ডেস্ক রির্পোট (২৯ ডিসেম্বর) নেতারা ক্ষমতার দ্বন্দ্বে একে অন্যকে এক-আধটু ‘ল্যাং’ মেরেই থাকবেন- এটা ‘বোকাসোকা’ জনগণ সবাই কমবেশি বোঝে, মেনেও নিয়েছে। কিন্তু হালের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা একে অন্যের প্রতি যে শব্দগুলো ইদানিং প্রয়োগ করছেন, তা হজম করতে যথেষ্ট কষ্টই হচ্ছে অনেকের। নেতাদের বক্তব্যে জনমানুষের জন্য তেমন ভালো কিছু আর খুঁজে পাচ্ছে না আমজনতা।
যে দ্রুততায় এ সংস্কৃতি(!) প্রবাহিত হচ্ছে তাতে শেষ অব্দি এ ধারা কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা ভেবে আতংকিত হতে হচ্ছে সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে থাকা মানুষদের। গণমাধ্যমের কল্যাণে প্রতিনিয়ত নেতাদের এই কাদা ছোঁড়াছুড়ির সাক্ষ্য বহন করছেন বাংলাদেশের নাগরিকরা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথাই ধরা যাক। গণতান্ত্রিক দেশের নিয়মানুযায়ী তিনি এখন দেশনেতা, বিশ্বের দরবারে এ দেশের প্রতিনিধি।
চলনে, বলনে, চিন্তায়, মানসিকতায় তিনি সবার আদর্শ হবেন বলেই জাতি আশা করে। শুধু প্রধানমন্ত্রী বলেই নন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা বলেও তার প্রতি মানুষের চাওয়া একটু বেশি।
কিন্তু বিরোধীদের উদ্দেশ্যে কখনো সখনো তিনি এমন কিছু শব্দ চয়ণ করেন, যা প্রতিটি বিবেকবান মানুষকেই বিব্রত করবে।
২৮ নভেম্বর টাঙ্গাইলের জনসভায় বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধীনেতা খালেদা জিয়া সম্পর্কে বলেন, ‘‘উনি (খালেদা জিয়া) বলেছেন- তার ছেলেরা নাকি ভীষণ সৎভাবে জীবন যাপন করেন। কী রকম মিথ্যা কথা বলে দেখেন। অবশ্য কথায় বলে না চোরের মা’র বড় গলা।’’ ২০ ডিসেম্বর যশোরের জনসভায়ও তিনি খালেদা জিয়াকে ‘চোরের মা’ বলে অভিহিত করলেন।
খালেদা জিয়াও একই রকম। দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী, একজন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী, তবু তার ভাষা প্রয়োগও অবাক করে অনেক সময়।
২৬ ডিসেম্বর যাত্রাবাড়ির পথসভার বক্তব্যে তিনি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পাল্টা জবাব দেন, ‘‘আপনার হলো চোরের মায়ের বড় গলা। আপনার গলাই বড়। গলাটা ছোট করুন, সামনের দিন ভাল নয়।” একই দিনে খিলগাঁও পথসভা থেকে প্রধানমন্ত্রীকে ‘বিকৃত মস্তিষ্ক’ বলেও আখ্যা দেন বিরোধীনেতা। খালেদা বলেন, ‘‘এমন বিকৃত মস্তিষ্কের নারী প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন না।’’
ঐ দিনেরই শুরুতে গাবতলীর পথসভায় খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগকে ‘সাপ’ এর সঙ্গে তুলনা করলেন। তিনি বলেন, “সাপকে বিশ্বাস করা যায়, আওয়ামী লীগকে বিশ্বাস করা যায় না।”
এমন কথা শুনে শেখ হাসিনাও কি বসে থাকতে পারেন? ২৭ ডিসেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দলের একটি সম্মেলন উদ্বোধন করতে গিয়ে তিনি খালেদার বক্তব্যের জবাব দিলেন, ‘‘খালেদা জিয়া সাপের ঝাঁপি মাথায় নিয়ে খেলছেন।’’
প্রধানমন্ত্রী অবশ্য এই সাপ বলতে জামায়াত-শিবিরকে বুঝিয়েছেন।
তবে আগের দিনই খালেদার বক্তব্যের জবাব দেন সংসদ উপনেতা ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। তার আক্রমণ খালেদা জিয়াকেই।
২৬ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নির্মিত বিজয় মঞ্চে সাজেদা বলেন, “খালেদা জিয়া শুধু সাপই নন, বিষধর কাল নাগিনী।”
একই অনুষ্ঠানে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেন, “খালেদা জিয়া নিজেই বিষধর কালনাগিনী।”
সেই অনুষ্ঠানেই দলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘‘খালেদা জিয়া বিষধর সাপ।”
ঐ অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়াকে ‘সাপ’ প্রমাণ করাই যেন এই গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মূল টার্গেটে পরিণত হয়েছিলো।
প্রধানমন্ত্রীর আরেকটি মন্তব্য উল্লেখ না করলেই নয়, ‘‘ক্ষমতায় যাওয়ার লোভে অন্ধ হয়ে খালেদা জিয়া ভারতে ‘তেল মারতে’ গিয়েছিলেন।’’ ২০ ডিসেম্বর যশোরের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী এ মন্তব্য করেন।
এর জবাবে সোচ্চার হয়ে ওঠেন বিএনপির নেতারা। টানা তিনদিন প্রতিটি সভায় নানা ভাবে ‘তেল’ এর প্রতিবাদ জানান তারা।
প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর এমন কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের জবাব দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার বন্ধু সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী থাকলে এর ভালো উত্তর দিতে পারতেন।’’
তার এ কথা বিশেষ ইঙ্গিতবাহী ছিল, তাই উপস্থিত স্রোতারা করতালি দিয়ে তাকে উৎসাহিত করলেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নির্মিত বিজয় মঞ্চের এক অনুষ্ঠানে বলেন, “ময়মনসিংহের জনসভায় খালেদা জিয়া বলেছেন, নিজামী, গোলাম আযম যুদ্ধাপরাধী নন। তবে কি তিনি নিজেই যুদ্ধাপরাধী?”
মতিয়া আরও বলেন, “খালেদা জিয়া আইএসআইয়ের এজেন্ট হিসেবে সেদিন (১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে) ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে জানজুয়ার কাছে ছিলেন।”
মতিয়া বলেন, “তার (খালেদা জিয়া) পুলিশ দেখলে সহ্য হয় না। পুলিশ দেখলে তার জানজুয়ার কথা মনে পড়ে যায়, পাকিস্তানের কথা মনে পড়ে যায়।”
আরেকটি অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়াকে ‘বৃহত্তর জামায়াতের মহিলা আমির’ বলেও আখ্যা দেন মতিয়া।
১৪ ডিসেম্বর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের আলোচনায় তিনি বলেন, “খালেদা জিয়া বিএনপি নেত্রী নন, বৃহত্তর জামায়াতের মহিলা আমির। তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য পাগল হয়ে গেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন।”
এজন্য মতিয়াকেও গালমন্দ করেন বিরোধীদলের নেতারা।
প্রধান দুই দলের নেতারাই শুধু একে অন্যের পেছনে লেগে আছেন, তা নয়, অন্য দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারাও পিছিয়ে নেই।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুও এই বাকযুদ্ধের দারুণ সেনা। বছরের মাঝামাঝিতে খালেদাকে রাজনীতি থেকে ‘মাইনাস’ করার ইচ্ছা প্রকাশ করে বিএনপিকে ক্ষেপিয়ে দেন তিনি।
