আগামী সোমবার যে খ্রিষ্টীয় বছরটি শেষ হবে, সেই বছরটি মহাজোট ওরফে আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য মোটেই সুখকর ছিল না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিরোধী দলের আন্দোলন কাবু করতে না পারলেও দেশ পরিচালনায় নানা ব্যর্থতা, অব্যবস্থা, অদক্ষতা এবং ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সরকারকে বেশ বেকায়দায় ফেলেছে।
২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতা নেওয়ার অব্যবহিত পর পিলখানা ট্র্যাজেডি সত্ত্বেও শেখ হাসিনার সরকার দ্রুত পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছিল। বিরোধীদলীয় নেতা এখন যা-ই বলুন, সেটাই ছিল বাস্তবসম্মত। সেদিন পিলখানায় সেনা অভিযান চালালে আরও বেশি রক্তপাত হতো। পরবর্তী সময়ে জঙ্গিবিরোধী সফল অভিযান, নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন, কৃষি, বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধিসহ সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। বিশ্বব্যাপী মন্দা সত্ত্বেও তিন বছর ধরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরে রাখাও সরকারের সাফল্য হিসেবে বিবেচিত।
কিন্তু মেয়াদের চতুর্থ বছরে এসে কতগুলো ভুল পদক্ষেপ সরকারকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। বলা যায়, সরকার এখন সফলতা ও বিফলতার সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। এ মুহূর্তে সামান্য ভুল যেমন সরকারের জন্য বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, তেমনি হিসাব করে পা রাখলে সংকট উত্তরণও কঠিন হবে না বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন।
২০১২ সালের যে ঘটনাগুলো সরকারের অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেগুলো হলো: সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যা, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিল, মন্ত্রিসভার রদবদল নিয়ে টানাপোড়েন, কক্সবাজারে বৌদ্ধপল্লিতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ, হল-মার্ক ও সোনালী ব্যাংক কেলেঙ্কারি, শিক্ষাঙ্গনে অশান্ত পরিবেশ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং বিশ্বজিৎ দাসের খুন হওয়া।
গত ফেব্রুয়ারিতে সাগর-রুনি হত্যার পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ঘাতকদের পাকড়াও করার ঘোষণা দিলেও গত ১০ মাসেও তা কার্যকর করতে পারেননি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বদল হলেও খুনিদের ধরতে পারেনি সরকার। তদুপরি বিএনপির নেতা ইলিয়াস আলীর গুম হওয়ার ঘটনা ছিল বছরজুড়ে তপ্ত আলোচনার বিষয়।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের বিষয়ে বিশ্বব্যাংক সতর্ক করে দিলেও সরকার যথাসময়ে পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়; এমনকি ২৯ জুন বিশ্বব্যাংক চুক্তিটি বাতিল করার পরও নীতিনির্ধারকদের চৈতন্যোদয় হয়নি। তখন সরকারের মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা জোর আওয়াজ তুলেছিলেন যে, বিশ্বব্যাংক ঋণ না দিলে জনগণের কাছ থেকে চাঁদা তুলে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবে। তাঁরা ভুলে গিয়েছিলেন, ১৯৭১ ও ২০১২ এক নয়, শেখ হাসিনাও বঙ্গবন্ধু নন যে ‘যার যা আছে’ ডাক দিলেই সবাই ঝাঁপিয়ে পড়বে। অবশেষে বিশ্বব্যাংকের সব শর্ত মেনে নিয়ে এবং সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে সরিয়ে সরকার বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা শুরু করলেও বছরের শেষ নাগাদ তা কোনো সুফলদেয়নি। সর্বশেষ দুই আবুলকে সন্দেহের তালিকায় রেখে অভিযুক্ত বাকি সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। গ্রেপ্তার হয়েছেন সেতু বিভাগের সাবেক সচিব ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্যসচিব কাজী মোহাম্মদ ফেরদাউস। বিশ্বব্যাংক ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ তদন্তের ওপরই পদ্মা সেতুতে তাদের অর্থায়ন নির্ভর করছে।
