কৃষি ডেস্ক(২৯ডিসেম্বর): একটি গ্রাম। গ্রামের নাম ছলিমপুর। সে গ্রামের একজন কৃষকÑ নাম তার পেয়ারা আমজাদ। তিল তিল করে তিনি সেই গ্রামে গড়ে তুলেছেন এক বিশাল কৃষি খামার। খামারের নাম দিয়েছেন তার বড় মেয়ের নামে ‘আঁখিমণি কৃষি খামার’।
পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার এ গ্রামের সেই কৃষককে সবাই চেনেন পেয়ারা আমজাদ নামে। কেননা ইতোমধ্যেই তিনি সেই খামারে প্রায় ২৫ বিঘা জমিতে গড়ে তুলেছেন এক অনন্য সুন্দর লাভজনক এক পেয়ারা বাগান, যে বাগান থেকে তিনি বছরে প্রায় ২৫ লাখ টাকার পেয়ারা বিক্রি করছেন। সেই বাগান দেখতে পৌষের এক বিকেলে হাজির হলাম তার বাড়িতে। বাড়ির সাথেই পেছনের জমিতে তার সেই অনবদ্য কৃষি শিল্প, যা দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।
কথা বলতে বলতে হাজির হলাম তার পেয়ারাবাগানের মধ্যে। সারি করে লাগানো পেয়ারাগাছগুলোর বয়স প্রায় পাঁচ বছর। তবে এরও আগে থেকেই তিনি পেয়ারা চাষে হাতেখড়ি দেন। সেটাও আর এক গল্প। প্রায় পঁচিশ বছর আগের কথা। সে সময় তারা ছিলেন খুব গরিব। দরিদ্র পিতার বড় সন্তান হয়ে লেখাপড়ার তেমন কোনো সুযোগ হয়নি। তাই দিনমজুর দিয়ে আর অন্যের জমিতে চাষাবাদের কাজ করেই তার বড় হয়ে ওঠা। একই গ্রামের আর এক সফল চাষি পেঁপে বাদশাহর পেঁপেবাগান দেখে তার শখ জাগে নিজেও একটা পেঁপেবাগান গড়ে তুুলবেন। বাজার থেকে বড় দুটো পেঁপে কিনে নিয়ে আসেন তিরিশ টাকা দিয়ে। তারপর সেই পেঁপে খেয়ে বীজ রাখেন। প্রায় এক বিঘা জমিতে সেই বীজ বুনে গড়ে তোলেন একটা পেঁপেবাগান। তিনি বলেন, ‘বাদশা ভাইকে দেখে পেঁপে লাগাই। উনি পেঁপেবাগানের জন্য যা করেন, আমিও তা দেখে এসে সেভাবে তা করা শুরু করি। নিজেই বাগানে কাজ করতাম, নিজেই নিজের বাগানের পেঁপে তুলে মাথায় করে বাজারে বেচতে যেতাম। সে বছর এক বিঘা জমির পেঁপে বিক্রি করে প্রায় ৩০ হাজার টাকা লাভ করি। এতেই আমার উৎসাহ দ্বিগুণ বেড়ে যায়। আমি লেগে পড়ি পেঁপে চাষে। এর পরের বছর পেঁপে চাষ করি তিন বিঘা জমিতে। লাভ হয় প্রায় ৮০ হাজার টাকা। এটাই আমার মূলধন হয়ে গেল। এরপর ধীরে ধীরে জমি বর্গা নিয়ে কয়েক বছরের মধ্যেই আমি ২০ বিঘার পেঁপেবাগান গড়ে তুলি। গ্রামে যাদের এক বা দুই বিঘার ছোট ছোট পেঁপেবাগান ছিল, তারা আর তাদের বাগানের পেঁপে বেচতে বাজারে যেত না। আমিই ওদের বাগানের পেঁপে কিনে নিতাম। আর আমারটার সাথে একসাথে সব পেঁপে ঢাকার বাজারে পাঠাতাম। এতে আমার উৎপাদনের পাশপাশি পেঁপে ব্যবসায় করেও কিছু লাভ আসত। সে সময় পেঁপে চাষ করে আমার বছরে প্রায় তিন লাখ টাকা আয় হতো। আমি ধীরে ধীরে বাড়ি, পাকা ঘর করলাম, টিনের চাল দিলাম।’
