খুলনা (৩০ ডিসেম্বর) : শীর্ষ চরমপন্থি নেতাদের গ্রেফতার ও মৃত্যু এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অব্যাহত অভিযান থাকার পরও খুলনায় ২০১২ সাল ছিল আলোচিত সমালোচিত।
এবছর খুলনা জেলায় খুন হয়েছেন ৬৫ জন, ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮০ জন, নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৫শ ৪৩টি। এছাড়া নজিরবিহীন অজ্ঞাতপরিচয় লাশ উদ্ধার, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, সংঘর্ষ ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। ফলে, আতঙ্কের মধ্যে বছর পার করেছে খুলনাবাসী।
খুলনা জেলা প্রশাসনের কার্যালয় ও খুলনা জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সদস্য সচিব অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এম এম আরিফ পাশা বাংলানিউজকে জানান, খুলনা জেলার ৯ থানা ও মহানগরীর ৫ থানা এলাকায় জানুয়ারি মাসে ২ জন, ফেব্রুয়ারি মাসে ৭ জন, মার্চ মাসে ৫ জন, এপ্রিল মাসে ৩ জন, মে মাসে ৮ জন, জুন মাসে ৫ জন, জুলাই মাসে ৪ জন, আগস্ট মাসে ১০ জন, সেপ্টেম্বর মাসে ৯ জন, অক্টোবর মাসে ৭ জন, নভেম্বর মাসে ৪ জন এবং ডিসেম্বর মাসে ১ জন খুন হয়েছেন।
জেলার ৯ থানা ও মহানগরীর ৫ থানা এলাকায় ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে জানুয়ারি মাসে ৬টি, ফেব্রুয়ারি মাসে ৮টি, মার্চ মাসে ৪টি, এপ্রিল মাসে ৪টি, মে মাসে ৭টি, জুন মাসে ১৬টি, জুলাই মাসে ১১টি, আগস্ট মাসে ৩টি, সেপ্টেম্বর মাসে ২টি, অক্টোবরে ৮টি, নভেম্বরে ৮টি এবং ডিসেম্বরে ৩টি।
৯ থানা ও মহানগরীর ৫ থানা এলাকায় জানুয়ারি মাসে ৩৫টি, ফেব্রুয়ারি মাসে ৬০টি, মার্চ মাসে ৫৭টি, এপ্রিল মাসে ৪২টি, মে মাসে ৪৯টি, জুন মাসে ৬২টি, জুলাই মাসে ৬৯টি, আগস্ট মাসে ৩৬টি, সেপ্টেম্বর মাসে ৪১টি, অক্টোবর মাসে ৩৮টি, নভেম্বর মাসে ৩৩টি এবং ডিসেম্বর মাসে ২২টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।
একইভাবে গেল বছর জেলায় ১১টি ডাকাতি ও ৩৬টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে।
বিদায়ী বছরের সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও সমালোচিত ঘটনার মধ্যে ছিল ১২ মার্চে খুলনা মহানগরীর বাবু খান রোডে প্রকাশ্যে সরদার জাকির হোসেন (৫০) নামে এক ব্যবসায়ীকে সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে। রাত সাড়ে ৮টার দিকে এ হত্যার ঘটনা ঘটে।
২২ এপ্রিল বিএনপির ডাকা হরতাল চলাকালে ছাত্রদল নেতা এসএম মাহামুদুল হক টিটো ও ফেরদাউসুর রহমান মুন্নাকে সকাল ১০টায় পিটিআই মোড় থেকে পিকেটার সন্দেহে আটক করে পুলিশ।
তাদের খুলনা সদর থানায় নিয়ে যাওয়ার পর দ্বিতীয়তলায় ফ্যানের হুকের সঙ্গে দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে টিটোকে অমানুষিক নির্যাতন করেন ওসি কামরুজ্জামান। এসময় মুন্নাকেও চোখ বেঁধে মারপিট করা হয়।
নির্যাতনের ফলে টিটো কয়েকবার অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তার চিৎকারে সাংবাদিকরা সেখানে জড়ো হলে ওসি তাদের ধমক দিয়ে বের করে দেন। সংবাদ কর্মীদের দায়িত্ব পালনে বাধা দেন।
ওই নির্যাতনের ছবি সাংবাদিকরা তুললে তিনি তা প্রকাশ না করার জন্য থানার একাধিক এসআইকে বিষয়টি ’ম্যানেজের’ দায়িত্ব দেন।
কিন্তু ঘটনার কিছু সময় পরই ওসির ওই জঘন্য কর্মকা-ের ছবি ও প্রতিবেদন ‘অ্যাকশন, ওসি স্টাইল’ শিরোনামে সবার আগে বাংলানিউজে প্রকাশ হয়।
বাংলানিউজে প্রকাশের পরেই মুহূর্তের মধ্যেই সারাবিশ্বের মানুষ এ অমানবিক আচরণের বিষয়টি দেখতে পায়। এঘটনায় ওসিকে ‘ক্লোজড’ ও পরে বদলি করা হয়।
