ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি নিঃশেষ করছে দুর্নীতি

0
451
Print Friendly, PDF & Email
তারিখ: ৩০ ডিসেম্বর, ২০১২

দুর্নীতিবিরোধী নজরদারি প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-এর (টিআইবি) এক প্রতিবেদন অনুসারে দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ খাতে দুর্নীতির ব্যাপকতা উদ্বেগজনকপর্যায়ে পৌঁছেছে। ঘুষ আদায়ের হার বেড়েছে আগের চেয়ে। সেবা পেতে দেশের ৫৩ দশমিক ৩ শতাংশ খানাকে (এক বাসায় থাকা ও খাওয়া পরিবার) কোনো-না-কোনো খাতে নিয়মবহির্ভূত অর্থ দিতে হয়েছে। আর কোনো-না-কোনোভাবে দুর্নীতির শিকার হচ্ছে দেশের ৬৩ দশমিক ৭ শতাংশ সেবা গ্রহণকারী। এবারের জরিপ সময়ে সেবা খাতে সার্বিক দুর্নীতির ঘটনা কমলেও পরিমাণ ২০১০ সালের ৯ হাজার ৫৯১ কোটি ৬০ লাখ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ৯৫৫ কোটি ৬০ লাখ টাকায়। এ বছর সেবা খাতের মধ্যে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে শ্রম ও অভিবাসন খাত (৭৭ শতাংশ)। এর পরেই আছে আইনশৃঙ্খলা রাকারী সংস্থা (৭৫.৮ শতাংশ), ভূমি প্রশাসন (৫৯ শতাংশ), বিচারিক সেবা (৫৭.১ শতাংশ), স্বাস্থ্য (৪০.২ শতাংশ), শিা (৪০.১ শতাংশ) ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান (৩০.৯ শতাংশ)। টিআইবির বক্তব্য অনুসারে, দুর্নীতির ঘটনা কমলেও এর অঙ্ক বাড়ায় এ নিয়ে ‘আত্মতুষ্টি’র অবকাশ নেই। আইনশৃঙ্খলা রাকারী সংস্থা, ভূমি প্রশাসন, বিচারিক সেবা, স্বাস্থ্য, শিা ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান খাতের দুর্নীতির ফলে মানুষের হয়রানির অভিজ্ঞতা এখনো সবচেয়ে বেশি। বেশি আয়ের মানুষ বেশি খাতের সেবা নেয় বলে ধনীদের দুর্নীতির শিকার হওয়ার প্রবণতাও বেশি। তবে দরিদ্রদের ওপর দুর্নীতির আপেকি ব্যয় বেশি। যেসব খানার মাসিক আয় ১৬ হাজার টাকার নিচে, তারা যেখানে বার্ষিক ব্যয়ের ৫ দশমিক ৫ শতাংশ ঘুষ দেয় সেখানে মাসিক আয় যাদের ৬৪ হাজার টাকার ওপরে তারা দেয় বার্ষিক ব্যয়ের ১ শতাংশ।

টিআইবির দুর্নীতির সর্বশেষ জরিপ নানা কারণে উদ্বেগজনক। এবার অবস্থার উন্নয়নে সেবা খাতের দুর্নীতির সংখ্যা কমার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এর পরিমাণ আড়াই গুণ বেড়ে যাওয়া থেকে বুঝা যাচ্ছে দুর্নীতিগ্রস্তরা এখন মোটা অঙ্কের ঘুষ নিচ্ছে। ঘুষের অঙ্ক ছোট হোক বা বড় হোক, তা ১০ জনের কাছ থেকে নেয়া হোক অথবা ১০০ জনের কাছ থেকে নেয়া হোক, এর শিকার দেশের সব মানুষকেই হতে হয়। একজন ব্যবসায়ী ঘুষ দিয়ে যে কাজ করেন সেটি তার ব্যবসায়ের ব্যয়ের সাথে যুক্ত করে ভোক্তাদের কাছ থেকে আদায় করে নেন। যে ঠিকাদার কাজ বা বিল পাওয়ার জন্য ঘুষ দেন, তিনি রাস্তার কাজ নিম্নমানের করে তার মুনাফা ঠিক রাখেন। এতে তিন বছরের রাস্তা ছয় মাসে ভেঙে যায়। দুর্নীতির মূল্য যে কতভাবে দিতে হচ্ছে তার একটি নমুনা হচ্ছে পদ্মা সেতু। এর পরামর্শক কাজের ৩৮ কোটি টাকা ক্ষমতাধরেরা ভাগাভাগি করতে গিয়ে ইতোমধ্যে এর সম্ভাব্য ব্যয় বেড়েছে চার হাজার কোটি টাকা। আর দুর্নীতি যখন কোনো সেবাপ্রাপ্তির শর্ত হয়ে যায় তখন এর নির্মম শিকার হয় দরিদ্র জনগোষ্ঠী। তারা বাড়তি টাকা গুনতে পারে না বলে আইনানুগ সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। দুর্নীতির সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হলো কাঠের ঘুণ। কাঠে ঘুণ ধরলে চমৎকার ফার্নিচারও তার আয়ু হারায়। দুর্নীতি যখন সর্বব্যাপী হয়ে পড়ে তখন জাতির ভেতরের যে অন্তর্নিহিত শক্তি সেটি ক্রমে নিঃশেষ হয়ে যায়। অথচ বিশ্ব জানে বাংলাদেশের মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো যেকোনো বৈরী পরিস্থিতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা।

আমরা মনে করি, দুর্নীতির যারা সুবিধাভোগী তারা সমাজের ক্ষমতাধর মানুষের একটি ুদ্র অংশ যারা নিজেদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবহার করে দেশে বিশাল জনগোষ্ঠীকে পণবন্দী করে নিজেদের মোটাতাজা করেন। এসব মোটাতাজা মানুষও যে আখেরে শান্তি পান এমন নয়। তাদের অবস্থা হয় নাদুশনুদুশ মোটাতাজা গরুর মতো। তাদের শান্তি বেশি দিন থাকে না। রাষ্ট্রের সব পর্যায় থেকে অন্যায্য ঘুষ দুর্নীতির মাধ্যমে মোটাতাজা হওয়ার এই সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। আর ওপরতলার দুর্নীতি যেহেতু মহামারীর মতো নিচের দিকে ছড়ায় তাই ওপরতলাকে আগে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। তা না হলে দেশ হিসেবে আমাদের উন্নতি-অগ্রগতি বারবার মুখথুবড়ে পড়বে। এটি কেউই আমরা কামনা করতে পারি না।

শেয়ার করুন