২৫ মে জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সভায় ইনু বলেন, ‘‘মাইনাস ওয়ানের মাধ্যমে খালেদাকে রাজনীতি থেকে সরাতে হবে। কারণ খালেদা জিয়া সাম্প্রদায়িক বা যুদ্ধাপরাধীদের সহযোগী শক্তি।’’
২৯ জুন আরেকটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘‘খালেদা জিয়া যদি যুদ্ধাপরাধীদের প্লাস করতে চান, তাহলে রাজনীতি থেকে আমরা তাকে মাইনাস করবো।’’ একটি অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়াকে ‘সন্ত্রাসীদের নেত্রী’ বলে অভিহিত করেন ইনু। বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে দলীয় কার্যালয়ে এক মত বিনিময় সভায় খালেদা জিয়াকে গণতন্ত্রের ‘ঘৃণিত ব্যক্তি’ বলেও আখ্যায়িত করেন এই নেতা।
খালেদা জিয়াকে নিয়ে ইনুর একেক সময় একেক বক্তব্যে বিএনপি নেতারাও চুপ থাকেন না। ইনুকে ‘নিম্নস্তরের নেতা’ বলে অভিহিত করেন তারা।যুবদল সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে এক সমাবেশে বলেন, ‘‘তৃতীয় শ্রেণীর নেতা ইনু শেখ হাসিনার নৌকায় চড়ে এখন তিলকে তাল দেখছেন।’’
এগুলো তো ক’জনের কিছু মন্তব্য মাত্র। এভাবে প্রতিদিনই একজন আরেকজনকে মৌখিক আঘাতে জর্জরিত করছেন মনের খায়েশ মিটিয়ে। সেগুলো সব উল্লেখ করতে গেলে সাত খণ্ড রামায়ণ ছাড়িয়ে যাবে।
নেতারা একে অন্যের সমালোচনায় যেমন ব্যস্ত, তেমনি দেশের সচেতন নাগরিকরাও নেতাদের সমালোচনা করছেন সমানে। কোনো দলকে সমর্থন না করা লোকজনও দ্রুত বাড়ছে। বর্তমান নেতাদের প্রতি ক্রমশই ক্ষুব্ধ হচ্ছেন আমজনতা।
যারাই চলতি অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ রাখেন, তারাই আক্ষেপ করছেন, দেশ ও জনগণের সুখ দুঃখ, দাবি নিয়ে কথা বলছেন না রাজনৈতিকরা। ভাবছেন না, বর্তমান প্রজন্ম এসব দেখে দেখে বড় হচ্ছে। সদ্য কৈশোর পেরোনো যুবশ্রেণী ভালো কিছু শিখছে না রাজনীতি থেকে।
উচ্চমহলে বাংলা ভাষার এমন অপপ্রয়োগ হবে জানলে হয়তো ৫২’র ২১ ফেব্রুয়ারিতে এতো রক্ত ঝরাতেন না কোনো ভাষাসৈনিক- এমন আলোচনা টিএসসিতে আড্ডায় রত যুবাদের।
সেই আড্ডায় একের পর এক এমন মন্তব্য হচ্ছিল, যা নেতাদের জন্য মোটেই সুখবর বহন করে না, ‘‘প্রতিদিনই কোনো না কোনোভাবে আমাদের নেতারা একে অন্যের গুষ্টি উদ্ধারে ব্যস্ত। কতোটা অপমান কারে করা যায়, তারই যেন প্রতিযোগিতা। ভোট পাওয়ার যোগ্য কাউরেতো দেখি না।’’
‘‘তবে সবকিছুরই কমবেশি প্রতিক্রিয়া আছে। নেতাদের এই যুদ্ধের মাঝে তাদেরই অজান্তে দেশে হয়তো আড়মোড়া ভেঙে নতুন নেতৃত্ব উঠে আসবে, যে কথায় বড় না হয়ে কাজে বড় হবে’’- এমন মন্তব্য পাওয়া গেল নবীণদের আড্ডা থেকে।
ভদ্র ও সচেতন নাগরিকরা এখন এমনও মন্তব্য করছেন, ‘‘নেতারা নিজেদের এসব বাকবিতন্ডা আড়াল করে জনমানুষের পক্ষে কথা বলতে শুরু না করলে, সেটাই একদিন তাদের জন্য কাল হবে। অচিরেই হয়তো জনগণে এই নেতাদের মনে করিয়ে দেবে, একে অপরকে গাল-মন্দ করে ক্ষমতার লড়াই চলবে না, নেতারা জনগণের প্রভূ নন, শুধুই নির্বাচিত সেবক।”
নিউজরুম