বিনোদন ডেস্ক (৩১ডিসেম্বর): চলে গেলেন দেশের বিশিষ্ট নজরুলসঙ্গীত ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের খ্যাতিমান শিল্পী সোহরাব হোসেন। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তিনি স্ত্রী সুরাতন নেসা, দুই ছেলেÑ মোয়াজ্জেম হোসেন ও মারুফ হোসেন, তিন মেয়েÑ রওশন আরা সোমা, রাহাত আরা গীতি ও রিফাত আরা রীতা এবং অসংখ্য ছাত্রছাত্রী, ভক্ত ও শুভানুধ্যায়ী রেখে গেছেন। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘ দিন বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন এই গুণী শিল্পী। গত ২৮ নভেম্বর হঠাৎ ঘাড়ে ব্যথা অনুভব করেন। ব্যথা বেড়ে যাওয়ায় ২৯ নভেম্বর তাকে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার মূত্রথলিতে সংক্রমণ ছাড়াও কান, কিডনি, হৃদযন্ত্রসহ বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন সমস্যা ধরা পড়ে। পরিবারের সবাই ভেবেছিলেন হয়তো এ যাত্রায় সুস্থ হয়ে তিনি বাসায় ফিরবেন। সেভাবেই চিকিৎসা চলছিল তার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবাইকে কাঁদিয়ে পরপারেই পাড়ি জমালেন তিনি। ১৯২২ সালের ৯ এপ্রিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার রানাঘাটের কাছে আয়েশতলা গ্রামে জন্ম সোহরাব হোসেনের। ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি ছিল তার আগ্রহ। মাত্র নয় বছর বয়সে রানাঘাটের সঙ্গীতশিক জয়নুল আবেদীনের কাছে তার গান শেখা শুরু। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় তৎকালীন জমিদার ীরোদ পাল চৌধুরীর নজরে পড়েন। জমিদার তাকে কিরণ দে চৌধুরী নামে এক শিকের কাছে গান শেখার ব্যবস্থা করে দেন। চূর্ণি নদী পার হয়ে তিনি গান শিখতে যেতেন। এ ছাড়া নজরুল সঙ্গীতশিল্পী পূরবী দত্তের বাড়িতে তিনি গান শুনতে যেতেন। গানের প্রতি এই বরেণ্য শিল্পীর এমনই আকর্ষণ ছিল যে, গ্রামোফোন রেকর্ডে কোনো গান শুনলেই তিনি তাৎণিক তা গলায় তুলে নিতেন। পরিবারের লোকজন তার সঙ্গীতপ্রীতির বিষয়টি ভালোভাবে দেখতেন না। এ কারণে তার পড়ালেখা বন্ধ করে দিয়ে তাকে ব্যবসায়ে নামিয়ে দেয়া হয়। তার শিক কিরণ দে চৌধুরীর মাধ্যমে পরে কলকাতায় গিয়ে শ্রীরঙ্গম থিয়েটারে মাসে ১২ আনা বেতনে গান গাওয়ার কাজ পান। সোহরাব হোসেন কলকাতায় ইন্দুবালা, গিরীশ চক্রবর্তী, কৃষ্ণচন্দ্র দের মতো বিশিষ্ট শিল্পীর সাহচর্যে আসেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ঢাকায় চলে আসেন সোহরাব হোসেন। তিনি আব্বাসউদ্দীন আহমদের মাধ্যমে ৪১ জিন্দাবাজার লেনের একটি বাড়িতে ওঠেন। চাকরি পান তথ্য বিভাগে। এ ছাড়া তিনি নিয়মিত রেডিওতে অনুষ্ঠান করতেন এবং শিার্থীদের তালিম দিতেন। ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ, শিল্পী শচীন দেববর্মণ ও অঞ্জলি মুখার্জির সাথে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। তিনি আব্বাসউদ্দীনের সাথে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরেছেন, গান গেয়েছেন। চলচ্চিত্রেও তিনি প্লেব্যাক করেছেন। রবিন ঘোষের সুরে তিনি এহতেশাম পরিচালিত রাজধানীর বুকে ছবিতে প্লেব্যাক করেন। আরো উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হলোÑ মাটির পাহাড়, যে নদী মরু পথে, গোধূলির প্রেম, শীত বিকেল ও এ দেশ তোমার আমার। অভিনয়েও পারদর্শী ছিলেন সোহরাব হোসেন। তুলসী লাহিড়ীর ছেঁড়া তার নাটকে অভিনয় করে দর্শকনন্দিত হন