৪ জানুয়ারি, ২০১৩
উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে নীতিমালা প্রণয়ন থেকে পিছু হটেছে সরকার। দুই মাস আগে এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারির সিদ্ধান্ত থাকলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না আপাতত। নিয়মনীতির যোগ্যতা নির্ধারণের বেড়াজালে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ আটকে যেতে পারে বলে সরকার ওই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে মর্মে নয়া দিগন্তের এক বিশেষ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুসারে, প্রধান বিচারপতির সম্মতি নিয়ে এই বিধির খসড়া চূড়ান্ত করা হয়। এতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগে শিাগত যোগ্যতা নির্দিষ্ট করে বলা হয়, কোনো প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতায় তৃতীয় বিভাগ বা তৃতীয় শ্রেণী গ্রহণযোগ্য হবে না। যারা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন, নিয়োগের েেত্র শুধু তাদেরকেই প্রাধান্য দেয়া হবে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক এড়াতে এবং রাজনৈতিকভাবে সুপ্রিম কোর্টকে করায়ত্তের চেষ্টা বন্ধ করতে একটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়। এ অধ্যাদেশে বিচারপতি নিয়োগের জন্য প্রস্তাবিত ব্যক্তির শিাগত যোগ্যতা, পেশাগত দতা, জ্যেষ্ঠতা, সততা ও সুনামসহ কিছু বিষয় নির্ধারণ করা হয়। উপযুক্ত ব্যক্তি বাছাই করতে কমিশনের মৌখিক সাাৎকার গ্রহণ এবং বাছাইপ্রক্রিয়ায় কারো মতামত বা পরামর্শ প্রয়োজন হলে যেকোনো ব্যক্তিকে কমিশনের সভায় আমন্ত্রণ করার বিধান ছিল। স্থায়ী করার েেত্র হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে দতা, জ্যেষ্ঠতা, পেশাগত সততা ও সুনামসহ সার্বিক উপযুক্ততা বিশেষভাবে বিবেচনা করার মতা ছিল কমিশনের। হাইকোর্ট থেকে আপিল বিভাগে নিয়োগের েেত্রও অভিন্ন বিধান অনুসরণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটি কার্যকর হয়নি। হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ অধ্যাদেশের একটি উপবিধি অকার্যকর হিসেবে বাতিল করেন। বর্তমান সরকার মতায় আসার পর এই অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করার সুযোগ থাকলেও তা করা হয়নি।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে দীর্ঘ ৪০ বছরেও কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়নি। ফলে বারবার বিচারপতি নিয়োগে দেখা দেয় বিতর্ক। অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, সততার বিষয় উপেক্ষা করে রাজনৈতিক ও দলীয় বিবেচনায় বিচারপতি নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ এখন একটি নিত্যবিষয়। সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদে উল্লিখিত সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির যোগ্যতা অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হবেন এবং প্রধান বিচারপতির সাথে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারক নিয়োগ দেবেন। সংবিধান অনুযায়ী আইন পেশায় ১০ বছর মেয়াদ বা বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার পদে ১০ বছর অতিবাহিত হলেই হাইকোর্টের বিচারপতি নিয়োগ করা হবে।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক প্রবণতায় দেখা যায়, যখন যে দল সরকারে যায় তারা বিচার বিভাগকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চায়। ক্ষমতাসীনেরা বিচারক নিয়োগে বিশেষত উচ্চতর আদালতে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতার পরিবর্তে দলবাজ ধরনের আইনজীবীদের নিয়োগের জন্য বাছাই করেন। প্রতিটি রাজনৈতিক সরকারের আমলেই যেন এই প্রবণতা বাড়ছে। এ কারণে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে দেশে-বিদেশে নানা ধরনের সমালোচনা উঠছে। এমনকি নিম্ন আদালতে বিচারক নিয়োগের যে অ্যাকাডেমিক শর্ত রয়েছে, সেটিও উচ্চ আদালতে কার্যকর নেই। উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে সংবিধানে যেটি উল্লেখ রয়েছে, সেটি একটি মোটা দাগের দিকনির্দেশনা। এর আলোকে বিচারপতি নিয়োগের জন্য বিস্তারিত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ আইন করার প্রয়োজন ছিল অনেক আগেই। এ ধরনের আইন বা বিধি না থাকায় শিক্ষা বিভাগের সব স্তরে তৃতীয় বিভাগ নিয়ে যেখানে নিম্ন আদালতে বিচারক হওয়া সম্ভব হচ্ছে না, সেখানে এ যোগ্যতা নিয়ে উচ্চতর আদালতে বিচারপতি নিয়োগ লাভ করে তার পক্ষে প্রধান বিচারপতি হওয়াও সম্ভব । এটি শুধু সম্ভব নয়, বাস্তবে ঘটেছেও।
আমরা মনে করি, রাষ্ট্রকে কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে সামনে এগিয়ে নিতে হলে তিন অঙ্গের প্রধান প্রতিষ্ঠান বিচার বিভাগকে উপেক্ষা করা উচিত নয়। আর বিচার বিভাগে যোগ্যতার দিক থেকে অসমর্থ ও দলান্ধ লোক নিয়োগ দেয়া হলে তাদের পক্ষে রাষ্ট্রের বিচারিক দায়িত্ব যথার্থভাবে পালন করা সম্ভব হবে না। এ কারণে বিচারপতি নিয়োগের নীতিমালা অবিলম্বে আইনে পরিণত করে কার্যকর করা প্রয়োজন। বলার অপেক্ষা রাখে না বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথকীকরণে এ পর্যন্ত যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, বিচারপ্রক্রিয়ায় প্রশাসনের সর্বগ্রাসী অধিপত্য বিস্তারের কারণে তার কোনো প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। বিচার বিভাগকে কার্যকর করতে হলে এ ধরনের অন্যায্য প্রভাব বিস্তারের পথও বন্ধ করতে হবে বলে আমরা মনে করি।