পেয়ারাবাগানের মধ্যে বসে তার কথাগুলো যেন এক মজার কাহিনীর মতো শোনাচ্ছিল। বললাম, ‘এরপর?’ পেয়ারা আমজাদ বলে যেতে লাগলেন, ‘একদিন ময়েজ সাহেবের কুলবাগান দেখে মাথায় কুলের ভূত চাপল। ময়েজ সাহেবই এলাকায় ভালো কুল নিয়ে আসেন। তার পরামর্শে এবার দুই বিঘা জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে ১৮০টি গাছ লাগিয়ে প্রথম বাউকুলের বাগান গড়ে তুলি। পরের বছর সে বাগান থেকে প্রায় ৩ লাখ টাকার কুল বিক্রি করি। পরের বছর ১০ বিঘা জমিতে বাউকুলের বাগান করি। কিন্তু সে বছর কুলের ভালো দাম না থাকায় লাভ হয় কম। ২০ লাখ টাকার কুল বিক্রি হলেও সে বাগানের জন্য প্রায় আট লাখ টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর শুরু হয় পেয়ারার কাহিনী। ঢাকার আড়তদারেরা প্রায়ই বলেনÑ ভাই, আপনার এত মাল বেচি; কই, আপনি তো এক দিনও ঢাকায় এলেন না। একবার না হয় বেড়াতে আসেন। অবশেষে একদিন ঢাকায় যাই। গিয়ে তো আমার চোখ ছানাবড়া। আমার কুল বিক্রি হচ্ছে ৬০–৬৫ টাকা কেজি, আর একই আড়তে তখন পেয়ারা বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকার ওপরে। কী পেয়ারা যে এত দাম? তা দেখে আমার মন ঘুরে যায়। সেখান থেকে ঝোঁক চাপে থাই পেয়ারা চাষের। কোথায় পাবো থাই পেয়ারার চারা? অবশেষে একজনের পরামর্শে বরিশালের এক লোকের কাছ থেকে কিছু থাই পেয়ারার চারা পাই। মাত্র এক বিঘা জমিতে এরপর সেসব চারা লাগাই। প্রথম বছর বাগান করতে গিয়ে না বুঝে অনেক খরচ করে ফেলি। ফলে সে বছর কোনো লাভই হয় না। দ্বিতীয় বছরে খরচের টাকা উঠে সামান্য লাভ আসে। এরপর শিখে ফেলি কী করে অসময়ে বেশি ফল ধরানো যায়। সেই বুদ্ধি করে কাজ করায় পরের বছর প্রায় চার লাখ টাকা লাভ হয়। এরপর আর পেয়ারা চাষে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
সত্যিই তাই, পেয়ারা আমজাদ এরপর থেকে ধীরে ধীরে ২৫ বিঘা জমিতে পেয়ারা লাগিয়েছেন। এ বছর সেই বাগান থেকে প্রায় ১০ লাখ টাকার পেয়ারা বিক্রি করেছেন। এখনো বাগানে যে পেয়ারা আছে এই শীতে তা আরো সাত থেকে আট লাখ টাকা হবে বলে জানান। থাই পেয়ারা চাষ লাভজনক হওয়ায় তিনি এ বছর নতুন করে আরো ১২ বিঘা জমিতে থাই পেয়ারার বাগান গড়ে তুলেছেন। পেয়ারার পাশাপাশি ১০ বিঘা জমিতে বাউকুলও লাগিয়েছেন। সেসব কুলবাগানের প্রতিটি গাছে ঠেসে কুল ধরেছে। কুল তুলে পেয়ারাবাগানের মধ্যে বসেই সেগুলো প্যাকিং করে পাঠানোর কাজ করছে তার লোকেরা। ঢাকায় এগুলো এখন ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হবে। এ ছাড়া তিনি কুল ও নতুন লাগানো পেয়ারাবাগানের মধ্যে গম, গাজর, হলুদ, লাউ, টমেটো, বেগুন, আলু, মসুর ইত্যাদি ফসলের চাষ করেছেন। ফলগাছগুলো ফলবান, কিন্তু এখনো যথেষ্ট বড় হয়ে ওঠেনি। তাই সেসব বাগান থেকে এসব ফসল চাষ করে বাড়তি লাভ পাচ্ছেন। তার আঁখিমণি কৃষি খামারে বর্তমান জমির পরিমাণ ৬৬ বিঘা। নিজের আছে ২১ বিঘা জমি। বাকিটা বর্গা নেয়া। তিনি জানান, তিনি এ পর্যন্ত যত ফসল চাষ করেছেন, তার মধ্যে থাই পেয়ারা চাষে সবচেয়ে বেশি লাভ পেয়েছেন।
ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি অফিসার মো: খুরশীদ আলমও সে কথা স্বীকার করে বললেন, ‘এখন কৃষকেরাই গবেষক হয়ে গেছেন। তারা নিজেরা করে করে যা শিখছেন তা বইপত্রের ভাষায় নেই। পেয়ারা এ দেশে আমরা জানি যে গ্রীষ্ম–বর্ষায় ধরে। কিন্তু কৃষকেরা নিজেরাই বিশেষ কৌশল উদ্ভাবন করেছেন, যার মাধ্যমে তারা শীতেও ভালো পেয়ারা ধরাতে পারছেন এবং অধিক লাভবান হচ্ছেন। আমরাও তাদেরকে উৎসাহিত করছি, ব্যবস্থাপনার পরামর্শ দিচ্ছি। এমন কোনো সপ্তাহ নেই, যে সপ্তাহে কোনো না কোনো দল পেয়ারা আমজাদের পেয়ারাবাগান দেখতে না আসে। আমরা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা সেসব কৃষককে আমজাদের সাফল্য দেখাই এবং তাদেরও থাই পেয়ারা চাষে উদ্বুদ্ধ করি। ঈশ্বরদীতে আরো পেয়ারাবাগান হচ্ছে। ইতোমধ্যে পাশে মজিবর নামে আর একজন কৃষক ১০ বিঘা জমিতে থাই পেয়ারার বাগান গড়ে তুলেছেন। তবে এলাকাতে পেয়ারার সফল নায়ক হিসেবে পেয়ারা আমজাদই পরিচিত।’
ঈশ্বরদীতে শুধু পেয়ারা আমজাদই নন, সেখানে আছেন পেঁপে বাদশা, কুল ময়েজ, গাজর জাহিদ, লিচু কেতাবের মতো কৃষক, যারা ফসল চাষ করে প্রতি বছর লাখ লাখ টাকা আয় করছেন। তাদের সাফল্যে অনুপ্রাণিত অন্য কৃষকেরাও। এসব কৃষকের অবদানেই ঈশ্বরদী এখন যেন এক উদ্যান ফসলের নগরী; হয়তো ভবিষ্যতে একদিন ফলের রাজধানীও হবে। পাবনা জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক এ বি এম মোস্তাফিজার রহমান জানান, পাবনা জেলায় বর্তমানে ৭৭১ হেক্টর জমিতে শুধু লিচু চাষ হচ্ছে। সব ফল মিলিয়ে এ জেলায় প্রায় ৯ হাজার হেক্টর ফলের জমি রয়েছে। দিন দিন তা বাড়ছে। ইতোমধ্যে এ জেলার প্রায় ২০ হাজার কেজি সাগর কলার একটি চালান কয়েক দিন আগে পোল্যান্ডে রফতানি হয়েছে বলে পত্রিকার মাধ্যমে জানা গেছে। তাই ভবিষ্যতে হয়তো পাবনাই হবে দেশের অন্যতম একটি ফল উৎপাদনকারী জেলা। ।
নিউজরুম