ঢাকা (২৮ ডিসেম্বর) একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আসামি গোলাম আযমসহ অন্য জামায়াত নেতাদের মৃত্যুদণ্ড না দেওয়ার অনুরোধ করেছে তুরস্ক। সম্প্রতি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে লেখা চিঠিতে এ অনুরোধ জানান তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুল। তুরস্কের এ তৎপরতাকে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ‘হস্তক্ষেপ’ বলে মনে করছে।
গত বুধবার বাংলাদেশে নিযুক্ত তুরস্কের রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে আঙ্কারাকে ঢাকা জানিয়ে দিয়েছে, আবদুল্লাহ গুলের এ ধরনের তৎপরতা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল। আর বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলানোর নীতি মেনে চলবে তুরস্ক, এটাই বাংলাদেশের প্রত্যাশা।
যুদ্ধাপরাধের বিচার-প্রক্রিয়া শুরুর পর থেকে এই প্রথম কোনো দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে সরাসরি এ বিষয়ে ‘হস্তক্ষেপ’ করল। তুরস্কের প্রেসিডেন্টের চিঠিটি ১৭ ডিসেম্বর আঙ্কারা থেকে পাঠানো হয়। ২৩ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পৌঁছে দেয় ঢাকায় তুরস্কের দূতাবাস। গতকাল বৃহস্পতিবার চিঠি দুটি বঙ্গভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র প্রথম আলোকে জানিয়েছে।
এদিকে তুরস্কের প্রেসিডেন্টের চিঠির পাশাপাশি ‘অন অ্যারাইভাল’ ভিসার (আগমন-পরবর্তী ভিসা) অপব্যবহার করে তুরস্কের একটি এনজিও প্রতিনিধিদলের বাংলাদেশ সফর নিয়েও অসন্তুষ্ট ঢাকা। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, যুদ্ধাপরাধের বিচারে তুরস্কের হস্তক্ষেপকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে। এরই জের ধরে গত বুধবার ঢাকায় তুরস্কের রাষ্ট্রদূত মেহমুত ভারকুল ইরকুলকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে সরকারের অসন্তুষ্টির কথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর পাল্টা হিসেবে গতকাল আঙ্কারায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জুলফিকার রহমানকে তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়। তাঁকে তুরস্কের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন সে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ওমর অনহুন।
তুরস্কের তৎপরতা সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ফারুক চৌধুরী বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এখনো যুদ্ধাপরাধের মামলার রায় দেননি। এমন অবস্থায় তিনি (আবদুল্লাহ গুল) যে অনুরোধটি করেছেন, তা অস্বাভাবিক। কারণ প্রতিটি দেশেরই আইনের নিজস্ব গতি রয়েছে। এ ধরনের অনুরোধ আইনকে ব্যাহত করার শামিল।
তুরস্কের প্রেসিডেন্টের সমালোচনা করে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব বলেন, তুরস্কে এখনো অনেক রাজবন্দী রয়েছেন। নিপীড়নমূলক আচরণের জন্য সে দেশের পুলিশের কুখ্যাতি রয়েছে। আর বিরোধী দলকে তুরস্কে সব সময় কঠোরভাবে দমন করা হয়। তুরস্কে যখন এ পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তখন আবদুল্লাহ গুল যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে যে চিঠি লিখেছেন, সেটি মোটেই প্রত্যাশিত নয়।
ফারুক চৌধুরী আরও বলেন, তুরস্কে ইসলামপন্থী ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক শিবিরের বিরোধ নতুন নয়। আর ক্ষমতাসীন দলের প্রতিনিধি হিসেবে সে দেশের ইসলামপন্থী গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করতেই আবদুল্লাহ গুল এ চিঠি লিখে থাকতেও পারেন।
গুলের চিঠি: কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, তুর্কি ভাষায় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে এক পৃষ্ঠার চিঠি লেখেন আবদুল্লাহ গুল। চিঠির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে এর ইংরেজি অনুবাদ। চিঠিতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট লিখেছেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অন্যদের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের বিচার চলছে। প্রায় ৯০ বছর বয়সী এই নেতা মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি বলে শোনা যাচ্ছে। তিনিসহ আরও বেশ কিছু বয়োজ্যেষ্ঠ ইসলামপন্থী নেতা বিচারের মুখোমুখি রয়েছেন, যা অত্যন্ত উদ্বেগের।’
