রুপসীবাংলা, ঢাকা (০৩ ডিসেম্বর) : বিশ্বব্যাংকের চাপে আছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পদ্মাসেতু প্রকল্পে এ পর্যন্ত দুদকের অনুসন্ধানে সন্তুষ্ট হতে পারেনি বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেল। দুদকের অনুসন্ধান কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে রোববার বিকেলে আন্তর্জাতিক এ প্যানেলের প্রধান লুই গ্যাবরিয়েল মোরেনো ওকাম্পো কমিশনের চেয়ারম্যান গোলাম রহমানকে তাদের অসন্তুষ্টির কথা জানান।
নির্ভরযোগ্য সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
বৈঠক সূত্র জানায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির সঠিক তথ্য উদঘাটন করতে গত ১৪ অক্টোবর বিশেষজ্ঞ প্যানেল ঢাকায় এসে অনুসন্ধান টিমকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়। এসব পরামর্শের মধ্যে ছিল, সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী ও সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভুইয়াঁসহ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা। দ্বিতীয় পর্যায়ের জিজ্ঞাসাবাদে দুদক পদ্মাসেতুর পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের কিছু অভিযোগ পেলেও সে অভিযোগ ওকাম্পোর প্যানেলকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের উর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, “রোববার প্যানেলের সঙ্গে বৈঠকে প্রতিনিধিদল জানিয়েছেন, দুদকের অনুসন্ধানে তারা পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন। তাদের পুরোপুরি সন্তুষ্ট না হওয়াকে আমরা এক প্রকার চাপ বলে মনে করছি। তবে এ ব্যাপারে দ্রুত বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করছেন তারা।”
তিনি বলেন, “বিশেষজ্ঞ দলের পরামর্শ অনুযায়ী অনুসন্ধান টিম পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদও করেছে। তদন্তে অগ্রগতিমূলক তথ্যও আমরা তুলে ধরেছি। কিন্তু তারা জানিয়েছেন এগুলোই যথেষ্ট নয়।”
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে প্যানেলের সঙ্গে বৈঠকে উপস্থিত থাকা দুদকের আইন উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বাংলানিউজকে বলেন, “তারা দুদকের অনুসন্ধান আরো গতিশীল করতে বলেছেন, যাতে একটি উপসংহারে আসা যায়।”
সূত্র জানায়, রোববার প্যানেল দুদকের অনুসন্ধান টিমকে জানিয়েছেন দ্রুততম সময়ে দোষীদের চিহ্নিত করে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে যেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
পাশাপাশি সৈয়দ আবুল হোসেন ও আবুল হাসান চৌধুরীকে জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্ত প্রতিবেদনের কাজ সম্পন্ন করে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে দুদকের প্রতি আহবান জানিয়েছে প্যানেল।
তবে প্যানেলকে দুদক জানিয়েছে, এ পর্যন্ত আবুল হোসেন, মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াসহ পদ্মাসেতু প্রকল্পের সাবেক পরিচালক রফিকুল ইসলাম, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী ও নিক্সন চৌধুরীর বিরুদ্ধে সরাসরি দুর্নীতির প্রমাণ না পাওয়া গেলেও তারা দুর্নীতির ষড়যন্ত্র করতে চেয়েছেন এমন আভাস পাওয়া গেছে। এসময় তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা প্যানেলকে জানিয়েছে দুদকের অনুসন্ধান টিম।
প্যানেল জানিয়েছে, এ প্রকল্পে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের লোক, একাধিক সরকারি কর্মকর্তা, প্রকৌশলী ও প্রকল্প সংশ্লিষ্ট অনেক কর্মকর্তাই দুর্নীতির ষড়যন্ত্র করতে চেয়েছেন। এসব ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দালিলিক তথ্য প্রমাণ বের না করলে অনুসন্ধানে অগ্রগতি আসবে না।
ওকাম্পোর দল জানিয়েছে, দুদকের অনুসন্ধানের ওপর নির্ভর করছে পদ্মাসেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের বিষয়টি। তাই প্যানেলও দুদকের কাছে সুষ্ঠু তদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাশা করছে। কারণ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানটি এ প্রকল্পে ঋণ সহায়তা দিতে চায়।
