ঢাকা (৩০ ডিসেম্বর) : পরাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, যুদ্ধাপরাধে দোষী কোনো ব্যক্তির শাস্তি মওকুফের সুপারিশ বাংলাদেশের পক্ষে মেনে নেওয়া হবে না। কারণ, এটি সারা দেশের জনগণের দাবি এবং এটি একটি সংবেদনশীল বিষয়।
রোববার বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তার নিজ কক্ষে যুদ্ধাপরাধে দোষী ব্যক্তিদের ক্ষমা করার অনুরোধ জানিয়ে সরকারকে তুরস্কের রাষ্ট্রপতির পাঠানো চিঠি প্রসঙ্গে সাংবাদিকরা তার কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চান। জবাবে তিনি একথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘‘তুরস্ক তাদের দেশেও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। আর বাংলাদেশে এ বিচার প্রচলিত আইনেই আমরা করছি।’’
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুল গত ২৩ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানকে তুর্কি ভাষায় (সঙ্গে ইংরেজি অনুবাদ) এক পৃষ্ঠার একটি চিঠিতে যুদ্ধাপরাধে গোলাম আযমসহ যাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে তাদের ক্ষমা করে দেওয়ার আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও একই চিঠি পাঠান প্রেসিডেন্ট গুল।
চিঠিতে গুল লিখেছেন, গোলাম আযমের বয়স ৯০ বছরের ওপরে এবং যাদের বিচার করা হচ্ছে তাদের অধিকাংশই প্রবীণ। তিনি গোলাম আযমসহ অভিযুক্ত অন্য সব জামায়াত নেতাকে মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই দেওয়ার আহ্বান জানান।
গুল আরও লেখেন, যুদ্ধাপরাধের বিচারে অভিযুক্তদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিলে তা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, এটি কূটনৈতিক নীতিমালায় একটি অন্যায্য আবদার। ঢাকা এ বিষয়ে আঙ্কারার ওপর বেশ ক্ষুদ্ধ। যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে তুরস্কের মতো দেশের এ ধরনের অভিযুক্তদের পক্ষ নিয়ে সরাসরি সুপারিশ কূটনৈতিক ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করেছে।
সরকারের পক্ষে যুদ্ধাপরাধের বিচার করা একটি নির্বাচনী অঙ্গীকার। এ থেকে পিছিয়ে আসার কোনো কারণ নেই। তাছাড়া এখনও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে কারো শাস্তি আদালত ঘোষণা করেননি। কিন্তু রায় ঘোষণার আগে তুরস্কের প্রেসিডেন্টের এ ধরনের চিঠি লেখা বিচার কার্যক্রমকে ব্যাহত করার এক প্রকার প্রচেষ্টা বলে মনে করা হচ্ছে।
এছাড়া তুরস্কের ক্যানসুয়ু এইড অ্যান্ড সলিডারিটি অ্যাসোসিয়েশনের ১৪ সদস্যের একটি ‘এনজিও’ প্রতিনিধিদল সম্প্রতি অন-অ্যারাইভ্যাল ভিসা (আগমন-পরবর্তী ভিসা) নিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে লবিং করতে বাংলাদেশে এসেছিলেন। প্রতিনিধি দলটি পাঁচ দিনের বাংলাদেশ সফরে এসে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেন এবং বিচার-সংক্রান্ত বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। তারা মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও বিরোধী দলের একজন শীর্ষ নেতার সঙ্গেও বৈঠক করেন। তারা তুর্কি সরকারের মদদপুষ্ট একটি এনজিও। ওই দলের নেতৃত্বে ছিলেন তুরস্কের একজন সাবেক প্রতিমন্ত্রী। এছাড়া ছিলেন সাবেক এমপি, রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী।
আঙ্কারার বাংলাদেশ দূতাবাস পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে, এ প্রতিনিধি দলের বাংলাদেশ সফর সম্পর্কে তারা কিছুই জানে না। শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে তারা `অন অ্যারাইভাল ভিসা` নিয়েছেন।
আসামিপক্ষ লবিং করে তুরস্কের এই এনজিও প্রতিনিধি দলের সফরের আয়োজন করেছেন বলে মনে করা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট গুলের চিঠির পর এটি স্পষ্ট হয়েছে যে, তুরস্ক জেনে-শুনেই এ প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছিল।
এরপরই ২৫ ডিসেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘তাদের সঙ্গে আমাদের ভিসা সংক্রান্ত যে চুক্তি রয়েছে, সে বিশেষ ক্যাটাগরির পাসপোর্ট বাহকরা অন-অ্যারাইভ্যাল ভিসা পান। সেই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে তারা এমন একটি কাজ করেছেন, যা সঠিক কাজ নয়।’’
সূত্র জানায়, এ ধরনের কর্মকাণ্ড সরকার সিরিয়াসভাবে নিয়েছে। তুরস্কের এসব তৎপরতাকে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ‘হস্তক্ষেপ’ বলে মনে করছে। এ কারণে বাতিল করা হতে পারে দুই দেশের মধ্যে অন অ্যারাইভ্যাল ভিসার সুবিধা। ২০০৯ সাল থেকে ঢাকা এ ধরনের ভিসার প্রস্তাব দিলে চলতি বছরের মাঝামাঝি এটি অনুমোদন করে আঙ্কারা।
গত ২৬ ডিসেম্বর ঢাকায় তুরস্কের রাষ্ট্রদূত মেহমুত ভারকুল ইরকুলকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে সে দেশের প্রতিনিধি দলের সফরকালে অস্বাভাবিক তৎপরতায় জড়িয়ে পড়ার বিষয়ে সরকারের অসন্তুষ্টির কথা জানিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া তুরস্কের প্রেসিডেন্টের লেখা চিঠি সম্পর্কেও তার কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়।
রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে তুরস্ককে এ বিষয়ে চিঠিও পাঠায় বাংলাদেশ। চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘‘কূটনৈতিক শিষ্টাচারের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোনো রকম আগাম সংবাদ না দিয়েই তুরস্কের এনজিও প্রতিনিধিদলের ঢাকায় আগমন বাংলাদেশের কাছে ‘অসৌজন্যমূলক’ মনে কহয়েছে। রাজধানীতে পাঁচ দিনের অবস্থানে প্রতিনিধিদলটি অস্বাভাবিক তৎপরতায় জড়িয়ে পড়েন। ঢাকায় তুরস্কের দূতাবাসও সার্বক্ষণিকভাবে তাদের সব কর্মসূচিতে অংশ নেন। দূতাবাসের এ ভূমিকা অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক। তাই পুরো বিষয়টিতে তুরস্কের সরকারের ভূমিকা নিয়ে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।’’
বাংলাদেশের চিঠিতে আরো বলা হয়, ‘‘এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ কঠোর ভাষায় বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র তুরস্কের এ ধরনের তৎপরতার নিন্দা জানায়। দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অব্যাহত রাখার স্বার্থে ভবিষ্যতে এ ধরনের অপ্রত্যাশিত তৎপরতা রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয় চিঠিতে।’’
এর পাল্টা হিসেবে পরদিন আঙ্কারায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জুলফিকার রহমানকে তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়। তাকে তুরস্কের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন সে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ওমর অনহুন।
সব মিলিয়ে এ নিয়ে ঢাকা-আঙ্কারার মধ্যে কূটনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে।
নিউজরুম