তুরস্কের প্রেসিডেন্টের মতে, যুদ্ধাপরাধের বিচার-প্রক্রিয়ার কারণে অর্থাৎ শীর্ষ ইসলামপন্থী নেতাদের শাস্তি দেওয়া হলে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক আর্থসামাজিক অগ্রগতি ব্যাহত হতে পারে। এর ফলে সামাজিক অস্থিতিশীলতা ও রক্তপাতের আশঙ্কা রয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরও ক্ষুণ্ন হতে পারে।
গুল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে ‘ক্ষমা প্রদর্শন’ নীতি অনুসরণের অনুরোধ জানিয়েছেন। গোলাম আযমসহ অন্য নেতাদের মৃত্যুদণ্ড রোধ করার বিষয়টি বিবেচনার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন।
তুরস্কের এ অবস্থান নতুন নয়: কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, আবদুল্লাহ গুলের চিঠি এবং মিথ্যা পরিচয় দিয়ে তুরস্কের এনজিও প্রতিনিধিদলের সফর নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হলেও যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে দেশটির এ অবস্থান নতুন নয়। ২০১১ সালের মে মাসে ইস্তাম্বুলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে বৈঠকে বিষয়টি ভুলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। আর এ বছরের এপ্রিলে আঙ্কারায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান একই অনুরোধ করেন।
সরকারের অবস্থান: তুরস্কের প্রেসিডেন্টের চিঠি এবং মিথ্যা পরিচয় দিয়ে সে দেশের এনজিও প্রতিনিধিদলের ঢাকা সফরে বাংলাদেশ যে উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ, তা তুরস্ককে কড়া ভাষায় জানানো হয়েছে। গত বুধবার সকালে ঢাকায় তুরস্কের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়। এ সময় তাঁর কাছে ক্যানসুয়ু এইড অ্যান্ড সলিডারিটি অ্যাসোসিয়েশনের বাংলাদেশ সফরে ঢাকায় তুর্কি দূতাবাসের যুক্ত হওয়ার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। এ ছাড়া তুরস্কের প্রেসিডেন্টের লেখা চিঠি সম্পর্কেও তাঁর কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। চিঠির বিষয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে সম্ভাব্য যেসব জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে, তার পরিপ্রেক্ষিতে বন্ধুপ্রতিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে পরামর্শ দিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট।
তবে তুরস্কের রাষ্ট্রদূতের ব্যাখ্যায় মোটেই সন্তুষ্ট হতে পারেনি বাংলাদেশ। তুরস্ককে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, কূটনৈতিক শিষ্টাচারের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোনো রকম আগাম সংবাদ না দিয়েই তুরস্কের এনজিও প্রতিনিধিদলের ঢাকায় আগমন বাংলাদেশের কাছে ‘অসৌজন্যমূলক’ মনে কহয়েছে। রাজধানীতে পাঁচ দিনের অবস্থানে প্রতিনিধিদলটি অস্বাভাবিক তৎপরতায় জড়িয়ে পড়ে। ঢাকায় তুরস্কের দূতাবাসও সার্বক্ষণিকভাবে তাদের সব কর্মসূচিতে অংশ নেয়। দূতাবাসের এ ভূমিকা অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক। তাই পুরো বিষয়টিতে তুরস্কের সরকারের ভূমিকা নিয়ে সংগত কারণেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশের চিঠিতে বলা হয়, এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ কঠোর ভাষায় বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র তুরস্কের এ ধরনের তৎপরতার নিন্দা জানায়। দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অব্যাহত রাখার স্বার্থে ভবিষ্যতে এ ধরনের অপ্রত্যাশিত তৎপরতা রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয় চিঠিতে।