শিক্ষা ডেস্ক(২৫ ডিসেম্বর):নিয়োগ বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে উপাচার্যসহ তিন কর্মকর্তার পদত্যাগ দাবিতেঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া এলাকার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ক্যাম্পাসে তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে অচলাবস্থা বিরাজ করছে। অচলাবস্থানিরসনের কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় ক্যাম্পাস ও ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থানরতশিক্ষার্থীরা গভীর সংকটে পড়েছেন। অন্যদিকে এই অচলাবস্থার কারণে ২০১২-১৩শিক্ষাবর্ষের সম্মান প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষাও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এতেভর্তিচ্ছু প্রায় ৯০ হাজার শিক্ষার্থীও দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। এদিকেঅচলাবস্থার নিরসন ও ক্লাস পরীক্ষা শুরুর দাবিতে তিনদিনের সময় বেঁধে দিয়েছেনআন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মঙ্গলবার থেকে ১১ দিনেরজন্য বড়দিন ও শীতকালীন ছুটি ঘোষণা করেছে। তবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সেইছুটি প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন।
খোঁজনিয়ে জানা যায়, গত ১৯ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন রমজান মাস ও ঈদ, জন্মাষ্ঠমী, শোক দিবস ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যু দিবস উপলক্ষে৩৫ দিন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে। সে সময় ১৯ জুলাই থেকে ১২ আগস্টপর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অফিস খোলা রেখে নিয়োগ বোর্ডের কার্যক্রমশুরু করে। কিন্তু ব্যাপক অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয়কর্মকর্তাদের নিয়োগ বাণিজ্য ও দলীয়করণের অভিযোগে প্রথমে ৫, ৬ ও ৭ আগস্টেরনিয়োগ বোর্ড স্থগিত করা হয়। পরবর্তী সময়ে ২৯ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পরপ্রশাসন পুনরায় নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করে এবং ৭ ও ৮ সেপ্টেম্বর শিক্ষক ওকর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের জন্য সিন্ডিকেট বৈঠক করে। এতে ৯৮ জনের বিপরীতে১২৬ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। শিক্ষক-কর্মকর্তা ও আন্দোলনকারীরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদন ছাড়াই অবৈধভাবে এই নিয়োগ দেওয়াহয়।সিন্ডিকেটের পর প্রগতিশীল শিক্ষকদের সংগঠন বঙ্গবন্ধু পরিষদ ওবিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি উপাচার্য ড. এম আলাউদ্দিন, উপ-উপাচার্য ড.কামাল উদ্দিন ও ট্রেজারার প্রফেসর ড. শাহজাহান আলীর বিরুদ্ধে নিয়োগ নিয়েঅর্থবাণিজ্য, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ আনে। একই সঙ্গে তাঁদেরপদত্যাগ দাবি করে ওই দিন থেকে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন শুরু করে। এরপর তিন মাসপার হলেও ক্যাম্পাসের অচলাবস্থা নিরসনে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। এতেবিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের প্রায় পাঁচ শতাধিক চূড়ান্ত পরীক্ষা স্থগিতহয়ে গেছে। আগেই এক থেকে তিন বছর সেশন জটে থাকা শিক্ষার্থীরা বাড়তি আরো একবছরের জটের সম্মুখীন হতে যাচ্ছেন। কোনো কোনো বিভাগের শিক্ষার্থীরা ফলপ্রকাশ না হওয়ায় চাকরির জন্য আবেদন করতে পারছেন না।
বিশ্ববিদ্যালয়েরশিক্ষার্থীরা জানান, গত ১৭ নভেম্বর ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে সম্মান প্রথমবর্ষের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও নিয়োগ বাণিজ্যকে কেন্দ্রকরে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও ট্রেজারার হটানোর দাবিতে শিক্ষক সমিতি ওবঙ্গবন্ধু পরিষদের আন্দোলনের মুখে প্রথম বর্ষের ভর্তি প্রক্রিয়াঅনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। এতে ভর্তির জন্য আবেদন করা ভর্তিচ্ছুপ্রায় ৯০ হাজার শিক্ষার্থী বিপাকে পড়েছেন। দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েএমনকি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি পরীক্ষা শেষ করে ভর্তি কার্যক্রম শুরুহলেও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন পর্যন্ত ভর্তি পরীক্ষা সংক্রান্ত কোনোপদক্ষেপ না নেওয়ায় শিক্ষার্থীরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। এদিকে চলমান আন্দোলনসহবিভিন্ন