সাহিত্য ডেস্ক(২৫ডিসেম্বর)
: বিখ্যাতব্যক্তিদের নিয়ে আমাদের কৌতূহলের শেষ নেই। মাঝে মধ্যে তাদের সম্পর্কে এমনঅনেক ঘটনা প্রচারিত হয় যার কিছুটা হয়তো সত্যি, বেশিরভাগই অতিরঞ্জন। আলবার্টআইনস্টাইন সম্পর্কেও সে রকম অনেক কথা প্রচলিত আছে। সর্বকালের অন্যতম সেরা এবিজ্ঞানীর জন্ম ১৮৭৯ সালের ১৪ মার্চ। তিনি মৃত্যুবরণ করেন ১৯৫৫ সালের ১৮এপ্রিল। আইনস্টাইনকে নিয়ে অনেক মজার এবং অতিরঞ্জিত কথা প্রচলিত রয়েছে।যেগুলোর বেশিরভাগই সত্য নয়। যেমন- জন্মের সময় নাকি আইনস্টাইনের মাথা ছিলস্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি বড়। জন্মের সময় শিশুর মাথার আকার ছোট-বড় হতেইপারে। আইনস্টাইনের মাথার সাইজের মাথা নিয়ে অনেক শিশু জন্ম নিচ্ছে প্রতিদিন।তাদের সবাই যে আইনস্টাইন হচ্ছে, তা নয়। আলবার্ট অনেক দেরিতে কথা বলতে শুরুকরেছিলেন- এ প্রসঙ্গেও নানা রকম তথ্য পাওয়া যায়। অনেকে বলেন, আইনস্টাইনকথা বলতে শুরু করেছেন চার বছর বয়সে, তাও একেবারে পূর্ণ বাক্য দিয়ে। এটাওঅতিরঞ্জন। ধারণাটি এ রকম আইনস্টাইন কথা বলতে শুরু করেন ৪ বছর বয়সে, তার আগপর্যন্ত তিনি কোনো কথা বলেননি। একদিন খাবার টেবিলে হঠাৎ করেই নীরবতা ভেঙেবলে ওঠেন, স্যুপটা অনেক গরম। তাকে কথা বলতে দেখে অবাক বিস্ময়ে তার বাবা-মাজানতে চান, কথা বলতে পারা সত্ত্বেও এতদিন তিনি কেন কথা বলেননি। আইনস্টাইনেরজবাব, এতদিন কথা বলার প্রয়োজন পড়েনি। উল্লেখ্য, প্রচলিত এ ধারণাটিএকেবারেই সঠিক নয়।
বিশিষ্ট ব্যক্তিরা লেখাপড়ায় সাধারণ মানের হলেআমরা অতি সাধারণরা তা খুব মনে রাখি। আলবার্ট আইনস্টাইনও যে স্কুল-কলেজেরলেখাপড়ায় খুব একটা আহামরি কিছু ছিলেন না, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েভর্তি-পরীক্ষায় একবার ফেল করেছিলেন, তাও খুব যত্ন করে বিভিন্ন গণমাধ্যমেপ্রচারিত হয়। দেখা যাক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় কেমন করেছিলেনআইনস্টাইন। আলবার্ট আইনস্টাইন ১৭ বছর বয়সে স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা পাসকরেন ক্যান্টন আরগাউ স্কুল থেকে। তার স্ট্কুল পাসের সার্টিফিকেটে দেখা যায়, ক্যান্টন আরগাউ শিক্ষা বোর্ড এই মর্মে প্রত্যয়ন করছে যে, আলবার্টআইনস্টাইন আরগাউ ক্যান্টন স্কুলের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর টেকনিক্যালকোর্সে অধ্যয়ন করেছেন। ১৮৯৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১৮, ১৯, ২১ ও ৩০ তারিখেঅনুষ্ঠিত লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ভিত্তিতে তার প্রাপ্ত নম্বর জার্মান ৫, ফ্রেঞ্চ ৩, ইংরেজি ৫, ইতালিয়ান ৫, ইতিহাস ৬, ভূগোল ৪, গণিত ৬, জ্যামিতি ৬, বর্ণনামূলক জ্যামিতি ৬, পদার্থবিজ্ঞান ৬, রসায়ন ৫, প্রাকৃতীক ইতিহাস ৫ এবংশৈল্পিক অঙ্কন ৪। তখনকার হিসাব মতে, কোনো বিষয়ে গ্রেড ৬ হলো সর্বোচ্চগ্রেড। দেখা যাচ্ছে, আইনস্টাইন ভালো ছাত্রদের দলেই ছিলেন। স্কুলে ইংরেজিভাষা তিনি পড়েননি কখনও। বিদেশি ভাষা ফ্রেঞ্চ ও ইতালিয়ান পড়েছিলেন।