তিনি। দেশের অনেক জনপ্রিয় ও গুণী শিল্পী তার কাছে সঙ্গীতে তালিম নেন। তার শিার্থীদের মধ্যে সঙ্গীতজ্ঞ ড. সন্জীদা খাতুন, শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল, আতিকুল ইসলাম, সাদিয়া মল্লিক প্রমুখ। নজরুলসঙ্গীতে অনবদ্য অবদানের জন্য সোহরাব হোসেন স্বাধীনতা পদক, মেরিল–প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা, নজরুল একাডেমি পদক, চ্যানেল আই পদকসহ অসংখ্য সম্মাননা পেয়েছেন। ২০০৯ সালে শিল্পী সোহরাব হোসেন নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় সম্মাননা লাভ করেন। বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকেই তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। বুলবুল ললিতকলা অ্যাকাডেমি, ছায়ানট, শিল্পকলা একাডেমী ও নজরুল অ্যাকাডেমিতে দীর্ঘ দিন শিকতা করেন। নজরুল ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব সোহরাব হোসেনকে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও চোখের জলে চিরবিদায় জানান তার পরিবার, আত্মীয়স্বজন, ভক্ত–শুভাকাক্সীরা। শুক্রবার সকালে তার লাশ শ্রদ্ধানিবেদনের জন্য নেয়া হয় ছায়ানট প্রাঙ্গণে, যেখানে দীর্ঘ দিন শিকতা করেন তিনি। এরপর সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধানিবেদনের জন্য তার লাশ নিয়ে যাওয়া হয় জাতীয় শহীদ মিনারে। সেখানে রাখা হয় বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত। এ সময় তাকে শেষ ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তার ভক্ত, শ্রোতা, শুভাকাক্সীসহ সর্বস্তরের মানুষ। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর প থেকে জানানো হয় ফুলেল শ্রদ্ধা। এর মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী সুধীন দাস, রথীন্দ্রনাথ দত্ত, ফকির আলমগীর, নাট্যব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর, রামেন্দু মজুমদার, ম. হামিদ কামাল লোহানী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকসহ নজরুলসঙ্গীতশিল্পী, সাংস্কৃতিক সংগঠন, রাজনীতিবিদ ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বরা। এ সময় আসাদুজ্জামান নূর বলেন, সোহরাব হোসেন একজনই। এ রকম উচ্চপর্যায়ের শাস্ত্রীয় ও নজরুলসঙ্গীত ব্যক্তিত্ব পৃথিবীতে বিরল। তার মৃত্যুতে যে তি হয়ে গেল সঙ্গীত তথা সাংস্কৃতিক জগতের, সেটা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। তার আত্মার শান্তি কামনা করছি। তিনি যেন ওপারে গিয়েও ভালো থাকেন সেই প্রার্থনাই করি।
রথীন্দ্রনাথ দত্ত বলেন, সোহরাব হোসেন ছিলেন আমাদের দেশের অনেক বড় সম্পদ। তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হন। তরুণ প্রজন্মকে আরো অনেক কিছু দেয়ার ছিল। তার এই চলে যাওয়া কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। খুব খারাপ লাগছে আজ। তার আত্মার শান্তি কামনা করছি। এ দিকে শহীদ মিনারে সর্বস্তরের শ্রদ্ধানিবেদনের পর বাদ জুমা সোহরাব হোসেনের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয় মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোড মসজিদে। এরপর তার লাশ নেয়া হয় মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে। সেখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত হন সবার প্রিয় সোহরাব হোসেন। কিন্তু রেখে গেলেন শাস্ত্রীয় ও নজরুলসঙ্গীতের এক অপূর্ণ ভাণ্ডার।
নিউজরুম