কৃষি ডেস্ক(২৯ডিসেম্বর): শীতের প্রকোপ বৃদ্ধি ও ঘন কুয়াশার কারণে দেশের বেশিরভাগ জেলায় কোল্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়েছে ধান ও আলুর বীজতলা। এতে চারার পাতা হলুদ রং ধারণ ও পরে লাল হয়ে মারা যাচ্ছে। কোল্ড ইনজুরি রুখতে কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ অনুসরণ, হলুদ পাতার রং স্বাভাবিক করতে রাসায়নিক সার প্রয়াগসহ নানা চেষ্টার পরও শেষ রক্ষা হচ্ছে না বীজতলার। এছাড়া আলু ক্ষেতে লেট ব্রাইট রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। দিশেহারা হয়ে পড়েছেন চাষীরা। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে কোল্ড ইনজুরির প্রকোপ বেশি দেখা দিয়েছে। এতে বোরো ও আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় উদ্বিগ্ন কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা। তবে মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা পর্যাপ্ত সহযোগিতা করছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। তৃণমূল পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে এ তথ্য জানা গেছে।
কোল্ড ইনজুরি থেকে বীজতলা রক্ষায় কৃষকদের ব্যাপক পরামর্শ দিতে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কৃষিবিদরা বলছেন, সম্ভব হলে রাতে বীজতলা পলিথিন বা অন্য কোনো উপায়ে ঢেকে রাখতে হবে। শৈত্য প্রবাহের সময় প্রতিদিন সকালে বীজতলার চারাগাছ থেকে কুয়াশা ঝড়ে ফেলে দিতে হবে। বীজতলায় নিয়মিত সেচ প্রদান করতে হবে। বীজতলায় সেচের পানি জমিয়ে রাখতে হবে, যাতে বীজের গোড়ায় পানি থাকে। ডোবা বা নালার ঠাণ্ডা পানি দিয়ে সেচ না দিয়ে সেচ কাজে টিউবওয়েলের পানি ব্যবহার করা যেতে পারে। বীজতলায় ছাই ছিটিয়ে দিতে হবে। প্রতি শতাংশ জমির বীজতলায় ২০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৪০০ গ্রাম জীবসাম একত্রে মিশে উপরি প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি লিটারে ৪ গ্রাম সালফার জাতীয় ছত্রাকনাশক মিশিয়ে বীজতলায় স্প্রে করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। প্রয়োজনে স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ করতে হবে।
রংপুর : রংপুর থেকে আমাদের রিপোর্টার রফিকুল ইসলাম রফিক জানান, অব্যাহত শৈত্যপ্রবাহে বোরোর বীজতলা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ঘন কুয়াশা আর ঠাণ্ডা বাতাসের কারণে বীজতলার চারা লালচে আকার ধারণ করছে। চড়া দামের ধানবীজ থেকে উত্পন্ন এই চারা নষ্ট হওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন এ অঞ্চলের কৃষকরা। কৃষকরা জানিয়েছেন, কয়েক দিনের এ অবস্থায় এ অঞ্চলের ৪০ ভাগ বোরো ধানের বীজতলায় কোল্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়েছে। তাদের আশঙ্কা যে হারে বীজতলা নষ্ট হচ্ছে তাতে করে বোরো চাষের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তা পূরণ হবে না।
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, গত দেড় সপ্তাহ থেকে রংপুরসহ এ অঞ্চলে উত্তরাঞ্চলে শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়েছে। এ শৈত্যপ্রবাহ আরও বেশ কয়েকদিন থাকবে। সন্ধ্যা থেকে ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়ছে এ অঞ্চল। গেল সপ্তাহ থেকে সর্বোচ্চ ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও সর্বনিম্ন ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে এ অঞ্চলে ৭ লাখ ৬০ হাজার ৩৬৬ হেক্টর জমিতে বোরো ধান উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
রংপুরের গঙ্গাচড়ার মুন্সিপাড়া গ্রামের কৃষক আব্দুস সামাদ কোল্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত বোরো বীজতলা দেখিয়ে বলেন, বোরো বীজতলার চারা হলুদ ও বিবর্ণ দেখা গেছে। তাছাড়া অনেক ধানের চারা গজায়নি। রংপুর সদরের আবদুর রহিম জানান, বেশি দামে বীজ কিনে সেই বীজ যদি সঠিকভাবে না হয় তাহলে তাদের আর কোনো উপায় থাকবে না।
ফসল নষ্ট হলেও কৃষি কর্মকর্তারা সহযোগিতা করছেন অভিযোগ করে কৃষকরা বলেন, শীতে বীজতলা নষ্ট হলেও কৃষি বিভাগের লোকজন কৃষকদের সেভাবে পরামর্শ দিচ্ছেন না। যার কারণে কেউ কেউ বীজতলা ঢেকে রাখলে অধিকাংশ কৃষক কি করবেন তা বুঝতে পারছেন না।