ইতালিয়ানে ভালোই করেছিলেন। ফ্রেঞ্চ খুব একটা ভালো করেননি। এ ছাড়া দেখাগেছে, পদার্থ, জ্যামিতি, বর্ণনামূলক জ্যামিতি, গণিতে ৬ গ্রেডের মধ্যে ৬পেয়েছিলেন তিনি। সে হিসেবে এসব বিষয়ে কখনও দুর্বল ছাত্র ছিলেন নাআইনস্টাইন। তবে স্কুলের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে মোটেও সন্তুষ্ট ছিলেন নাতিনি। স্কুলের শিক্ষকরা মিলিটারি কায়দায় জোর করে মাথার ভেতর পড়ালেখাঢোকানোর চেষ্টা করবেন আর শিক্ষার্থীরা বাঁধ্য হয়ে শিক্ষকদের আদেশ-নিষেধমেনে চলবে- এটা তার কোনোদিনই ভালো লাগেনি। নিজের বুদ্ধিবৃত্তির ওপর নির্ভরকরতে গিয়ে স্কুলে আলবার্টকে অনেক অপমান সইতে হয়েছে। তাই স্কুলিং সিস্টেমেরওপরই তার আস্তা চলে গিয়েছিল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সনদ লাভের জন্য প্রচলিতপরীক্ষা পদ্ধতির ঘোর বিরোধী ছিলেন। কী রকম হওয়া উচিত পরীক্ষা পদ্ধতি? এপ্রশ্নের উত্তরে আইনস্টাইন বলেছিলেন, সারা বছর পাঠদানের পর শিক্ষার্থীরাএকটা থিসিস বা এ রকম কিছু লিখবে এবং তা দেখে ডিগ্রি দিয়ে দেওয়া হবে। মজারব্যাপার হলো, আইনস্টাইনের এ পদ্ধতি আসলে কোনো কার্যকর পদ্ধতি ছিল না। তিনিসিস্টেমের বিরোধিতা করলেও নিজের পছন্দমতো কোনো সিস্টেম চালু করার তত্ত্বদিতে পারেননি। এমনকি প্রথম জীবনে স্কুল শিক্ষকতা করেছিলেন।
আইনস্টাইনেরঈশ্বর বিশ্বাস নিয়েও নানারকম মতবাদ চালু আছে। ঈশ্বর বিশ্বাসীরা যখন ধর্মেরসঙ্গে বিজ্ঞানের বিরোধ নেই প্রমাণ করতে চান কিংবা বলতে চান যে, বিজ্ঞানেধর্মের প্রয়োজন আছে তখন আইনস্টাইনের একটা বাক্য খুব প্রচার করেন আর তা হলো, ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান খোঁড়া আর বিজ্ঞান ছাড়া ধর্ম অন্ধ। অনেক কিছুর ব্যাপারেআইনস্টাইন খোলামেলা কথা বললেও ঈশ্বর বিশ্বাসের ব্যাপারে তিনি খোলাখুলিবলেননি তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, নাকি করেন না। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মেবিশ্বাস করেন না বলেছেন ঠিকই, কিন্তুু ইহুদি ধর্মের ব্যাপারে তিনি অনেককিছু করেছেন। উচ্চমার্গের ঈশ্বর বিশ্বাস তার সবসময় ছিল। আবার ধর্মের নামেমিলিটারি কায়দায় ধর্মের অনুশাসন মেনে চলার ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। অনেকেইআইনস্টাইনকে থিওরি অব রিলেটিভিটির