ঢাকা (৩১ ডিসেম্বর) : বিদায়ী বছরে ব্যাংকিং তথা সামগ্রিক অর্থনৈতিক খাত কেটেছে নানা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে। হলমার্ক কেলেঙ্কারি, ডেসটিনিসহ বিভিন্ন এমএলএম কোম্পানির প্রতারণা, ব্যাংকের পরিচালকের পদ শূন্য হওয়া, নতুন ব্যাংকের অনুমোদন, ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট, বাংলাদেশ ব্যাংক-অর্থ মন্ত্রণালয় টানাপড়েন, ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোর, ব্যাংকিং খাতে মূলধন ঘাটতি, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি ছিলো বছর জুড়ে সামগ্রিক অর্থনীতির আলোচনার কেন্দ্রে।
এসবের ফলে ২০১২ সালের অর্থনীতি নানা ঝুঁকির মোকাবেলা করেছে। তবে এতো সব ঝুঁকির মধ্যে প্রবাসী আয় বৃদ্ধি, শেষ দিকে মূল্যস্ফীতির নিম্নমুখী প্রবণতা, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিসহ অর্থনীতির সূচকের বেশ কিছু ইতিবাচক প্রবৃদ্ধিও ছিলো।
ইতিবাচক ধারায় অর্থনীতি
বিদায়ী বছরে প্রবাসী আয় (রেমিটেন্স) বৃদ্ধি পেয়েছে ১০.২৪ শতাংশ। প্রায় ১২.৮৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক রেমিটেন্স এ বছর অফিসিয়াল চ্যানেলের মাধ্যমে এসেছে, যা যা এযাবত কালের রেকর্ড পরিমাণ। আন-অফিসিয়াল চ্যানেলের মাধ্যমে এসেছে দ্বিগুণের বেশি রেমিটেন্স।
সর্বশেষ তথ্য মতে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ১২ বিলিয়ন ডলারের (এক হাজার ২শ’ কোটি) ওপরে অবস্থান করছে। এটি সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বজুড়ে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় মূল্যে চরম অস্থিরতা বিরাজ করা সত্বেও অভ্যন্তরীণ বৈদেশিক মুদ্রাবাজারকে স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করছে। এ কারণে এক বছরের ব্যবধানে ডলারের দাম ৪ টাকা কমে যায়।
বছরের শেষ দিকে এসে মূল্যস্ফীতির নিম্নমুখী প্রবণতা আশা যুগিয়েছে। ২০১২ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি ২ অংকের ওপরে ছিল। এরপর থেকে তা কমতে থাকে এবং বর্তমানে রয়েছে ১ অংকের নিচে। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ শতাংশের মতো।
এ বছর কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৬.২১ শতাংশ। মোট দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধির হারও ছিল ৬ শতাংশের ওপরে।
এছাড়া বিদায়ী বছরে অর্থনীতির সূচকের আরও বেশ কিছু ইতিবাচক প্রবৃদ্ধিও ছিলো।
হলমার্ক কেলেঙ্কারি
২০১২ সালে ব্যাংকিং খাতে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল, সোনালী ব্যাংকের একটি শাখা থেকে হলমার্ক গ্রæপের জালিয়াতির মাধ্যমে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা তুলে নেওয়ার ঘটনা। সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা হোটেল শাখা থেকে ভুয়া ঋণপত্র বিলের মাধ্যমে দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় হলমার্ক।
এ ঘটনার সঙ্গে ব্যাংকটির কর্মকর্তা ছাড়াও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের লোকজন জড়িত থাকার বিষয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ডা. মোদাচ্ছের আলীর নামও উঠে আসে অভিযোগের তালিকায়। দুদক তাকে এ নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করে। আলোচিত এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের তালিকা থেকে বাদ যাননি সোনালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ূন কবিরও।
এ ঘটনার পর নানা সমস্যার মুখে পড়ে দেশের ব্যাংকিংখাত। ঋণপত্র খুলতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অতি সতর্কতার কারণে এখনও ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা রয়েছে।
