ঢাকা (৫জানুয়ারী) : জরাজীর্ণ একটি বাড়িতে থাকেন। যে বেতন পান তার ৯০ শতাংশ দান করেন। টাইতো (গলা বন্ধনি ফিতা) দূরের কথা জাঁকজমক পোশাকও পরতেন না।ফুলের চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
পাঠক এই অনাড়ম্বর জীবন যেন তেন কোন ব্যক্তির নয়। তিনি একজন প্রেসিডেন্ট। কি চমকে উঠলেন নাকি! কোন গল্প নয়।
যেখানে আমাদের দেশের একজন মন্ত্রী কোটি টাকার গাড়িতে চড়েন, বিলাসবহুল বাড়িতে থাকেন। কয়েক কিলোমিটার দূরত্বের অফিস যেতে রাস্তা ফাঁকা করেন, সঙ্গে থাকে ডজন সংখ্যক নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য। এই বাস্তবতায় উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট হোসে মুহিকার জীবনযাপন গল্পই মনে হবে।
উরুগুয়ের শীর্ষ ক্ষমতাধর ব্যক্তিটি একদিন ছিলেন গেরিলা যোদ্ধা-সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী।
রাজধানী মন্টিভিডিওর বাইরে জরাজীর্ণ বাড়িটিতে সিনেটর স্ত্রীসহ থাকেন তিনি। কোন পরিচারক-চারিকা নেই তাদের। নিজেরাই নিজের কাজ করেন। মাত্র দুজন নিরাপত্তারক্ষী রয়েছে মুহিকার। সাদা পোশাকধারী এই দুই নিরাপত্তারক্ষীদের কখনও সঙ্গে নেন, আবার কখনও নেন না।
প্রেসিডেন্টের এই সাধারণ জীবন দেখে অনেকের চোখে ভেসে উঠতে পারে লাতিন আমেরিকার দেশটি বুঝি দরিদ্র। কিন্তু নয়। সুয়ারেস ই রিইয়েস নামে বিলাসবহুল প্রাসাদ রয়েছে প্রেসিডেন্টের জন্য। প্রেসিডেন্টের সেবা করার জন্য ৪২ জন কর্মীর একটি দলও রয়েছে প্রাসাদে। কিন্তু প্রাসাদ ছেড়ে নিজের বাড়িতে থাকছেন হোসে মুহিকা ও তার স্ত্রী লুসিয়া তোপোলানস্কি। বাড়ির সংলগ্ন এক খণ্ড জমিতে চন্দ্রমল্লিকার চাষ করেন এ দম্পতি। স্থানীয় বাজারে আবার বিক্রিও করেন ফুল।
২০১০ সালে যখন ক্ষমতা হাতে নেন তখন তার সম্পদের পরিমাণ ছিল মাত্র এক হাজার ৮শ মার্কিন ডলার। পুরোনো মডেলের একটি গাড়ি না থাকলে সম্পদের পরিমাণ আরও অনেক কম হতো লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের প্রেসিডেন্টের। সরকারি কোষাগার থেকে যে বেতন পান তার ৯০ শতাংশ দান করেন যার বড় অংশ ব্যয় হয় গরীবদের মাথাগুজার ঠাই নির্মাণে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার মাসিক বেতন ১২ হাজার মার্কিন ডলার।
২০১০ সালে ক্ষমতায় আসার পরপরিই মারিজুয়ানা ও সমলিঙ্গের বিয়েকে বৈধতা দিতে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। গর্ভপাত আইন করেও উরুগুয়েকে অঞ্চলের আলোচিত দেশে পরিণত করেন তিনি। বায়ু থেকে নবায়ণযোগ্য জ্বালানি উৎসের ব্যবহার বৃদ্ধি করে অর্থনীতির চাকাকে সচল করেন কিউবার বিপ্লবে অনুপ্রাণিত সাবেক এ গেরিলাযোদ্ধা।
এক সময় অস্ত্র হাতে সরকার উৎখাতে নেতৃত্বদানকারী এ নেতার উদারতা উরুগুয়েকে লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে উদার দেশের আসনে বসিয়েছে।
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে মুহিকা বলেন, “প্রেসিডেন্ট পদকে কম প্রভাবশালী করতে আমরা সম্ভাব্য সবকিছু করেছি।”
মুহিকার এই দরিদ্র জীবনযাপন অনেকের কাছে খটকা লাগতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি। কিন্তু অর্থ-বৈভব-প্রার্চুয থাকলেই মানুষের চাহিদার অবসান ঘটে না। রোমান দার্শনিক সেনেসার উদ্ধৃতি দিয়ে মুহিকা বলেন, “ যার কম আছে যে গরিব নয়, যে যত চায় সেই গরিব।”
একজন বাগানচাষী হওয়ার আগে এই মুহিকা ছিলেন তুপামারোসের নেতা। কিউবার বিপ্লবে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৬০’র দশকে গঠিত তুপামারোস গেরিলা গোষ্ঠীতে যোগ দেন। রাজধানী মন্টিভিডিও রাস্তায় রাস্তায় ব্যাংক ডাকাতি, অপহরণ ও সহিংসতার মাধ্যমে (কু)খ্যাতি কুড়ায় তুপামারোস। তবে মুহিকা জানান, তারা হত্যা পরিহার করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাত। ১৯৬৯ সালে মন্টিভিডিওর একটি শহরও দখলে নেয় তুপামারেস।
