নির্দলীয় সরকার ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে না : মির্জা ফখরুল

0
383
Print Friendly, PDF & Email

রুপসীবাংলা, ঢাকা (০৩ ডিসেম্বর) : একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে রোববার রাত এগারোটায় প্রচারিত অনুষ্ঠানে দর্শকদের সামনে উপস্থিত হন প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

প্রায় এক ঘণ্টা স্থায়ী ওই অনুষ্ঠানে সঞ্চালকের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেওয়ার পাশাপাশি তিনি দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবিতে চলমান বিরোধী দলের আন্দোলন প্রসঙ্গে নিজেদের দলীয় অবস্থান তুলে ধরেন।
 
অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীর সাম্প্রতিক বিভিন্ন কর্মকা-ের ব্যাপারে বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হয় মির্জা ফখরুলকে। জবাবে ফখরুল বলেন, “জামায়াতে ইসলামী বর্তমান ১৮ দলীয় জোটের শরীক। নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে একমত হয়েই মূলত জোটবদ্ধ হয়েছে বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো। তবে জামায়াতের আলাদা দলীয় রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের অধিকার রয়েছে। তারা নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল। তাই নিয়মতান্ত্রিকভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচি তারা পালন করেতেই পারে।”

তিনি বলেন, “সাধারণত নির্বাচন বা আন্দোলন প্রশ্নেই সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো জোটবদ্ধ হয়। পাকিস্তান আমলেও হয়েছিলো, এমনকি আজকে যারা জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির জোটের সমালোচনা করছেন তারাও জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন। শেখ হাসিনা জামায়াতের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন তা পত্রিকা মারফত সবাই জানেন।”

জামায়াত সহিংস রাজনীতি করছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে এ অভিযোগের বাস্তবতা নিয়েই প্রশ্ন তোলেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, “মিছিল করতে গেলে জামায়াতকে বাধা দেওয়া হচ্ছে। আত্মরক্ষার অধিকার সবারই আছে। এটা জন্মগত অধিকার।”  

তিনি বলেন, “নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের অধিকার আছে সমাবেশ করার। কিন্তু সোমবার আহবান করা তাদের বায়তুল মোকাররমের সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি। এভাবেই নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক সমাবেশ বাধা দেওয়া হচ্ছে।“

জামায়াতের অতীতের স্বাধীনতা বিরোধী ভূমিকার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে মির্জা ফখরুল বলেন, “জামায়াতের বর্তমান রাজনীতি আর একাত্তরে করা তাদের রাজনীতি এক নয়। বর্তমান ১৮ দলীয় জোটের শরীকদলগুলো একটি অভিন্ন ইস্যু, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে বৃহত্তর ঐক্যের ডাক দিয়েছে, আন্দোলন করছে। তাই এক্ষেত্রে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির রাজনৈতিক মিত্রতা হতেই পারে”।

১৮ দলীয় জোটের অধিকাংশ দলই নাম সর্বস্ব কি না এমন প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, “বর্তমান জোটে শরীক প্রত্যেকটি দলেরই সরব উপস্থিতি রয়েছে। আন্দোলন, সংগ্রামে প্রত্যেকটি দলই তাদের নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী অংশ নিচ্ছে”।
 
সিংগাপুর থেকে কোকোর টাকা ফিরিয়ে আনা প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “২০০২ সালের ঘটনা দেখিয়ে মামলা হয়েছে ২০০৯ সালে।” এ সময় তিনি পাল্টা প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘টাকাটা আসলে কার অ্যাকাউন্ট থেকে এসেছে?’