শুধু এ ঘটনাই নয়, হলমার্কসহ ব্যাংকিং খাতে দুই বছরের ১০ হাজার কোটি টাকার জালিয়াতির ঘটনা বের হয়ে আসে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব ঘটনায় শক্তিশালী অবস্থান নেয়। বিশেষ করে হলমার্কের ঘটনা বের হয়ে আসার পর সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনের সুপারিশ করে আগস্ট মাসে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি লেখে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ঘটনা নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের টানাপড়েনও ছিল আলোচনায়।
তবে শেষ পর্যন্ত হলমার্ক জালিয়াতি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আটক হন হলমার্কের এমডি তানভীর মাহমুদসহ সংশ্লিষ্টরা। তবে অভিযোগের তীরের মুখে থাকা সোনালী ব্যাংকের পরিচালকরা রেহাই পেয়ে যান। তাদেরকে দুদক কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদ করলেও মামলায় তাদের অভিযুক্ত করা হয়নি।
রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের অনিয়ম ও পরিচালক শূন্যতা
হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর একে একে জনতা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ব বাণিজ্যিক এবং বিশেষায়িত আরো কয়েকটি ব্যাংকের অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে আসতে থাকে। অন্যদিকে এসব ঘটনার মধ্যেই রাষ্ট্রায়ত্ব সোনালী, অগ্রণী ও জনতা ব্যাংকের ২৯ পরিচালকের পদ শূন্য হয়।
তিন মাস পরিচালক শূন্য থাকার পর রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোতে আবারও সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালক নিয়োগ করে। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর শূন্য পরিচালক পদেও পরিচালক নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়।
ডেসিটিনির প্রতারণা
বিদায়ী বছরে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানি ডেসটিনি গ্রুপের অর্থপাচার (মানিলন্ডারিং) সংক্রান্ত প্রতিবেদন তৈরি করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইনান্সিয়াল ইন্টালিজেন্ট ইউনিট। পরে এ ঘটনায় মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদক এ নিয়ে মামলা করে।
মামলার পরে আটক করা হয় ডেসটিনি গ্রুপের শীর্ষ কর্তাদের। অন্যদিকে, সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামেন ডেসটিনির কর্মীরা। তবে তারা বেশি অগ্রসর হতে পারেননি। ডেসটিনিতে প্রশাসক নিয়োগ নিয়োগ দেওয়ার সিদান্ত নেয় সরকার। তবে বিদায়ী বছরে এর কোনো সুরাহা করতে পারেনি সরকার। বছর শেষে এসেও ঝুলেই রয়েছে ডেসটিরি বিষয়টি।
নতুন ব্যাংক
বিদায়ী বছরে আলোচিত ছিল, নতুন নয় ব্যাংকের অনুমোদন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর, সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসসহ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরাও নতুন ব্যাংকের আবেদন করেছিলেন।
এপ্রিলে দেশীয় মালিকানায় ৬টি আর প্রবাসী বাংলাদেশিদের মালিকানায় ৩টিসহ মোট ৯টি ব্যাংকের অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ বিশ্ব ব্যাংক এর বিপক্ষে ছিলো। কিন্তু অর্থমন্ত্রী একাধিকবার বলেন, নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়ার সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক।
গত সেপ্টেম্বর মাসে নতুন অনুমোদিত নয় ব্যাংককে লেটার অব ইনটেন (এলওআই) দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে সাত ব্যাংকের নথিপত্র জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) যাচাই-বাছাই শুরু করে। তবে নতুন ওই ব্যাংকগুলোর মুলধনের টাকা জোগাড় করতে উদ্যোক্তারা পরিচালক খুঁজতে থাকেন। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকা অবস্থায় মহীউদ্দীন খান আলমগীরের ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
ব্যাংকিং খাত
