বিরোধী দলের সাম্প্রতিক আন্দোলনের মূল এজেন্ডা দুটি বলেই মনে হচ্ছে—তত্ত্বাবধায়ক সরকার, রাজনীতির ভাষায় নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, তাদের ভাষায় যেটা হতে হবে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ। ২৬ ডিসেম্বর বিভিন্ন পথসমাবেশে বেগম জিয়া আলোকচিত্র দেখিয়ে প্রমাণ দিয়েছেন যে একসময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ ও জোটের অন্য নেতারা কোনো কোনো অভিযুক্ত ও বিচারাধীন জামায়াত নেতার সঙ্গে দহরম-মহরম করেছেন। বিষয়টি আজ একটু তলিয়ে দেখতে চাই।
আওয়ামী লীগ মূলত আন্দোলন-সংগ্রামের ঐতিহ্যধারী একটি গণতান্ত্রিক দল হলেও তার স্বাভাবিক লক্ষ্য ছিল ক্ষমতায় যাওয়া এবং ক্ষমতায় গিয়ে নিজস্ব কর্মসূচি বাস্তবায়ন। কর্মসূচি বাস্তবায়নে ব্যর্থতা-দুর্বলতা-ভ্রান্তির সমালোচনা গণতন্ত্রেরই অংশ।
কিন্তু এখন এসব আলোচনা-সমালোচনার চেয়েও রাজনীতির অঙ্গনে মূল বিষয় হয়ে উঠেছে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কার এ দেশীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গ। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী স্বভাবতই এই বিচারের বিরুদ্ধে। বিএনপি নানা কথা বললেও কথার আড়ালের কথাটি হচ্ছে, তারাও এদের বিচার চায় না। অন্তত গত কিছুদিনের যৌথ কর্মসূচিতে বিএনপি যথেষ্ট সুযোগ দিচ্ছে জামায়াত ও শিবিরকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে বন্দী ও বিচারাধীন তাদের নেতাদের মুক্তির দাবি তোলার এবং একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বিচার-প্রক্রিয়া বন্ধ করার জন্য। এসব দাবিতে বিএনপির কর্মীরাও শরিক হচ্ছেন।
এবার বিষয়টিকে একটু ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে বিচারের চেষ্টা করব। দেখা যাচ্ছে, যেসব বড় বড় আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে এ দেশ ও জাতি এগিয়েছে, তার অধিকাংশই শুরুতে কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি ছিল না। দেশ ভাগের পর থেকে যে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়, তার সংগঠক ও প্রাথমিক আন্দোলনকারী শক্তি হচ্ছে ছাত্রসমাজ, আর এর আদর্শিক ভিত্তি সৃষ্টি এবং সৃষ্ট আন্দোলনকে প্রাথমিকভাবে বেগবান করেছে এ দেশের শিল্পী-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী সমাজ। যখন বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির পর রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে রূপান্তরের সুযোগ সৃষ্টি হয়, তখন সব রাজনৈতিক দলের জন্যই তাতে শরিক হওয়ার বা তার সঙ্গে একাত্ম হওয়ার দরজা খোলা ছিল। কিন্তু মুসলিম লীগ এর বিরোধিতা করেছে, যদিও সে দলের অনেক বাঙালি নেতা ও অনেক মুসলিম লীগ-ভাবাপন্ন বাঙালি বুদ্ধিজীবী ভাষা আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন।
আওয়ামী লীগ সেদিন সেই জায়মান আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হয়েছে এবং একপর্যায়ে এই রাজনীতির নেতৃত্ব দিয়েছে। আবার দেখুন, আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের সূচনা করেছে ছাত্রসমাজ বাষট্টির শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট-বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে। পাশাপাশি বুদ্ধিজীবী সমাজ দুই অর্থনীতির তত্ত্ব প্রকাশের মাধ্যমে বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরে এবং বুদ্ধিজীবী ও শিল্পীসমাজ সাংস্কৃতিক স্বাধিকারের পক্ষে নানা কার্যক্রম চালিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে দেশে একটা পরিবেশ তৈরি করেছিল। এর ফলে স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনের যে পটভূমি তৈরি হয়, তা মুসলিম লীগ বা ন্যাপ—সবার জন্যই উন্মুক্ত ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ তা গ্রহণ করে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিল এবং জনসমর্থনের দিক থেকে অন্যদের ছাপিয়ে গেল। অনেক পরে ন্যাপের বড় অংশ আওয়ামী লীগের পাশে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু তখন নেতৃত্ব পাওয়ার মতো আর অবকাশ ছিল না। আর একের পর এক গণমুখী ইস্যুর বিরোধিতা করে মুসলিম লীগ প্রথমে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি চালু করল এবং শেষে অবলুপ্তির পথে হারিয়ে গেল।