মহাজোট সরকারের দুটি প্রধান নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল: যুদ্ধাপরাধের বিচার ও পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন। যুদ্ধাপরাধের বিচার-প্রক্রিয়া মোটামুটি ভালোভাবেই চলছে। বছরের শেষে এসে স্কাইপ কেলেঙ্কারির পর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের পদত্যাগ সাময়িক ধাক্কা দিলেও দ্রুত আদালত পুনর্গঠন করে বিচার-প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে সরকার। কিন্তু পদ্মা সেতু চরায় আটকে গেছে। এর মধ্যে অত্যাশ্চর্য কিছু না ঘটলে বর্তমান সরকারের আমলে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হওয়া কঠিন বলেই পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন।
গত বছর ও চলতি বছরের শুরুতে সরকারের কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে খোদ সরকারি দলের সাংসদেরা সমালোচনায় মুখর হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রিসভায় ঈষৎ পরিবর্তন আনেন। প্রথমে তিনি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে ভাগ করে ওবায়দুল কাদের ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে যথাক্রমে যোগাযোগ ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন। মন্ত্রিত্ব পাওয়ার আগে ক্ষমতাসীন দলে এ দুই নেতাই সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ব্যাপারে সোচ্চার ছিলেন। কিন্তু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রেলওয়ের কালো বিড়াল ধরার আগেই নিজে কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ে দপ্তর হারান। বর্তমানে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে তিনি বিরোধী দলের রাজনৈতিক বক্তৃতা-বিবৃতির জবাবদানে ব্যস্ত।
বছরের মাঝামাঝি প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভায় আরেক দফা পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নিলেও দলের ও মহাজোটের দুই প্রভাবশালী নেতা তোফায়েল আহমেদ ও রাশেদ খান মেনন সরকারের শেষ বেলায় মন্ত্রিত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে মন্ত্রিসভায় পরিচ্ছন্ন ও দক্ষ ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার শেখ হাসিনার দ্বিতীয় চেষ্টাও সফল হয়নি। নতুন মন্ত্রীদের কারও কারও বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ আসতে শুরু করেছে।
বছরের শেষার্ধে এসে সরকারকে যে বিষয়টি সাঁড়াশির মতো চেপে ধরে, সেগুলো হলো: হল-মার্ক ও সোনালী ব্যাংক কেলেঙ্কারি। একটি অখ্যাত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দেশের ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে বড় দুর্নীতি করতে পেরেছে ব্যাংক কর্মকর্তা ও পর্ষদের যোগসাজশে। সোনালী ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখায় প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য উপদেষ্টার ঘন ঘন যাতায়াত নিয়ে খোদ সংসদীয় তদন্ত কমিটিই প্রশ্ন তুলেছে। পর্ষদের একজন সদস্য তিন কোটি টাকা উৎকোচের বিনিময়ে হল-মার্কের কাগজপত্র ধামাচাপা দিয়েছেন বলে পত্রিকায় খবর এসেছে। সরকারি ব্যাংকগুলোতে কী পরিমাণ দুর্নীতি ও অনিয়ম হচ্ছে, তার ক্ষুদ্র একটি অংশই পত্রিকায় আসছে। পুনগর্ঠিত পরিচালনা পর্ষদ ব্যাংকগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে গতি আনতে পারবে, না জঞ্জাল বাড়াবে তা দেখার জন্য আমাদের আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে।
২০১২ সালজুড়েই উচ্চশিক্ষাঙ্গন উত্তপ্ত ছিল, উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে অচল হয়ে পড়ে জাহাঙ্গীরনগর, বুয়েট, রুয়েট ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। থেমে থেমে আন্দোলন হয়েছে জগন্নাথ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকার প্রথমে সমস্যা উপেক্ষা করতে চাইলেও পরবর্তী সময়ে উপাচার্য বা সহ-উপাচার্যকে বিদায় দিতে বাধ্য হয়। এর পাশাপাশি সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের দৌরাত্ম্য ও আত্মঘাতী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাঁদের টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি সরকারের ভাবমূর্তি হিমাঙ্কে নামিয়ে দিয়েছে।