মূল স্রষ্টা বলে মনে করেন। এটি একটি ভুলধারণা। এই ধারণাটি আসলে বিভিন্ন বিজ্ঞানীর বিভিন্ন সময়ের আবিষ্কার থেকেআস্তে আস্তে মানুষের সামনে আসতে থাকে। তবু বিখ্যাত বিজ্ঞানী ম্যাক্সপ্ল্যাঙ্ক [১৯০৮ সালে] প্রথম এটি সম্পর্কে ধারণা দেন। আইনস্টাইন তাকেবিস্তৃত করে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়েছেন। আলো তরঙ্গ নাকি ইথার তা নিয়ে গবেষণারমধ্যেই লালিত হয়েছে এই থিওরি অব রিলেটিভিটি। মজার কথা হলো, আইনস্টাইনকিন্তুু নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন এই আলোক-তড়িৎক্রিয়া সম্পর্কিত বিষয় নিয়েগবেষণা করার জন্য। ১৯৩৯ সালে জার্মানিতে নাৎসি বাহিনীর উত্থানের সময়পদার্থবিদ লিও জিলার্ডের পরামর্শ মতে, পরমাণু বোমা গবেষণার জন্য মার্কিনপ্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে উৎসাহ দেন আইনস্টাইন। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, নাৎসিবাহিনীর তৎপরতা থামাতে পরমাণু বোমা আবিষ্কারের গবেষণায় মনোযোগ দেওয়া উচিত।
এতে তিনি সতর্ক করে দেন, জার্মানিতে নাৎসি বাহিনী এটি গবেষণা করতেপারে তার আগেই যুক্তরাষ্ট্রের উচিত এটি নিয়ে গবেষণা করা। এ চিঠিটিআইনস্টাইন লিখেছিলেন ঠিকই, কিন্তু এ চিঠি লেখার পর রুজভেল্ট পরমাণু বোমাবানানোর জন্য গোপন ম্যানহাটন প্রজেক্ট শুরু করলেও বোমা সফলভাবে আবিষ্কারকরা হয় পার্ল হারবারে। তবে বিখ্যাত পদার্থবিদ হওয়া সত্ত্বেও নিরাপত্তাঝুঁকির কারণে আইনস্টাইনকে মার্কিন সেনাবাহিনীর ওই প্রজেক্টে আমন্ত্রণজানায়নি মার্কিন সেনাবাহিনী। অথচ অনেকেই বলেন, ওই গবেষণায় সহায়তা করেছিলেনতিনি। সুন্দরী অভিনেত্রী মেরিলিন মনরো আইনস্টাইনের প্রতি দুর্বল ছিলেন। তাইএকদিন মনরো আইনস্টাইনকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন এভাবে, ‘ চলুন না, আমরা বিয়েকরে ফেলি? তাহলে আমাদের সন্তানরা হবে সৌন্দর্য ও জ্ঞানে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠসন্তান। ওরা দেখতে আমার মতো আর বুদ্ধিতে আপনার মতো। ‘ আইনস্টাইন তৎক্ষণাৎবললেন, আর যদি উল্টোটা হয়? দেখতে আমার মতো আর বুদ্ধিতে আপনার মতো? বিশ্বব্যাপী বহুল প্রচলিত একটি কৌতুক এটি। তবে এটিকে গুজব বলে মনে করা হয়তা জানেন না অনেকেই। আপেক্ষিকতা তত্ত্বের মতো রহস্যময়তার মধ্যেই মৃত্যু ঘটেবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের। তার মৃত্যুর সময় তিনি মাতৃভাষা জার্মানে কিছু একটাবলে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তখন তার পাশে থাকা আমেরিকান নার্স কথাটিরবিন্দুবিসর্গও বুঝতে পারেননি। এ ধারণার সপক্ষেও তেমন কোনো প্রমাণ পাওয়াযায়নি।
সংকলিত