কষাটের দশকে যাঁরা কাব্যচর্চা করতে আসেন তাঁদের প্রায় সবার সামনেই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল দেশ ও মানুষের অস্তিত্ব। এ দু’টি সত্তার টিকে থাকা না থাকার মধ্যেই নিজের অস্তিত্ব-নিরস্তিত্বের প্রশ্ন গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল তাদের। তাই স্বদেশ, মানুষ ও মানবিকতার কাছে সমান দায়বদ্ধ হয়েই তাঁরা কবিতাচর্চায় ব্রত হয়েছিলেন। মিছিলে-স্লোগানে যেমন প্রকম্পিত করেছিলেন রাজপথ, তেমনি কবিতার শরীরে গেঁথে দিয়েছিলেন চেতনার অগ্নিমন্ত্রের বীজ। রাজনীতির অগ্নিসোপান অতিক্রমণের মধ্যে আপন অস্তিত্বের অবিরাম প্রজ্বলনে দূর হয়েছিল তাঁদের আপন আঁধার। অতঃপর মর্মে খোদিত মানবিক মূল্যবোধ, ইতিহাস ও ঐতিহ্যপ্রীতি গভীরভাবে ছাপ ফেলেছিল তাঁদের বৈচিত্র্যময় কর্মে। প্রেম ও দ্রোহের দ্বৈতসত্তার সহাবস্থানেই তাঁরা এগিয়ে গেছেন কণ্টকাকীর্ণ পথ। দ্রোহের আগুনে নিজে পুড়েছেন, অন্যদেরও পুড়িয়েছেন। প্রেমাবেগে মোমের মতো বিগলিত হয়ে বারবার সমর্পিত হয়েছেন কাক্সিত মানবীর কাছে। তার বিহনে বিরহ-দহনে কাতর হয়েছেন। তবে প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার অস্থির সময়ে নারীর কাছেও তাঁরা স্থিত হতে পারেননি। তাঁদের দ্রোহ ও প্রেম তাই ব্যক্তিক ভাবনা থেকে সামষ্টিক চেতনা রঙে রঞ্জিত হয়েছে। এ কথা রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহার েেত্র যেমন বলা যায়; তেমনি বলা যায় আল মুজাহিদীর েেত্রও। তবে রাজনীতির মাঠ সরগরমে তাঁদের চেয়ে আল মুজাহিদীর স্বতন্ত্র একটা অবস্থান তখন তৈরি হয়ে গিয়েছিল। অনেককে পেছনে ফেলে এ পথে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছিলেন তিনি। সেই সময় তিনি ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। রচনা করেছেন ‘ছাত্রলীগ সংগীত’। জয় স্বাধীনতা বাংলা স্লোগানের প্রবক্তাও তিনি। শুধু তা-ই নয়, মুক্তিযুদ্ধের তাত্ত্বিক ব্যক্তিত্ব ও সংগঠকও। কবিতা ও রাজনীতি তাঁকে সহজেই সম্পৃক্ত করেছিল দেশ ও মানুষের সাথে। দেশের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটিয়েছে। তাড়িয়ে নিয়েছে যুদ্ধের ময়দানে। তারপর কী এক অভিমান বুকের মধ্যে বেজে উঠল তাঁর কে জানে! হয়তো সামষ্টিক কল্যাণভাবনা থেকে সরে এসে রাজনীতিকেরা ব্যক্তিকেন্দ্রিক ভাবনায় নিমজ্জিত হচ্ছিলেন। ক্রমেই জটিল ও কুটিল হয়ে উঠছিল পরিবেশ। কিছুতেই তার সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছিলেন না তিনি। তাই রাজনীতির সরগরম মাঠ ছেড়ে স্থিত হলেন সাংবাদিকতায়। নিমগ্ন হলেন ইত্তেফাকের সাহিত্য বিভাগের সম্পাদনায়। এখানেই কাটিয়ে দিলেন প্রায় দীর্ঘ ৩৬ বছর। এর মধ্যেই সৃষ্টি ও আত্মবিনির্মাণে ব্যাপৃত করেছেন নিজেকে। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ ও শিশু-কিশোর ছড়া, গল্প কী লেখেননি তিনি! বিদেশী সাহিত্যের অনুবাদ করেছেন। সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই রয়েছে তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ। এ যাবৎ গ্রন্থের সংখ্যা সত্তর ছাড়িয়ে গেছে। তার মধ্যে কাব্যগ্রন্থের সংখ্যাই অধিক। সব কিছুর মধ্যে মুখ্য হয়ে ওঠে তাঁর কবিসত্তা। তিনি কবি। মৃত্তিকা, অতি মৃত্তিকা ও মানুষের কবি। মৃত্তিকা, মানুষ, স্বাধীনতা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, মানবিকতা ও প্রেম তাঁর কাছে বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় নয়। তাঁর সৃষ্টিচৈতন্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাঁর কবিতায় মৃত্তিকার বহুমাত্রিক ব্যবহার বর্ণময় চৈতন্যে দীপ্র। মৃত্তিকা শুধু মাটি নয়Ñ তাঁর জন্মভূমি, সার্বভৌম স্বদেশ। স্বদেশের সীমানা ছাড়িয়ে পরিব্যাপ্ত এক বিপুল বিশ্বেÑ নত্র-ন্যেবুলা ছাড়িয়ে অতিলৌকিক জীবন ও জগতের আকাক্সা ও সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলে। তাই তাঁর কবিতার শব্দ মানেই সীমানা ভাঙার অপ্রতিরোধ্য অবিনাশী আয়োজন। শব্দ মানেই প্রেম-বিরহ, দ্রোহ ও মানবিক চেতনার বর্ণময় দীপ্রশিখার ঔজ্জ্বলতা।
হে আমার অগ্নিদ্রোহী মৃত্তিকা,
তুমি চিরকাল মুক্ত থাকো। স্বর্গের বিহঙ্গডানা ঝেড়ে যাক
সাতটি আকাশ আর সাতটি সাগরের অববাহিকায়
আমি জেগে উঠি বারবার জ্বলন্ত সত্তার অগ্নিদাহে
পিতৃভূমি, হে আমার পিতৃভূমি, তোমার অস্তিত্ব
এবং অস্তিত্বের সমগ্রতায়
আমি অস্তিমান।
[আমার মৃত্তিকা এবং মৃত্তিকাবাসী]
পূর্বপুরুষের ঋণ তিনি অস্বীকার করেননি। তাদের অগ্নিময় অস্তিত্ব থেকেই উদ্ভূত তাঁর কবিসত্তা। তাই দেশ ও মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, দুঃসময় তাঁকে প্রতিবাদে সোচ্চার করে তোলে সকল প্রকার দুঃশাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে। তাঁর মানবিকতাবোধ দৈশিক পরিমণ্ডল পেরিয়ে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলকে অধিগ্রহণ করে। কোনো অন্যায়, অনাচার, অবিচার তিনি মুখ বুজে মেনে নিতে পারেন না। ভেতরের দ্রোহী সত্তার তুমুল গর্জনে তিনি সমুদ্রের মতোই ফুঁসে ওঠেন। সব সময় স্বদেশ স্বাধীনতা ও মানুষের অস্তিত্ব রার প্রশ্নে তিনি আপসহীন থেকেছেন। রাজনৈতিক জীবনে কারাভোগ করেছেন অনেকবার। তার পরও মাথা নত করেননি অপশক্তির কাছে। তাঁর রক্তের মধ্যে আপসকামী মনোভাব নেই। শৈশব থেকে পারিবারিক ঐতিহ্যই তাঁর এই অনড় মানস গঠনে সাহায্য করেছিল। তাঁর পিতা আবদুল হালিম জামানী ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে কয়েকবার কারাভোগ করেছেন। নাটক রচনা, প্রযোজনা ও অভিনয় দতায়ও তিনি সমকালে সমাদৃত হয়েছিলেন। তাঁর মাতার মধ্যে ছিল মরমি চেতনাবোধ। মাঝে মাঝে তিনি মগ্ন হতেন আধ্যাত্মিক সঙ্গীত রচনা ও সুর সংযোজনায়। পিতা-মাতার স্বতন্ত্র দুই ধারা থেকে রসদ গ্রহণ করে পরিপুষ্টি লাভ করেছে তাঁর সৃজনী সত্তা। বিকশিত হয়েছে তাঁর প্রতিভা। অতিলৌকিক জীবন ও জগৎ সম্পর্কেও তাই তাঁর অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস।
বিশ্বমিথের অনায়াস ব্যবহার তাঁর কবিতাকে আরো ঋদ্ধ করে তোলে। মিথের প্রচলিত মর্ম ভেঙে নতুন অর্থবোধক ব্যঞ্জনারসে সিক্ত হয় তাঁর কবিতা। শব্দের সচেতন প্রয়োগ দতাই তাঁকে ষাটের স্বতন্ত্র কাব্যভাষা নির্মাণের পথ করে দিয়েছে। কবিতার প্রতিটি পঙ্ক্তি বুননের মধ্যেই নিজেকে পাঠকের সামনে স্বতন্ত্র অবয়বে অস্তিমান করে তোলেন কবি আল মুজাহিদীÑ প্রেম ও দ্রোহের অবিমিশ্র আয়োজনে, চেতনার অগ্নিশিখার প্রজ্বলনে।