জবাবে সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ প্রতিবেদন দিতে অনুসন্ধান টিম কাজ করছে বলে কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয় আন্তর্জাতিক প্যানেলকে।
এদিকে বিশেষজ্ঞ দলের সঙ্গে দুদকের দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রথম বৈঠক শেষে বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি অ্যালেন গোল্ডস্টেইন জানিয়েছেন, পদ্মাসেতু প্রকল্পে দুদকের ব্যবস্থার উপর নির্ভর করছে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন।
রোববার বিকেলে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন বিশ্বব্যাংকের এ প্রতিনিধি।
পদ্মাসেতু প্রকল্পে কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনকে পরামর্শক হিসেবে কাজ পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে ঘুষ দিতে হবে, এমন কিছু ব্যক্তির নামের তালিকা গত জুলাই মাসে পেয়েছে দুদক। বিশ্বব্যাংকের তরফ থেকে দুদক চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো একটি চিঠির সঙ্গে ওই তালিকাটি পাঠানো হয়।
দুদক সূত্র জানায়, কানাডিয়ান নাগরিক রমেশের ডায়েরিতে দুর্নীতির তালিকায় প্রথমে সংক্ষিপ্তভাবে লেখা হয় তিন ব্যক্তির নাম। তারা হচ্ছেন তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া ও পদ্মাসেতু প্রকল্পের সাবেক পরিচালক রফিকুল ইসলাম। এরপর সম্পূর্ণরূপে লেখা হয় সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী ও নিক্সন চৌধুরীর নাম। ওই তালিকায় প্রথমেই লেখা হয়, ‘দাবি অনুযায়ী তাদের কিছু দিতে হবে।’
জানা গেছে, এসএনসি-লাভালিনের তৎ কালীন কর্মকর্তা কানাডার নাগরিক রমেশ সাহা ওই তালিকা তৈরি করেছেন। কানাডিয়ান পুলিশ এসএনসি-লাভালিনের অফিস থেকে পদ্মাসেতু প্রকল্পের কাজকর্ম সংক্রান্ত একটি ডায়েরি জব্দ করে। কানাডায় রমেশ সাহা ও মো. ইসমাইল হোসেনকে গ্রেফতারও করেছিল সে দেশের পুলিশ। এ মুহূর্তে তারা জামিনে মুক্ত আছেন।
পদ্মাসেতু প্রকল্পে দুর্নীতির তদন্ত পর্যবেক্ষণ করতে বিশ্বব্যাংকের তিন সদস্যের বিশেষজ্ঞ দলটি রোববার বেলা ৩টা ১০ মিনিটে সেগুনাবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে আসেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সাবেক প্রধান আইনজীবী ও প্যানেলের প্রধান লুই গ্যাবরিয়েল মোরেনো ওকাম্পোর নেতৃত্বে একটি দল দুদকের অনুসন্ধান টিমের মুখোমুখি হন। দলের অপর দুই সদস্য হংকংয়ের দুর্নীতিবিরোধী স্বাধীন কমিশনের সাবেক প্রধান টিমোথি টং ও যুক্তরাজ্যের সিরিয়াস ফ্রড অফিসের সাবেক পরিচালক রিচার্ড অ্যাল্ডারম্যান।
অনুসন্ধান টিমের সঙ্গে তারা বৈঠকে বসেন সোয়া ৩টায়। বৈঠক শেষ হয় সাড়ে চারটায়।
বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে দুদকের অনুসন্ধান টিমের প্রধান আবদুল্লা-আল-জাহিদের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি দল বৈঠকে বসেন। অনুসন্ধান টিমের অপর তিন সদস্য হলেন জ্যেষ্ঠ উপ-পরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদীন শিবলী, গোলাম শাহরিয়ার চৌধুরী ও উপ-পরিচালক মির্জা জাহিদুল আলম।
শনিবার দ্বিতীয়বারের মতো ঢাকায় আসেন বিশ্বব্যাংকের তিন সদস্যের বিশেষজ্ঞ দলটি।
দুদকের প্রতিবেদনের ওপরই ২৯১ কোটি ডলারের পদ্মাসেতু প্রকল্পে বিশ্ব ব্যাংকের ১২০ কোটি ডলারের ঋণ দেওয়ার বিষয়টি নির্ভর করছে। এছাড়া এডিবি ৬১ কোটি, জাইকা ৪০ কোটি এবং ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ১৪ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার কথা।
পদ্মাসেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে গত জুনে ১২০ কোটি ডলারের ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। তবে একপর্যায়ে ‘শর্তসাপেক্ষে’ এ প্রকল্পে ফেরার ঘোষণা দেয় ঋণদাতা সংস্থাটি।
এরপরই তদন্ত পর্যবেক্ষণে প্যানেল গঠন করে তারা। ওকাম্পোর নেতৃত্বে পর্যবেক্ষকরা গত ১৪ অক্টোবর প্রথম দফা ঢাকা সফর করে দু`দফা বৈঠক করেন। জানা গেছে মঙ্গলবার বিকেলে দুদকের টিমের সঙ্গে পুনরায় বৈঠকে বসবে প্যানেল।
নিউজরুম