাপোলের দিঘিরপাড় গ্রামের রিপন (২৫), কাকমারী গ্রামের তরিকুল (২০) ও আলী হোসেনকে (২১) পিটিয়ে জখম করে। ২৫ আগস্ট ইছামতি নদীতে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির লাশ ভাসতে দেখা যায়।
৯ জুলায় শার্শার পাচভুলোট গ্রামের সবুজ (৩০), আহম্মেদ (৩১) ও গোপারপুর গ্রামের সাদ্দাম (২৭) গুলিতে নিহত হয়। এদিন ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে বাবা হোসেন হৃদযন্ত্রের ত্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। ৪ জুন গাতিপাড়া গ্রামের সমীরকে (২৫) গুলি করে হত্যা করে।
এছাড়া ২০০৯ সালে বিএসএফের গুলিতে আরও নিহতরা হলেন-যশোরের বেনাপোলের গয়ড়া গ্রামের আলাউদ্দিন, বেনাপোলের দুর্গাপুর সীমান্তে একজন। এছাড়া নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয় শার্শা উপজেলার হরিষচন্দ্রপুরের হযরত, পুটখালীর মনির ও অজ্ঞাতপরিচয় একজনকে।
বিএসএফের নির্যাতনে আহত হয়েছে শতাধিক যুবক। এদের অনেকেই পঙ্গু হয়ে গেছে চিরদিনের জন্য। গুলি করে, কুপিয়ে, বেয়নেট চার্জ করে, পিটিয়ে তাদের মৃত মনে করে সীমান্ত এলাকায় ফেলে দিয়ে যায় বিএসএফ। নিহত স্থানীয় গরু ব্যবসায়ীদের পরিচয় পেয়ে লাশ উদ্ধার হলেও দূর-দূরান্ত থেকে আসা সীমান্ত পারাপারকারী অনেক নিহত মানুষের খোঁজ পাওয়া যায়না। স্থানীয়রা খোঁজ খবর পেলেও মামলার ভয়ে খবর গোপন রাখে।
নিউজরুম