চট্টগ্রাম (৩০ ডিসেম্বর) : যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, বিদেশি মেহমানদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপসহ নানা বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক বলেছেন, ‘জাতির কণ্ঠস্বর, বিবেকের কণ্ঠস্বর এবং ইতিহাসের নির্মাতা হিসেবে সাংবাদিকদের ওপর অনেক বড় দায়িত্ব এসেছে। বহুযুগে এত বড় দায়িত্ব বর্তায়নি। সামনে রাত্রি না দিন এটা নির্ভর করবে সাংবাদিকদের ওপর। রাজনীতি যারা করে তাদের ওপর আমি ভরসা রাখি না, ভরসা করি কলমের ওপর।’
রোববার দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
সাংবাদিকতাকে পৃথিবীর অত্যন্ত প্রাচীনতম পেশা আখ্যা দিয়ে সৈয়দ শামসুল হক বলেন, ‘সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতা উত্তম বলে আমিও মনে করি। সত্যকে নানা দিক থেকে দেখা যায়। একটি দুর্ঘটনার ১০ জন প্রত্যক্ষদর্শী ১০ রকম ভাষ্য দেন। কিন্তু এটা সত্য দুর্ঘটনা একটা ঘটেছে। যেমন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের রূপ, গঠন, চরিত্র নিয়ে একেক মহলের একেক রকম দৃষ্টিভঙ্গি। সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতার ভেতরও একটি দৃষ্টিভঙ্গি দৃষ্টিকোণ থাকে।’
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের চেষ্টা সফল হবে না উল্লেখ করে সৈয়দ শামসুল হক বলেন, ‘যারা এ বিচারপ্রক্রিয়া বানচাল করছে তারা সভ্যতার মূলে আঘাত করছে। আইনের বিরুদ্ধাচরণ করছে। সভ্যতার ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা, শুভ-অশুভ এবং মূল্যবোধ নির্ণয় করে আইন। আজ যারা বিচারপ্রক্রিয়া ব্যাহত করতে চায় তারা মূল্যবোধ ও শেকড়ে আঘাত হানছে।’
তিনি বলেন, ‘অপরাধ যদি হয়ে থাকে অপরাধীকে শাস্তি দিলে মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা পায়। এ জন্যই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতেই হবে। নইলে মানুষ হিসেবে আয়নার সামনে দাঁড়াতে পারব না। মানুষ হিসেবে খর্ব থেকে খর্বাকৃতি হয়ে যাব।’
১৬ কোটি মানুষের কাছে এ বার্তা পৌঁছে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘সব সংবাদ মানুষ গ্রহণ করে না। কিন্তু আলোচনার মঞ্চ তৈরি হয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে আপনাদের কলমে নিরন্তরভাবে আসতে হবে। কারণ এভাবে চলতে থাকলে দেশের সমুখের দিনগুলো অন্ধকার হবে বলে আমার আশঙ্কা।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবিতে আন্দোলন, হরতাল, তাণ্ডব জনজীবন বিপর্যস্ত করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক দেশে এক সরকার গেলে অন্য সরকার আসে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। স্বৈরাচারের কারণে বিশ্বাসে চিড় ধরায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি চালু হয়েছিল সীমিত সময়ের জন্য। কিছু অসুস্থতার ভেতর এগোলেও তা সেরে গেছে। আমি কোনো পক্ষ নিয়ে কথা বলছি না। আমরা পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক শান্ত হতে দিচ্ছি না। কোন পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন হবে ঠিক করতে না পারলে সামনের দিনগুলোতে কী হবে আমি জানি না।’
বিদেশি মেহমানদের প্রসঙ্গ টেনে সৈয়দ শামসুল হক বলেন, ‘আশঙ্কাজনক কথা হলো, সম্মানিক কূটনীতিক যারা বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিত্ব করছে তাদের উচ্চারণ, আচরণ, আদেশ, নির্দেশ এটা আমার কাছে উদ্বেগের বিষয়। শুধু আমার নয়, শিক্ষক থেকে শুরু করে সমাজের গুরুজনরাও ভালো চোখে দেখছেন না বিষয়টা। আমার দেশ, আমার মাটি, আমার মানুষ নিয়ে বাইরের কেউ নাক গলালেও সরকার বা সরকারের বাইরের কেউ প্রশ্ন করে না।’
তিনি বলেন, ‘আমরা দাসত্ব-প্রভুত্ব ছিন্ন করেছি দাবি করি এ বিজয়ের মাসে। বিদেশি মেহমানদের শলা পরামর্শ দেওয়ার অধিকার নেই। মেহমানদের আচরণ মাত্রাতিরিক্ত শোভনতার বাইরে।’
‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি’ এ রকম দাবি না করার আহ্বান জানিয়ে সৈয়দ শামসুল হক বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের এ ধরনের দাবির বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধের একটি বিরুদ্ধ শক্তি দাঁড়ানোর সুযোগ তৈরি হয়।’
ক্লাবের ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন ক্লাব সভাপতি আবু সুফিয়ান। শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন চট্টগ্রাম সংবাদপত্র পরিষদের সভাপতি ও দৈনিক আজাদী সম্পাদক এমএ মালেক এবং চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শহীদ উল আলম।
আজাদী সম্পাদক এমএ মালেক বলেন, ‘মন্ত্রী থেকে শুরু করে অনেক বিজ্ঞজনেরাও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের উপদেশ দেন। আমরা বুঝে উঠতে পারছি না বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ কী। সংবাদ কারও পক্ষে যায় আবার কারও বিপক্ষে যায়। বস্তু সংবাদ তৈরি করে না। সংবাদ তৈরি করে মানুষ। তাই বস্তুনিষ্ঠ না হয়ে শব্দটি হওয়া দরকার সত্যনিষ্ঠ।’
ক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক মহসিন চৌধুরীর সঞ্চালনে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন সাধারণ সম্পাদক রাশেদ রউফ।
ক্লাবের পক্ষ থেকে প্রধান অতিথিকে শুভেচ্ছা স্মারক তুলে দেন সভাপতি আবু সুফিয়ান।পরে সৈয়দ শামসুল হক ক্লাবের নিজস্ব ওয়েবসাইট উদ্বোধন করেন।
বিকেল ৩টায় দ্বিতীয় অধিবেশনের কর্মসূচিতে ছিল সভাপতি নির্বাচন, বিগত বার্ষিক সাধারণ সভার কার্যবিবরণী অনুমোদন, সাধারণ সম্পাদক ও অর্থ সম্পাদকের প্রতিবেদন উপস্থাপন, আলোচনা ও অনুমোদন এবং পরবর্তী মেয়াদের জন্য নিরীক্ষক নিয়োগ। সোমবার অনুষ্ঠিত হবে দ্বিবার্ষিক নির্বাচন।
নিউজরুম