সরকারি বাহিনীর পাল্টা অভিযানের কাছে হার মানে মুহিকার গোষ্ঠী। ১৯৭২ সালে বন্দিত্ব বরণ করতে হয় তাকে। দীর্ঘ ১৪ বছরে কারাগারে থাকতে হয় তাকে। এক দশকেরও বেশি সময় থাকতে হয় থাকে নির্জন কারগারে, অধিকাংশ সময় তাকে রাখা হাতো মাটির নিচের কারাগারের মাটির নিচের কক্ষে। কারাগারে এমনও হয়েছে যে, এক বছরেরও বেশি সময় গোসল ছাড়াই কাটাতে হয়েছে তাকে। আর তার সঙ্গী ছিল ছোট ছোট ব্যাঙ ও ইঁদুর। অনেক সময় শুকনো রুটি ভাগাভাগি করে খেতেন সঙ্গীদের সঙ্গে।
কিন্তু দীর্ঘ কারাবন্দি জীবন সম্পর্কে খুব কম মুখ খুলেন মুহিকা। তিনি বলেন, “তার উপলব্ধি একজন সবসময় আবারও শুরু করতে পারে।”
১৯৭২ সালে গ্রেফতার হওয়ার আগেও একবার গ্রেফতার হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে সহযোগীদের সঙ্গে কারাগার থেকে পালাতে সক্ষম হন তিনি। ছয় ছয়বার পুলিশের গুলি বিঁধেছে তার শরীরে। ৯৮৫ সালে সামরিক সরকারের পতন এবং গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসলে মুহিকাকে মুক্তি দেওয়া হয়।
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কয়েক বছর পর অন্যান্য বামপন্থি গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে মিলিতিভাবে মুহিকা ও তার তুপামারোস মুভমেন্ট অব পপুলার পার্টিসিপেশন (এমিপিপি) নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ১৯৯৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুহিকা ডেপুটি এবং ১৯৯৯ সালের নির্বাচনে সিনেটর নির্বাচিত হন। মুহিকার ক্যারিশমার কারণে এমপিপির জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে।
২০০৪ সাল নাগাদ জোট ব্রড ফ্রন্টের সবচেয়ে বড় শাখা হিসেবে গড়ে ওঠে এমপিপি। ২০০৪ সালের নির্বাচনে আবারও সিনেটর নির্বাচিত হন মুহিকা। ৩ লাখ ভোট পেয়ে তাবারে ভাসকেসকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পেছনে বড় অবদান রাখে এমপিপি। ২০০৫ সালের ১ মার্চ তৎকালীন প্রেসিডেন্ট তাবারে ভাসকেস মুহিকাকে গবাদিপশু, কৃষি ও মৎস্য বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। মুহিকার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে তাকে মন্ত্রী বানান ভাসকেস।
২০০৯ সালের নির্বাচনে ব্যাপক ব্যবধানে প্রতিপক্ষ লুইস আলবার্তো লাকালেকে পরাজিত করেন মুহিকা। মুহিকার ছোট বাড়িটিকে উপহাস করে ‘গুহা’ বলেছিলেন আলবার্তো লাকালে।
নিজের উত্তরসূরি তাবারে ভাসকেসও নিজের বাড়িতে থাকতেন-এটা বলতে ভুলেননি মুহিকা। বিশ শতকে উরুগুয়েকে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠাকারী প্রেসিডেন্ট হোসে ব্যাটলি ই ওরদোনেস প্রেসিডেন্ট ও নাগরিকের মধ্যে কোন বৈষম্য থাকবে না এমন প্রথা চালু করেছিলেন বলে উল্লেখ করেন মুহিকা।
লাতিন আমেরিকায় যখন অপরাধ ঘোড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তখন উরুগুয়ে নিজেকে অঞ্চলের সবচেয়ে নিরাপদ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলছে।
ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজ, বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট ইভো মোরলেসের মতো নেতাদের নয়, ব্রাজিলের মধ্যমপন্থি সাবেক প্রেসিডেন্ট লুলা দ্য সিলভা ও চিলির সমাজতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট মিশেল ব্যাচলেতকে আদর্শ মানেন মুহিকা। ইরান সম্পর্কে মুহিকার মন্তব্য “ইরানে যতই বেড়া দেবেন, তা ততই বিশ্বের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।”
নিউজরুম