বিদায়ী বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে বেশিরভাগ বাণিজ্যিক ব্যাংক মুনাফা করতে পারেনি। ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যায় সাত হাজার কোটি টাকা। ফলে মূলধন ঘাটতি দেখা দেয় ৭ বাণিজ্যিক ব্যাংকের। হলমার্ক কেলেঙ্কারির কারণে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বাড়ে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। আর তারল্য সংকট ছিলো দৃশ্যমান।
এসবের প্রতিক্রিয়ায় বেড়ে যায় ব্যাংকের সুদের হার। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র বিদায়ী সভাপতি একে আজাদ বছরজুড়ে বলতে থাকেন, তারল্য সংকটে তারা ঋণ পাচ্ছেন না।
তারল্য সংকট মেটাতে ব্যাংকগুলো আন্ত:ব্যাংকিং কলমানি বাজারের দারস্থ হয়। প্রতিদিন কলমানি বাজারে গড়ে লেনদেন হয় ছয় হাজার কোটি টাকা। দীর্ঘ দিন ধরে কলমানি সুদের হার ১২ শতাংশের নিচে থাকলেও ডিসেম্বর মাসে কলমানি সুদের হার ১৪ শতাংশে উঠে যায়। ২৩টি প্রাইমারি ডিলার ব্যাংক বিশেষ রেপোর মাধ্যমেও তারল্য সহায়তা নিতে থাকে। গড়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এসব ব্যাংককে সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা তারল্য সহায়তা প্রদান করে।
অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরতে বাজার থেকে অতিরিক্ত তারল্য উত্তোলনের জন্য ৩০ দিন মেয়াদী ‘বাংলাদেশ ব্যাংক বিল’ প্রবর্তন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মাধ্যমে ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকা তুলে নেয়।
ডলার পরিস্থিতি
ডলারের দাম স্থিতিশীল রাখা, প্রবাসীদের বৈধপথে রেমিটেন্স পাঠাতে উৎসাহ প্রদান ও রফতানিকারকদের প্রণোদনা দিতে এ বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংক পর্যাপ্ত পরিমান ডলার কিনে নেয়। রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোতে মজুদ হতে থাকে ডলার। এ কারণে এক বছরের ব্যবধানে ডলারের দাম ৪ টাকা কমে যায়। খেলাপি ঋণ আদায় কম হওয়া, প্রাইমারি ব্যাংকগুলোর সরকারি বন্ডে অতিরিক্ত ২১ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের কারণে বেসরকারিখাতে ঋণ প্রবাহও কমে যায়। তবে সরকারের ঋণের স্থিতি ডিসেম্বর মাসে এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।
বিদায়ী বছরে জুন মাসে খেলাপি ঋণ ও প্রভিশনিংয়ের নতুন নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে খেলাপি ঋণ পুন:তফসিলের সময় কমিয়ে আনার কারণে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। নতুন নীতিমালায় ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ৪ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। পরে আগস্ট মাস পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক এ নীতিমালার চার দফা ব্যাখ্যা দেয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক-অর্থমন্ত্রী টানাপড়েন
হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ২৭ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতকে। চিঠিতে এ ঋণ জালিয়াতির জন্য তিনি সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকে দায়ী করেন। একই সঙ্গে আরেকটি চিঠি দিয়ে সোনালী ব্যাংকের এমডিসহ দায়ী ৩১ কর্মকর্তাকে বহিস্কার করতে বলেন।
তবে অর্থমন্ত্রী ২৯ আগস্ট এক অনুষ্ঠানে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এটি করতে পারে না। বিষয়টি নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে। তবে হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনা সঠিক সময়ে কেন বাংলাদেশ ব্যাংক সনাক্ত করতে পারেনি, তার জন্য তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকির ব্যর্থতার কথাও বলেন। অন্যদিকে বিশিষ্টজনেরা হলমার্ক কেলেঙ্কারি বের হওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্বশাসনের কথা তোলেন। তারা প্রয়োজনে ব্যাংক কোম্পানি আইনের আবারো সংশোধনের অভিমত দেন।
নিউজরুম