৪ মে নগরীর খানজাহান আলী থানার বালুর মাঠ এলাকায় স্কুল ছাত্রী রোকেয়া খাতুন ময়নাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়।
ঘটনার দিন রাত ৮ টায় কেডিএর বালুর মাঠ এলাকা থেকে নাজির মুন্সির মেয়ে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্রী রোকেয়া খাতুন ময়নাকে কয়েক লম্পট অপহরণ করে।
পরের দিন সকাল ৬টায় পাশের একটি আম গাছের সঙ্গে তার অর্ধ উলঙ্গ ঝুলন্ত লাশ পাওয়া যায়। তার শরীরে ক্ষত এবং দাগের চিহ্ন দেখা যায়।
১৪ মে খুলনার খান জাহান আলী থানার ফুলতলা উপজেলার আটরা গিলাতলা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মঞ্জিল শিকদার (৩৫) সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন।
ঘটনার দিন রাত সাড়ে ১০টায় মঞ্জিল শিকদার স্থানীয় বাজার থেকে মোটরসাইকেলে করে বাড়ি ফেরার পথে শ্রীনাথ স্কুল মাঠের কাছে মাত্তনডাঙ্গা এডিএম যুব সংঘের মোড়ে এলে ওঁত পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি করে।
১৭ মে ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণের দাবিতে নগরীর দৌলতপুরের পাট রফতানিকারক আলাউদ্দিন হাওলাদারের ছেলে আল মাসুদ পরশকে অপহরণের ঘটনা ঘটে।
খুলনা পাবলিক কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল সে। তাকে অপহরণের মাত্র দুদিন পর হত্যা করা হয়।
হত্যার জন্য তার চোখ-মুখে সুপার গ্লু এবং প্লাস্টিক টেপ লাগিয়ে দেওয়া হয়। সে কারণে পরশ শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। পরে ঘটনা ধামাচাপা দিতে তার লাশ সিমেন্ট-বালু-খোয়া দিয়ে তৈরি ব্লকের সঙ্গে বেঁধে বস্তায় ভরে নদীতে ডুবিয়ে দেওয়ায় লাশ বীভৎস্য হয়ে যায়। ফলে, লাশ উদ্ধার হলেও তাকে শনাক্ত করা যায়নি।
ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী জামাল হোসেন ওরফে ‘ডন মামা’, ফিরোজ গাজী ও পরশের সৎ মামা সাইফুল ইসলাম বাবু ৩১ মে বৃহস্পতিবার গ্রেফতার হওয়ার পর পুলিশের কাছে এসব ঘটনার স্বীকারোক্তি দেন।
২০ মে সন্ত্রাসীদের গুলি ও বোমা হামলায় বাংলাদেশ দলিল লেখক সমিতির যুগ্ম মহাসচিব খান মোহাম্মদ জাকির হোসেন (৫২) নিহত হন।
ওই দিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে খান মোহাম্মদ জাকির হোসেন কেসিসি মার্কেটে তার অফিসের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। এ সময় ৪/৫ জনের একটি গ্রুপ তাকে লক্ষ করে প্রথমে গুলি চালায়। গুলিটি তার পিঠে লাগলে তিনি মাটিতে পড়ে যান।
এসময় সন্ত্রাসীরা একটি বোমা নিক্ষেপ করে। বোমাটি বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হলে এলাকার মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। পরে তারা পালিয়ে যাওয়ার সময় মার্কেটের সামনের রাস্তায় আরও একটি বোমা নিক্ষেপ করে। কয়েক ঘণ্টা পর জাকির হাসপাতালে মারা যান।
২০ আগস্ট ঈদুল ফিতরের নামাজ পড়ে বাড়ি ফেরার পথে খুলনার দিঘলিয়া থানা বিএনপির ধর্মবিষয়ক স¤পাদক অলিয়ার রহমানকে (৫০) পদ্মাগ্রামে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
৪ সেপ্টেম্বর খুলনার খানজাহান আলী থানা সংলগ্ন গিলাতলা এলাকার আল আমীনের বাড়িতে নির্মাণাধীন সেপটিক ট্যাংকে পড়ে সাইফুল (২৫), শহিদুল (২২) ও সারোয়ার (২৪) নামে ৩ শ্রমিকের মৃত্যু হয়।
একই দিনে খুলনায় সড়ক দুর্ঘটনায় মহিউদ্দিন (৪০) ও লাভলী ইয়াসমিন (৩৫) নামে এক দম্পতি নিহত হন। তারা দু’জনই খুলনা ওয়াসার কর্মী।
ঘটনার দিন মঙ্গলবার সকাল ৯টায় খুলনা বেতার কেন্দ্রের সামনে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