কোকোর বিরুদ্ধে দুদকের মামলাকে উদ্দেশ্য প্রণোদিত আখ্যা দিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, এ মামলার উদ্দেশ্যন হচ্ছে জিয়া পরিবারকে ধ্বংস করা।  তিনি অভিযোগ করেন, শুধু কোকো বা তারেকই নন বিএনপির অন্যান্য সিনিয়র নের্তৃবৃন্দের বিরুদ্ধেও মিথ্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে। এমনকি তার নামেও বোমাবাজির মামলা দেওয়া হয়েছে। তিনি দাবি করেন এ সব মামলা ও হয়রানির উদ্দেশ্য বিএনপি নেতৃবৃন্দকে চলমান আন্দোলন সংগ্রাম থেকে বিরত রাখা।

এ সময় তিনি পাল্টা প্রশ্ন তুলে বলেন আরাফাত রহমান কোকো জেলে যাওয়ার পর এ টাকা জমা হয়। কোকো জেলে যান ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আর টাকা জমা হয় নভেম্বর মাসে। তিনি প্রশ্ন করে বলেন ,‘জেলে থাকা অবস্থায় কিভাবে কোকো লেনদেন সম্পন্ন করলেন?’

মির্জা ফখরুল এ সময় অভিযোগ করেন বর্তমান সরকার আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে অতীতে দায়ের করা সাড়ে সাত হাজার মামলা তুলে নিয়েছে, পাশাপাশি ফাঁসির ২১ আসামিকে মাফ করেছে, যা নজিরবিহীন।

তিনি বলেন, সরকার বিরোধী দলকে নির্মূল করতেই এসব করছে। তাদের উদ্দেশ্য বিরোধী দলকে এদেশের রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখা এবং একদলীয় শাসন কায়েম করা।

তিনি দাবি করেন সরকার ক্ষমতায় আসার সময় যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো তা বাস্তবায়নের চেষ্টা না করে শুধু বিরোধী দলগুলোকে হয়রানি করার কাজেই লিপ্ত রয়েছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে বিএনপির অতীতের বিরোধিতার প্রসঙ্গে করা সঞ্চালকের প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, বিএনপি ৯৬ সালে জনগণের মতামতকে সম্মান জানিয়ে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল করেছিলো। এখনও সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা সম্ভব না।“  

এ প্রসঙ্গে তিনি সদ্য সমাপ্ত বিএমএ নির্বাচনের উদ্ধৃতি দেন। তিনি দাবি করেন বিএমএ নির্বাচনে ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এমনকি ঢাকাতে ভোটারের থেকে ব্যালট বেশি পড়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

১/১১’র সরকার প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল ঐ সরকারকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক সরকার হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি দাবি করেন ঘরে বাইরের অপশক্তিগুলো এক জোট হয়ে দেশকে বিরাজনীতিকরণের পথে ঠেলে দেওয়ার জন্য এ ষড়যন্ত্র করেছিলো।

দেশে এখনও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এছাড়া দেশের জনগণও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে বলে দাবি করে তিনি এ ব্যাপারে বিভিন্ন পত্রিকার জনমত জরিপের ফলাফলের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন।
 
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে উচ্চ আদালতের বাধ্যবাধ্যকতার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেওয়া হলে মির্জা ফখরুল বলেন, আদালত জনগণের বাইরে নয়। মানুষের আশা আকাঙ্খার বাইরে নয়। আদালতের বাধ্যবাধকতার অজুহাতে আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে বিএনপি যাবে না বলে এ সময় উল্লেখ করেন তিনি।

বিচার বিভাগ সম্পর্কিত এ প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, আওয়ামী লীগ বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, বিচার বিভাগের ওপর জনগণের আস্থা নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে ১৬ মাস পর রায় দিয়ে বিচারপতি খায়রুল হক বিতর্কিত হয়েছেন উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল দাবি করেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে ওই রায়ের মিল আছে।

এছাড়া খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক ভারত সফর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, খালেদা জিয়া ভারত গেছেন সেদেশের সরকারের আমন্ত্রণে। এ সময় খালেদা জিয়ার সঙ্গে ভারতীয় পক্ষের আন্তরিক পরিবেশে আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, মূলত বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বিদ্যমান সমস্যাগুলোর ওপর আলোচনা হয়েছে উভয় পক্ষের বৈঠকে।