রাজশাহী : রাজশাহী থেকে আমাদের রিপোর্টার সরদার এম আনিছুর রহমান জানান, মৃদু শৈত্যপ্রবাহে রাজশাহী অঞ্চলের আলু ক্ষেতে লেট বাইট ও বোরোর বীজতলায় কোল্ড ইনজুরি দেখা দেয়ার আশঙ্কায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন চাষীরা। কৃষিবিদদের পরামর্শে ফসল রক্ষায় তারা বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। কৃষক ও কৃষিবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক সপ্তাহ ধরে রাজশাহীর উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। দিনের বেলাতেও কুয়াশায় ঢেকে থাকছে আকাশ। কোনো কোনো দিন সূর্যের দেখাও মিলছে না। দিনেও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মতো কুয়াশা পড়েছে। প্রতিকূল এ আবহাওয়ায় আলু ক্ষেতে দেখা দিতে পারে লেট বাইট বা নাবী ধসা, আগাম ধসা রোগ। আবার বোরোর বীজতলায় দেখা দিতে পারে কোল্ড ইনজুরি। তাই চাষীরা ফসল রক্ষায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তারা বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করছেন ফসল রক্ষায়।
রাষ্ট্রপতি পদকপ্রাপ্ত আলু চাষী পবার রহিম উদ্দিন সরকার বলেন, এবার তার নিজের ১২ বিঘা ও ছেলেদের ১৫০ বিঘায় আলু আবাদ রয়েছে। বর্তমানের আবহাওয়ায় আলু আবাদ নিয়ে তারা চিন্তিত। ফসল রক্ষায় তারাসহ অন্য চাষীরা নিয়মিত প্রতিষেধক ব্যবহার করছেন। বোরোর বীজতলা নিয়েও চাষীদের রয়েছে দুশ্চিন্তা।
রাজশাহী আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার কৃষিবিদ আবদুল্লা–হিল–কাফি বলেন, বর্তমান আবহাওয়ায় আলু ক্ষেতে নাবী ধসা বা আগাম ধসা রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে। এজন্য জমিতে ম্যানকোজেব ও মেটালেক্সিন গ্রুপের ওষুধ নিয়মিত ব্যবহার করতে হবে। বোরোর বীজতলাকে বিকেলে পানি অথবা পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিতে হবে এবং সকালে তা সরিয়ে ফেলতে হবে। এছাড়াও কয়েকটি পদ্ধতি রয়েছে। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানায়, এখন পর্যন্ত রাজশাহীতে আলু আবাদ হয়েছে ৩৫ হাজার ৩৩৫ হেক্টর জমিতে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩শ’ হেক্টর বেশি। আর বোরোর বীজতলা রয়েছে ৩ হাজার ৮৫১ হেক্টরে। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১০৭ হেক্টর বেশি।
তানোর : রাজশাহীর তানোর প্রতিনিধি মামুনুর রশিদ মামুন জানান, তানোরে গত কয়েকদিনের ঘন কুয়াশা ও শীতে মরে যাচ্ছে বোরোর বীজতলা। উপজেলার ৭টি ইউনিয়ন ও দুটি পৌর এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে এখানকার অধিকাংশ বোরোর বীজতলা নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়ে পড়েছে। এতে করে চলতি মৌসুমে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। উপজেলা কৃষি অফিস বলছে, এই বিষয়ে কৃষকদের সচেতন করতে উপজেলার গ্রামে গ্রামে লিফলেট বিতারণ করা হচ্ছে এবং মসজিতে মসজিতে মাইকিং করে কৃষকদের সচেতন করা হচ্ছে। কৃষকরা জানান, ঘন কুয়াশায় ও প্রচণ্ড শীতে বোরোর বীজতলার চারাগাছের পাতা হলুদ হয়ে কুকড়ে মুকড়ে মরে যাচ্ছে। বিভিন্ন কীটনাশক ব্যবহার করে কোনো লাভ হচ্ছে না। এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ডা. হাসানুল কবির কামেলী বোরোর বীজতলার ক্ষতি সাধিত হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, এতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না।
সাঘাটা : গাইবান্ধার সাঘাটা প্রতিনিধি মিজানুর রহমান রাঙ্গা জানান, প্রচণ্ড শৈত্যপ্রবাহ আর অস্বাভাবিক ঘন কুয়াশায় গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলায় কৃষকদের বীজতলা হলদে বর্ণ ধারণ করে নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। শৈত্যপ্রবাহের কারণে চারা হলুদ বর্ণ ধারণ করছে। শীত না কমলে পচন ধরার আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। উপজেলা কৃষি অফিস সূত্র জানায়, এ বছর পুরো উপজেলায় ৭২০ হেক্টর জমিতে বীজতলার চারার লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে। এর মধ্যে অর্জিত হয়েছে ৮১৮ হেক্টর জমিতে উপজেলা কৃষি অফিসার সোহেল মোহাম্মদ শামসুদ্দিন ফিরোজ জানান, শৈত্যপ্রবাহের কারণে বীজতলার সমস্যা হলেও পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে কৃষকদের।
নিউজরুম