মেয়াদের মাঝামাঝি সরকারদলীয় সাংসদদের বেপরোয়া আচরণ লক্ষ করা গেলেও এখন অনেকই আগামী নির্বাচনের কথা ভেবে খামোশ হয়ে গেছেন। কিন্তু ‘বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়’ ছাত্রলীগের মাস্তানি-সন্ত্রাসী তৎপরতা এতটুকু কমেনি। সরকার-সমর্থক এ ছাত্রসংগঠনটির সন্ত্রাস ও দৌরাত্ম্য এতটাই বেড়ে যায় যে, নানা হুমকি-ধমকি সত্ত্বেও তাদের লাগাম টেনে ধরা যায়নি। যার সর্বশেষ উদাহরণ ৯ ডিসেম্বর বিরোধী দলের অবরোধের দিন পুরান ঢাকায় বিশ্বজিৎ দাস হত্যা। এ ঘটনা এতই নৃশংস ও নির্মম যে গোটা জাতিকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে।
এ রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে গত ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের রামু, উখিয়া, টেকনাফে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর সন্ত্রাসীদের হামলা ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি ও বিহারে আক্রমণ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা দেশবাসীকে হতবাক করে দেয়। বাংলাদেশে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর সংঘবদ্ধ আক্রমণের ঘটনা এই প্রথম। ধারণা করা হয়, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর আক্রমণের প্রতিশোধ নিতে স্বার্থান্বেষী মহল বাংলাদেশে বৌদ্ধদের আক্রমণের লক্ষ্য করে। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন, গোয়েন্দা বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়। এমনকি বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের কর্মীরা হামলায় অংশ নেন বলে অভিযোগ আছে।
তবে এসব বিপর্যয় ও বিতর্ক সত্ত্বেও ২০১২ সালে অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার কথা স্বীকার করেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও গবেষণা সংস্থাগুলো। ইকোনমিস্ট, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, খালিজ টাইমস-এর মতো পত্রিকাগুলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্যকে বিস্ময়কর হিসেবে অভিহিত করেছে; দেশের ভেতরে এবং বাইরের বিশ্লেষকেরাও মনে করেন, রাজনৈতিক ঝগড়া-বিবাদটা একটু কম হলে অর্থনৈতিক অগ্রগতি আরও গতিশীল হতো; সেক্ষেত্রে ২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশের মধ্য আয়ের দেশ হওয়া অসম্ভব নয়। তবে এ অগ্রগতির সঙ্গে বৈষম্যটা হ্রাস না পেলে এক দেশ দুই সমাজে পরিণত হবে, যা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী।
নানা টানাপোড়েন বিপর্যয়-বিপন্নতায় সরকার ২০১২ সালটি পার করেছে। ২০১৩ সালে তার জন্য কী অপেক্ষা করছে, পরিস্থিতি কীভাবে সরকার সামাল দেবে; সেটাই এখন দেখার বিষয়। ২০১৩ সালে সরকারের জন্য বড় তিন চ্যালেঞ্জ—সব শঙ্কা ও সংশয় কাটিয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংককে ফিরিয়ে আনা, আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে বিরোধী দলের সঙ্গে একটি সমঝোতায় আসা এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারকাজ শেষ করা।
সরকার এ তিনটি অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করতে প্রস্তুত আছে কি? যদি তারা যুক্তির ভাষায় চলতে চেষ্টা করে এবং নির্বাচনের ব্যাপারে সবার কাছেগ্রহণযোগ্যএকটি সমাধান বের করতে পারে, তাহলে ২০১৩ সালটি সবার জন্যশুভ হবে বলেই আমাদের ধারণা। আর যদি সরকার গোঁয়ার্তুমিকরে কোনো কিছু চাপিয়েদিতে চায়, দলীয় মাস্তানদের নিবৃত্ত না করে, তাহলে দেশ কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হবে, যা সরকার ও দেশের জন্য শুভনা-ও হতে পারে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net