সাধারণত কোনো আন্দোলন যখন পথ তৈরি করে এগোতে থাকে, তখন এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ববর্তী অবস্থান থেকে দল ও নেতারা সরে আসেন। একসময় শাহ আজিজ, মাহমুদ আলী, নূরুল আমিনদের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে ঘনিষ্ঠতা ছিল অনেক আওয়ামী লীগের নেতার, এঁদের কেউ কেউ আওয়ামী লীগেও ছিলেন। কিন্তু সেই সময়কার ছবি দেখিয়ে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি কোলাবরেটরদের বন্ধু হিসেবে প্রচার করার চেষ্টা ধোপে টেকে না।
এবার বর্তমান প্রসঙ্গে আসি। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ছিল, কোলাবরেটর অ্যাক্ট বলবৎ হয়েছিল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছিল। এর মধ্যে সরাসরি খুন, জখম, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের মতো অপরাধের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিল না, কেবল আদর্শিকভাবে পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল, তাদের জন্য বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। তাঁর হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমান একে একে জামায়াতসহ নিষিদ্ধ দলগুলোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন ও তাদের রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসন করেন, দালাল আইন বাতিল করেন এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করে দেন। জিয়ার অনুসৃত পথেই এরশাদ দেশ পরিচালনা করেছিলেন। জিয়াউর রহমান নিজের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও শক্তি দাঁড় করানোর জন্য একদিকে নির্ভর করেছেন জামায়াতসহ পাকিস্তানপন্থী দল, ব্যক্তি ও নাগরিকদের ওপর; অন্যদিকে প্রধান প্রতিপক্ষ তথা তাঁর উত্থানের পথে সম্ভাব্য প্রধান বাধা হিসেবে আওয়ামী লীগকে টার্গেট করেছিলেন। তিনি গোলাম আযমকে এ দেশে নিয়ে আসেন, শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী বানান, যুদ্ধাপরাধী আবদুল আলীমকে মন্ত্রিত্ব দেন। দেশ পরিচালনায় তাঁর রাজনীতি হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ-কমিউনিস্ট পার্টির অধিকাংশ নেতা-কর্মী সে সময় জেলজুলুম, মামলা, হয়রানি ও নিপীড়নের শিকার হন। এ সময় থেকে রাজনীতিতে কালোটাকা ও পেশিশক্তির আমদানি হয়, ছাত্ররাজনীতিকে লেজুড়বৃত্তি, দখলদারি-টেন্ডারবাজিসহ নানা দূষণে কলুষিত করা হয়।
জিয়া-এরশাদ মিলে দীর্ঘ রাজনৈতিক বন্ধ্যাত্বের শেষ পর্যায়ে দেশের নাগরিক সমাজ যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন এবং ক্রমে তা রাজনৈতিক ইস্যুতে রূপান্তরিত হয়। আবারও এই রাজনৈতিক ইস্যু গ্রহণ করা হবে কি হবে না, সে দরজা সব রাজনৈতিক দলের জন্যই উন্মুক্ত ছিল। বিএনপি যদি ঘাতক-দালালদের বিচারের দাবিতে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন, গণ-আদালত বা অন্যান্য কর্মসূচিতে অংশ নিতে চাইত, তাহলে নিশ্চয় নির্মূল কমিটি তাতে বাধা দিত না।
আওয়ামী লীগ অতীতের মতোই ইস্যুটি গ্রহণ করেছে। আর ঠিক অতীতের মুসলিম লীগের মতোই বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপির সরকার তা গ্রহণ করেনি।
