ঢাকা (২৪ ডিসেম্বর) : বছর দুয়েক আগেও যারা পদ্মাসেতু প্রকল্পে কাজ পেতে কিংবা সংশ্লিষ্ট হতে জোর চেষ্টা করেছেন, এবার তাদের অনেকেই এ প্রকল্প ছাড়তে চাইছেন। সরকার যখন দাতাগোষ্ঠী বিশ্বব্যাংককে ফেরানোর চেষ্টা করছে, তখন প্রকল্প থেকেই সরে যেতে চাইছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
পদ্মাসেতু প্রকল্প থেকে মুক্ত হতে তারা তদবির করছেন সরকারের উচ্চ পর্যায়ের মহলে। এসব তথ্য জানায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্র।
সূত্র জানায়, দুদক আতঙ্কেই প্রকল্প থেকে সরে যেতে চাইছেন তারা। দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে সম্প্রতি দায়ের হওয়া মামলার তদন্তের অংশ হিসেবে পদ্মাসেতু প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগ সংক্রান্ত দরপত্র ও মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশসহ যাবতীয় নথিপত্র জব্দের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক।
সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট নথিপত্র চেয়ে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও সেতু বিভাগে চিঠি দিয়েছেন তদন্ত কমিটির প্রধান ও দুদকের জ্যেষ্ঠ উপ-পরিচালক আবদুল্লাহ আল জাহিদ। চিঠিতে নথিপত্র সরবরাহে সাত কর্মদিবস সময় দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। দুদক মনে করছে, এসব নথিতে আরও অনেকের দুর্নীতির তথ্য বেরিয়ে আসতে পারে। নথিপত্রে যাদের সন্দেহ করা হবে, দুদকে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এসব কারণে প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত অনেকেই দুদক আতঙ্কে প্রকল্প ছাড়তে নানা তদবির করছেন।
প্রকল্প ছাড়তে চাওয়ার কারণ জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, “যেহেতু প্রকল্পের সঙ্গে জড়িতদের কয়েকজনের নামে মামলা হয়েছে, তাই যত দ্রুত সম্ভব এ প্রকল্প থেকে মুক্ত থাকাই ভালো।”
তিনি বলেন, “প্রকল্পের অনেকেই আছেন জিজ্ঞাসাবাদ আতঙ্কে। ফাইলে স্বাক্ষর করার কারণে হয়রানি হতে হয়েছে অনেককেই। অনিয়মের অভিযোগে ফেঁসে যাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। অথচ রেহাই পাচ্ছেন নীতি-নির্ধারকরা।”
তদন্ত কমিটির প্রধান আবদুল্লাহ আল জাহিদ বলেন, “তদন্তের স্বার্থে আইন অনুযায়ী জব্দের নির্দেশ রয়েছে। তদন্তে অগ্রগতির জন্যই মূলত নথি তলবের উদ্যোগ নিয়েছি।”
জানা গেছে, সেতু বিভাগের স্টাফসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা থেকে প্রেষণে আসা কর্মকর্তারাও এখন এ প্রকল্প ছাড়তে মন্ত্রী ও সচিব পর্যায়ে তদবির করছেন।
একাধিক সূত্র জানায়, গত বুধবার রেলপথ সচিব মাহবুব উর রহমানের সঙ্গে দেখা করে বদলির তদবির করেন এ প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মঞ্জুরুল ইসলাম। তিনি রেল ক্যাডারের কর্মকর্তা। আরেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (সেতু) কাজী মো. ফেরদৌস বর্তমানে দুদকের মামলার পলাতক আসামি। প্রকল্পের অনেকেই আছেন জিজ্ঞাসাবাদ আতঙ্কে।
সেতু বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, পদ্মাসেতুর নির্মাণ কাজ এখনও শুরু হয়নি। তবে বর্তমানে ৯২ কর্মকর্তা-কর্মচারী পদ্মা প্রকল্পে কর্মরত। এ প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত অধিকাংশেরই সময় কাটে অবসরে।
জানা গেছে, পদ্মাসেতু প্রকল্পে বর্তমানে কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে প্রকল্প পরিচালক ছাড়াও রয়েছেন দুই জন অতিরিক্ত পরিচালক, তিনজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, তিনজন নির্বাহী প্রকৌশলী এবং তিনজন উপ-পরিচালক। এছাড়া রয়েছেন সহকারী প্রকৌশলী, সহকারী পরিচালক, উপ-সহকারী প্রকৌশলী এবং উপ-সহকারী পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তা। বাকিদের অধিকাংশই কর্মচারী। এর মধ্যে রয়েছেন কম্পিউটার অপারেটর, সার্ভেয়ার, কানুনগো, ডাটা এন্ট্রি অপারেট, ড্রাইভার, চেইনম্যান এবং এমএলএসএস।
পদ্মাসেতুর পরামর্শক যাচাই প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গত ১৭ ডিসেম্বর সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে প্রধান আসামি করে মোট সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। মামলার এজাহারে সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী এবং তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে রাখা হয় সন্দেহভাজন তালিকায়। তবে এ দু’জনের নাম এজাহারে থাকলেও তাদের আসামি করা হয়নি।
দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের সঙ্গে ৯ জনের নাম থাকলেও দু’জনকে সন্দেহভাজন তালিকায় রেখে সরকারি ৩ কর্মকর্তা এবং কানাডীয় প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের ৪ জনসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।
পদ্মাসেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক কর্তৃপক্ষ ১শ’ ২০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল করে গত ২৯ জুন।
পরে সরকার অভিযোগ অনুসন্ধানে বিশ্বব্যাংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি সই করার পর ‘শর্তসাপেক্ষে’ বিশ্বব্যাংক আবার অর্থায়নে ফিরে আসার ঘোষণা দেয় গত ২০ সেপ্টেম্বর।
গত ৮ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর এ্যালেন গোল্ড স্টেইন বলেছিলেন, দুর্নীতির অভিযোগের পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ তদন্ত হলেই কেবল এ প্রকল্পে অর্থ মিলবে। মামলার পর ১৮ ডিসেম্বর আরেক বিবৃতিতে অ্যালেন জানিয়েছেন, এজাহার পর্যবেক্ষণের পর বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দলের প্রতিবেদনের ওপর অর্থায়ন নির্ভর করছে।
নিউজরুম