ভারত সফরে খালেদার আলোচিত বক্তব্য, ‘তার সরকার ক্ষমতায় আসলে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দেশের মাটি ব্যবহার করতে দেবে না’ এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে মির্জা ফখরুল এ বক্তব্যকে অসম্পূর্ণ বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন মিডিয়ায় খালেদা জিয়ার বক্তব্যের মাত্র একটি দিক উপস্থাপিত হচ্ছে। আরেকটি দিক আধারেই থেকে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, খালেদা জিয়া বলেছেন ভারত যেমন বাংলাদেশ বিরোধী শক্তিগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া বন্ধ করবে তেমনি বিনিময়ে বাংলাদেশও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রশ্রয় দেবে না।

 
নির্বাচন কমিশনের সাম্প্রতিক সংলাপে বিএনপির না যাওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের গঠন প্রক্রিয়া অবৈধ। নির্দলীয় সরকারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত ছাড়া নির্বাচন কমিশন গঠন করে কোনো লাভ নেই বলেও উল্লেখ করেন তিনি।  তিনি বলেন, “আমরা কেন যাচ্ছি না তা নির্বাচন কমিশনকে জানানো হয়েছে।”

আশুলিয়ার সাম্প্রতিক অগ্নিকা-ের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি এর সম্পূর্ণ দায়দায়িত্ব সরকারের বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, সরকারের তদারককারী সংস্থাগুলো দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করলে এ দুর্ঘটনা ঘটতো না। আর এসব সংস্থাকে কার্যকরীভাবে পরিচালনা না করতে পারার ব্যর্থতাও সরকারের বলে উল্লেখ করেন তিনি। তাই আশুলিয়ার অগ্নিকা-ের দায় বর্তমান সরকারের ওপরই বর্তায় বলে দাবি করেন মির্জা ফখরুল ।

মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি বর্তমান সরকারের কৃতিত্ব কি না এ প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, মানব উন্নয়ন সূচকে অগ্রগতি সরকারের নয়, এর কৃতিত্ব বাংলাদেশের মানুষের। এছাড়া পুরো প্রক্রিয়াটি কোনো একক সরকারের কৃতিত্ব নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।

বিডিআর বিদ্রোহ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ ঘটনার সঙ্গে সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তি জড়িত বলে পত্র পত্রিকায় খবর  বেরিয়েছে। পাশাপাশি শেয়ার বাজারের সাম্প্রতিক ধ্বস প্রসঙ্গে বলেন, “এত বড় একটা ঘটনা ঘটলো অথচ কাউকে এখনও গ্রেফতার করা হয়নি।“

পাবর্ত্য চুক্তি প্রসঙ্গে বিএনপির অবস্থান জানতে চাওয়া হলে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ওই চুক্তি ত্রুটিপূর্ণ। তিনি বলেন, বাংলাদেশে প্রত্যেক নাগরিক সমান অধিকার নিয়ে থাকবে। ত্রুটির কারণেই আওয়ামী লীগ সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসেও চুক্তি বাস্তবায়ন করতে পারছে না বলে উল্লেখ করেন তিনি।
 
ভবিষ্যতে ক্ষমতায় আসা প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, বিএনপি নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। জনগণ আবারও দায়িত্ব দিলে বিএনপি তার কর্তব্য পালন করবে।

বিএনপির সংসদ বর্জন সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন সংসদে বিএনপিকে কথা বলতে দেওয়া হয়না। এমনকি বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়ারও মাইক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অথচ এটা রীতি বিরোধী দলীয় নেতা যতক্ষন কথা বলতে চাইবেন ঠিক ততক্ষনই মাইক দিতে হবে।

অনুষ্ঠানে সবশেষে তিনি বলেন, “নির্দলীয় সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বিএনপি।” পাশাপাশি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে নিয়মতান্ত্রিকভাবে এ ব্যাপারে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথাও উল্লেখ করলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব।

নিউজরুম

শেয়ার করুন