একাত্তরের ঘাতক-দালালবিরোধী আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার কর্নেল নুরুজ্জামান ও শহীদজননী জাহানারা ইমাম। এঁরা কেউ আওয়ামী লীগ ঘরানার মানুষ ছিলেন না। বিএনপি এ আন্দোলনে যুক্ত হতে চাইলে তাঁরা স্বাগত জানাতেন। তাঁরা ছাড়াও এতে প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী ও শিল্পী-সাহিত্যিকেরা এসে যুক্ত হন, প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলোও শরিক হয়। আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা এতে ব্যক্তিগতভাবে যুক্ত ছিলেন। ক্রমে এ আন্দোলন একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হলে বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকার এর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে শহীদজননীসহ ২৪ জন দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবীর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের মামলা ঠুকে দিয়েছিল। এভাবে বিএনপি সময়ের দাবি, ঐতিহাসিক ইস্যু এবং বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি রাজনৈতিক ইস্যুর বিরোধিতা করতে গিয়ে নিজেদের জন্য সমস্যা তৈরি করেছে।
একদিন ক্ষমতার জন্য জেনারেল জিয়া ও এরশাদ এ দেশের রাজনীতিকে অনেক পেছনে নিয়ে গিয়েছিলেন। সরকার-নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন কমিশন, গণমাধ্যমের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী জাতীয় চেতনার বিপরীতে পাকিস্তানি ধারার ইসলামি জাতীয়তার প্রবর্তন করতে গিয়ে তাঁরা ভাষা আন্দোলন থেকে সূচিত এ দেশের মূল রাজনৈতিক প্রাণপ্রবাহের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। রাজনীতিকে রাজনীতিকদের জন্য কঠিন করে তোলার ব্রত পালন করতে গিয়ে তাঁরা দমন-পীড়ন চালিয়েছেন প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তির ওপর আর শক্তি বাড়িয়েছেন পরাজিত ধর্মান্ধ শক্তির। সেই দুঃসময়ে রাজনীতিতে যে বিকার চলেছে, তাতে সব রাজনৈতিক দলে অনেক রকম বিপর্যয় ঘটেছে। কেউ গণতন্ত্রের ঐতিহ্য ছেড়ে স্বৈরাচারের সহযাত্রী হয়েছেন, কেউ অসাম্প্রদায়িকতার ঝান্ডা রেখে সাম্প্রদায়িক সরকারে যোগ দিয়েছেন, কেউবা আদর্শের পথ ছেড়ে ধান্দায় নেমেছেন।
সেদিন যে ঘোর দুঃসময় সৃষ্টি হয়েছিল রাজনৈতিক অঙ্গনে, তাতে অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে অনেক কিছুই হয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটে যদি মতিউর রহমান নিজামীর সঙ্গে শেখ হাসিনার বৈঠককে দেখি, তবে রাজনীতির এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করতে হয় জিয়া ও এরশাদ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকেই।
আমরা দেখছি, ১৯৯০ থেকে দীর্ঘ আন্দোলনের মাধ্যমে বুদ্ধিজীবী, শিল্পী-সাহিত্যিক ও প্রগতিশীল ছাত্রসমাজ যুদ্ধাপরাধ, ধর্মান্ধ রাজনীতির বিষয়ে যখন ইস্যু তৈরি করেছে এবং রাজনৈতিক দলের সামনে ইতিহাস সংশোধনের সুযোগ সৃষ্টি করেছে, তখন তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে বিএনপি, আর আওয়ামী লীগ তা গ্রহণ করেছে। এটি প্রায় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময়কার অবস্থা। সেদিন সরকারি দল মুসলিম লীগ ছাত্রদের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিল, আর আওয়ামী লীগসহ গণতান্ত্রিক দলগুলো ছাত্র-বুদ্ধিজীবীদের আন্দোলনে শরিক হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল।
এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, ছবি দেখিয়ে কিছু লোককে বিভ্রান্ত বা হতোদ্যম করা গেলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিটি একটি মস্ত বড় রাজনৈতিক ইস্যু তৈরি করেছে। তাতে ইতিহাসের প্রতিকূলে গিয়ে জয়লাভের স্বপ্ন সফল করা দুষ্কর। ইতিহাসের চাকা থামিয়ে দিয়ে সে কাজ করতে গেলে গণতন্ত্র ও দেশের ভবিষ্যৎ উভয়ই আরও গভীর সংকটে পড়বে।
লেখক: আবুল মোমেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।