নিতাকাত বা সৌদিকরণ প্রক্রিয়ায় আটকে গেছে বাংলাদেশিসহ সব প্রবাসী শ্রমিকের ভাগ্য। অতিরিক্ত টাকা দিয়েও তারা নবায়ন করতে পারছে না সোনার হরিণ নামের ইকামা। আর ইকামা নবায়নের সময়সীমা অতিক্রম হয়ে যাওয়ায় সৌদি আরবে অবস্থানরত এসব প্রবাসী শ্রমিকরা দলে দলে চাকরি হারাচ্ছেন এখন। একই কারণে ছুটিতে বা বৈধভাবে দেশে ফিরতে পারছেন না অনেকেই। আবার অনেকে, যারা পরিবার নিয়ে প্রবাসে আছেন, তারা পড়েছেন মহাবিপাকে।
জানা যায়, নিতাকাত বা সৌদিকরণ প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর থেকে নিয়মিত স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ইকামা নবায়ন করতে পারছেন না প্রবাসীরা। নিতাকাতের শর্তপূরণ না হওয়া, বার্ষিক যাকাত পরিশোধ না করাসহ বিভিন্ন কারণে সৌদি নাগরিকদের হাজার হাজার কম্পিউটার নেটওয়ার্ক (লেবার কোর্টের সদস্যপদ) লক করে দেয়া হয়েছে সরকারের তরফ থেকে। এবং তাদের কম্পিউটার চালু করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন শর্ত আরোপ করা হয়েছে। যার অন্যতম হচ্ছে, বিদেশি শ্রমিকদের সমসংখ্যক সৌদি নিয়োগ এবং যাকাতসহ সরকারের আনুসাঙ্গিক কর পরিশোধ।
অনেক সৌদি তাদের কম্পিউটার খোলার জন্য হাতিয়ার হিসাবে বেঁচে দিয়েছেন তার অধিনস্থ আমেলদের (লেবার)। কফিলের(স্পন্সর) পক্ষ থেকে বিদেশি শ্রমিকদের জানানো হয়, আমার কম্পিউটার চালু করার জন্য যে টাকা লাগবে আপনারা যদি সেই পরিমাণ টাকা দেন, তাহলে কম্পিউটার চালু হবে। অন্যথায় আপনাদের চিন্তা আপনাদেরকেই করতে হবে। উপায়ান্তর না পেয়ে প্রবাসীরা তাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলা উপার্জন করা টাকা দিয়েও অনেক ক্ষেত্রে ইকামা নবায়ন করতে পারছেন না। কেউ কেউ অবৈধ পন্থায় ইকামা নবায়ন করতে পারলেও সেই ইকামা দিয়ে ছুটিতে যাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
অনেকে এই টাকা দিতে অপারগ হয়ে ফাইনাল এক্সিটে দেশে চলে যেতে চাইলেও কফিলের কম্পিউটার লক থাকায় তাও সম্ভব হচ্ছেনা।
মদীনা থেকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বাংলানিউজকে জানান, ভালোই কাটছিলো প্রবাসের দিনগুলো। এখানে একটি ব্যাংকে চাকরি করতাম। ইকামা নবায়ন করতে গিয়ে শুনি কফিলের কম্পিউটার লক। কফিল বললো অতিরিক্ত ২হাজার রিয়াল দিতে হবে। ব্যাংকের চাকরিটা রক্ষার জন্য সেটা দিলাম। কিন্তু তারপরও কফিল তার কম্পিউটার চালু করতে পারেনি তাই আমার ইকামাও নবায়ন হয়নি। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেয়, ইকামা ছাড়া লোক তারা রাখবে না। এ অবস্থায় হারাতে হলো ব্যাংকের চাকরিটা। এখন দেশেও যেতে পারছিনা। এই সমস্যার আদৌ সমাধান হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করছেন সাবেক এই ব্যাংকার। কফিলকে দেয়া টাকা ফেরত পাবার আশাও ক্ষীণ বলে জানান তিনি।
তায়েফ প্রবাসী নোয়াখালীর সালাউদ্দিন বাংলানিউজকে জানান, সৌদি আরব এসে দুই বছর চাকরি করার পর কফিলকে ছুটিতে যাওয়ার কথা বললে তিনি জানাযন, তার অফিস থেকে পাসপোর্ট হারানো গেছে। সালাউদ্দিন তার বেতনের টাকা থেকে ৩ হাজার রিয়াল খরচ করে জেদ্দা কনস্যুলেট থেকে নতুন পাসপোর্ট বানিয়ে কফিলকে দিয়েছেন। কিন্তু কফিল ছুটিতে পাঠাতে গড়িমসি করায় ফাইনাল এক্সিটে দেশে যেতে চেয়েও কফিলের কোনো সারা পাচ্ছেন না। উপায়ন্তর না পেয়ে সালাউদ্দিন এখন পুলিশের কাছে ধলা দিয়ে জেল খেটে দেশে ফেরার কথা ভাবছেন।
অপর প্রবাসী আব্দুল জব্বার এই প্রতিবেদককে জানান, ৬/৭মাস হয়ে গেছে ইকামা নবায়নের তারিখ অতক্রম করেছে। কফিলের কম্পিউতার লক। তার অধীনস্থ ৬০/৭০জন আমেল(শ্রমিক) আছে। কফিল তার কম্পিউটার চালু করার জন্য সবার কাছে থেকে ৩হাজার রিয়াল চেয়েছে। তারপরে আবার ইকামা বানানোর সরকারি ফি, ইন্স্যুরেন্স, অফিস খরচ, তার বার্ষিক ফায়দা (সুবিধা) সব মিলিয়ে একবছরের ইকামা বানাতে প্রায় ১৫হাজার রিয়াল চাচ্ছে। প্রবাসীদের পক্ষে এতো টাকা দিয়ে ইকামা বানানো সম্ভব না। তাই একেবারে দেশে চলে যেতে চাচ্ছি। কিন্তু তাও পারতেছি না।
এ বিষয়ে জানতে রিয়াদস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগাযোগ করা হলে ‘সমস্যাটি সৌদি নাগরিকদের’ উল্লেখ করে এ ব্যাপারে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করা হয়। অপর এক প্রশ্নের জবাবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশি একজন কূটনীতিক বলেন, বিষয়টি যেহেতু সকল দেশের নাগরিকদের তাই এ বিষয়ে আমরা তাদের সাথে নেগোছিয়েশনে যাচ্ছি না।
তবে প্রবাসীরা বলছেন, এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য দূতাবাসের এগিয়ে আসা দরকার। দূতাবাস ইচ্ছা করলে সৌদিদের সাথে কথা বলে সমস্যার সমাধান করতে পারবে। সমস্যা সমাধান না হলেও অন্তত স্বাভাবিকভাবে যাতে দেশে ফেরা যায় তার একটা ব্যবস্থা করার জন্য দূতাবাসের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন ভুক্তভোগি প্রবাসীরা।