২৩ অক্টোবর সকাল ১১টার দিকে খুলনা নগরীর খানজাহান আলী থানার যোগীপুলের কাছে ট্রেনে কাটা পড়ে দুই শিশু সন্তানসহ মা লাবণীর করুণ মৃত্যু হয়।
৩ নভেম্বর নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান শৈলেন বিশ্বাস ওরফে শৈলেন র্যাবের সঙ্গে বন্ধুকযুদ্ধে খুলনার ডুমরিয়ায় নিহত হন। এর মধ্য দিয়ে খুলনাঞ্চলের সর্ববৃহৎ চরমপন্থি নেতার আপাতত অবসান ঘটেছে বলে মনে করছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
কথিত সীমা হত্যা মামলায় গ্রেফতার হয়ে জেলহাজতে থাকার দীর্ঘ এক মাস ২৬ দিন পর ১০ ডিসেম্বর কারামুক্ত হন খালিশপুরের মিল্কি আইসক্রিম ফ্যাক্টরির মালিক মাসুদ হাসান ও তার স্ত্রী ফাতিমা ইয়াসমিন।
ওই দিন সোমবার বিকেল পৌনে ৫টার দিকে মাসুদ হাসান দ¤পতি খুলনা জেলা কারাগার থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে এক হৃদয়বিদারক ঘটনার সৃষ্টি হয়।
মাসুদ হাসানের বাসার কাজের মেয়ে সীমাকে হত্যা করে দীর্ঘ প্রায় এক বছর ধরে লাশ ঘরের ডিপ ফ্রিজে রেখে ৩১ জানুয়ারি ডুমুরিয়ার একটি বিলে ফেলে দেওয়ার কথিত অভিযোগ এনে ১৪ অক্টোবর মাসুদ হাসান ও তার স্ত্রী ফাতিমা ইয়াসমিনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এসময় পুলিশ তাদের কাছে মোটা অংকের ঘুষ দাবি করে।
দাবি পূরণ না হওয়ায় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা খালিশপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শাহ আলম কল্পিত নানা গল্প তৈরি করে সাংবাদিকদের কাছে সরবরাহ করেন। যার ওপর ভিত্তি করে পত্রপত্রিকায় বিভিন্নভাবে সংবাদ প্রকাশ হয়।
কিন্তু ২ ডিসেম্বর ‘নিহত’ সীমা খুলনার আদালতে হাজির হলে পুরো চিত্রটাই পাল্টে যায়। ‘নিহত’ সীমা সশরীরে আদালতে হাজির হওয়ায় এতদিনের কল্পকাহিনীর অবসান ঘটে।
সবশেষ ২৫ ডিসেম্বর খুলনায় পিকু শেখ নামে এক ব্যক্তিকে অপহরণ করে হত্যার দায়ে সহোদর ইদ্রিস শেখ ও আকবার শেখকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয় আদালত।
এদিকে, ২০১২ সালের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ-উজ-জামান।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, “আইনের শাসন সমাজে প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় প্রতিদিনই অপরাধ প্রবণতা বেড়েই চলেছে।”
সুপ্রিম কোর্ট ও খুলনা জজ কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. মো. জাকির হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, “আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে আমাদের সমাজে অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। ফলে যা হওয়ার, তাই হচ্ছে।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. শফিকুর রহমান বলেন, “অতীতের চেয়ে বর্তমানে খুলনার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেকটা ভালো।”
খুলনা জেলা পুলিশ সুপার তানভীর হায়দার চৌধুরী বলেন, “আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের কারণে যে কোনো জেলার তুলনায় খুলনায় আইন-শৃঙ্খলা যথেষ্ট ভালো আছে। কয়েকজন সন্ত্রাসী এখনও তাদের পুরোনো কর্মকাণ্ড চালানোর চেষ্টা করছে। তাদের দমনে অবশ্যই কাজ চলছে।”
র্যাব-৬ এর সহকারী অধিনায়ক মেজর সাখাওয়াত আলী বলেন, “বর্তমানে এ অঞ্চলে চরমপন্থিদের কোনো তৎপরতা নেই। বিশেষ করে শৈলেন বন্ধুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পরে নদীতে ডাকাতি এবং বনদস্যু গ্রেফতারের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।