ঘটনার কারণে ক্যাম্পাস অচল থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীসহ বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতাপরিশোধ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব গাড়ির জ্বালানি ও ভাড়াকৃত গাড়ির ভাড়াপরিশোধ করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাখ লাখ টাকা ব্যয় হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়েরএকাধিক সূত্র জানিয়েছে, বঙ্গবন্ধু পরিষদ ও শিক্ষক সমিতির দাবি অনুযায়ীউপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও ট্রেজারার পদত্যাগ করার নৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়ার কথাশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানালেও তারা এখন পর্যন্ত পদত্যাগ না করায় এ নিয়েক্যাম্পাসে ধূম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে। আন্দোলনের কারণে বেশ কিছু দিন ধরে এইতিন কর্মকর্তা ক্যাম্পাসে উপস্থিত হচ্ছেন না। তাঁদের পদত্যাগের দাবিতেশিক্ষকদের আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে এবং ইতোমধ্যে এই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতাপ্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পদ থেকে ২০ জন কর্মকর্তা পদত্যাগকরেছেন।
চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে আন্দোলনকারী শিক্ষকরা ক্যাম্পাসেরপ্রশাসন ভবনের সামনে সমাবেশ করে ঘৃণা দিবস পালন করেছেন। এ সময় তাঁরাউপাচার্যসহ তিন কর্মকর্তার কুশপুত্তলিকায় থুথু নিক্ষেপ করে তা দাহ করেছে।অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষার্থীরাও ক্যাম্পাসের ফটকে যেকোনো মূল্যে ক্যাম্পাসেরঅচলাবস্থা নিরসন করে অবিলম্বে ক্লাস পরীক্ষা শুরুর দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন।এ ছাড়া শিক্ষকদের আন্দোলনের কারণে পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়কর্মকর্তা সমিতির কার্যনির্বাহী পরিষদের নির্বাচন ২০১৩ স্থগিত করা হয়েছে।সোমবার সকালে প্রশাসনিক ভবনে তালা দিয়ে সমাবেশ এবং ক্যাম্পাসে বিক্ষোভমিছিল করে শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনেখুলনা-কুষ্টিয়া সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করে। আন্দোলন চলাকালে বেলা ১টারদিকে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক সৈয়দ বেলাল হোসেন ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে সাধারণশিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে তিনদিনের মধ্যে ক্লাস পরীক্ষা চালুর আশ্বাসদিলে অবরোধ তুলে নেয় শিক্ষার্থীরা।
ক্লাস পরীক্ষা চালুর দাবিতেআন্দোলনরত ‘সাধারণ ছাত্র সমাজ‘ এর আহ্বায়ক ইংরেজি চতুর্থ বর্ষের ছাত্রমোহাম্মদ সেলিম বলেন, তিনদিনের মধ্যে সমস্যার সমাধান না হলে শীতকালীন ছুটিরমধ্যেই শিক্ষার্থীরা আবার আন্দোলনে নামবে। তখন আরো কঠোর কর্মসূচি দেয়াহবে। শীতকালীন ছুটি শিক্ষার্থীরা প্রত্যাখ্যান করেছেন বলেও দাবি করেন এছাত্রনেতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আক্তারুল ইসলাম জিল্লু বলেন, সরকারেরউচ্চমহলের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। আপাততপরিস্থিতি শান্ত। বড়দিন ও শীতকালীন ছুটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে মঙ্গলবারথেকে ১১ দিনের জন্য বড়দিন ও শীতকালীন ছুটি ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। ৭জানুয়ারি ক্লাস ও পরীক্ষা পুনরায় শুরু হবে। তবে বড়দিন ও শীতকালীন ছুটি শেষেপ্রশাসনিক অফিস খুলবে আগামী ২ জানুয়ারি।
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষক সমিতির সভাপতি প্রফেসর ড. ইয়াকুব আলী বলেন, ৩৭ কোটি টাকা বাজেটঘাটতি এবং পর্যাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকা সত্ত্বেও উপাচার্যসহবিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতিবাজ তিন কর্মকর্তা নিয়োগের নামে কোটি টাকা হাতিয়েনিয়েছেন। তাই তাঁদের পদত্যাগ বা অপসারণ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলনঅব্যাহত থাকবে। কোনো হুমকি-ধমকি দিয়ে এই আন্দোলন দমানো যাবে না।
এব্যাপারে উপাচার্য ড. এম আলাউদ্দিন বলেন, পদত্যাগ করার মতো কোনো ঘটনাঘটেনি। সরকার বললে আমি পদত্যাগ করব। অন্য দুই কর্মকর্তা উপ-উপাচার্য ড.কামাল উদ্দিন ও ট্রেজারার প্রফেসর ড. শাহজাহান আলীর সঙ্গে একাধিকবারযোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁদের অফিস, বাসা বা টেলিফোনে পাওয়া যায়নি।
নিউজরুম