হলমার্ক কেলেঙ্কারির রেশ কাটতে না কাটতেই নতুন শঙ্কা ভর করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ব্যাংকগুলোতে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পর্ষদে ৪৬টি শূন্য পদের বিপরীতে ৩১ জনকে পরিচালক নিয়োগ দিয়েছে সরকার । এ নিয়োগে রয়েছে সাবেক ছাত্র ও যুবনেতা, রাজনীতিবিদ, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী, শিাবিদ, সাবেক ব্যাংকার ও সরকারি কর্মকর্তাও। সোনালী, অগ্রণী, জনতা, বেসিক, বিডিবিএল, রাকাব ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকÑ এই সাত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে এ নিয়োগ দেয়া হয়।
বর্তমান সরকারের আমলেই ২০০৯ সালের ১২ এপ্রিল রাষ্ট্রায়ত্ত তিন ব্যাংক, বিশেষায়িত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদকে অধিকতর কার্যকরী, দ ও পেশাভিত্তিক করতে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে অর্থনীতিবিদ, চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট, আর্থিক বাজার, মুদ্রানীতি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অভিজ্ঞতা ও দতাসম্পন্ন ব্যক্তি, সাবেক ব্যাংকার, আইনজ্ঞ, বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ী প্রতিনিধি ও কমপে একজন নারী পেশাজীবী নিয়োগের কথা বলা হয়। এবারের নিয়োগে এ ধরনের ব্যক্তিকেও পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তবে একই সাথে নবনিযুক্ত ৩১ জন পরিচালকের মধ্যে সাবেক ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতা, জেলা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক, নাক-কান-গলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও স্বাচিপ নেতা, আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় উপকমিটির সহসম্পাদক, সিএ ফার্মের অ্যাকাউনট্যান্ট, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা, মণি সিংহ-ফরহাদ স্মৃতি ট্রাস্টের সম্পাদকও রয়েছেন। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের কার্যক্রমের সাথে প্রকৌশলী, পুলিশ বা চিকিৎসক অথবা ছাত্রলীগ-যুবলীগের সাবেক নেতা বা আওয়ামী লীগের শাখা-প্রশাখার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের কী সম্পর্ক সেটি স্পষ্ট নয়। তাদের কয়েকজনকে আগের দফায় পরিচালক নিয়োগ করা নিয়ে সমালোচিতও হয় সরকার। তারা সবাই তিন বছরের জন্য পরিচালক থাকবেন। বর্তমান সরকারের মেয়াদ পার হওয়ার পরও আরো দুই বছর সময় থাকবে। এবার বেশির ভাগ পরিচালককেই নিয়োগ দেয়া হয়েছে এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকে। সদ্য মেয়াদ শেষ হওয়া এক ব্যাংকের পর্ষদে যিনি ছিলেন, তাকেই এ দফায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে অন্য ব্যাংকে।
বাংলাদেশের আর্থিক খাতে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর অবদান বাড়লেও এখনো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো দেশের শিল্পায়ন, ব্যবসায় বাণিজ্যের বিকাশ ও কর্মসংস্থানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। কৃষি ও ুদ্র-মাঝারি শিল্পসহ রাষ্ট্রের অগ্রাধিকার খাতগুলোতে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ব্যাংকগুলো এখনো অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে পরিচালিত হওয়ার পরিবর্তে বারবার রাজনৈতিক প্রভাবে নীতিনির্ধারণ ও ঋণকার্যক্রম পরিচালনার জন্য এসব ব্যাংক সামনে এগোতে পারছে না। আর্থিক কার্যক্রম পরিচালনার সক্ষমতা ক্রমেই কমে যাচ্ছে। যে ধরনের প্রকল্পে ঋণ দেয়ার কথা নয়, রাজনৈতিক পরিচালকদের প্রভাবে সেসব প্রকল্পে ঋণ দেয়ার কারণে শুরুতেই রুগ্ণ হয়ে পড়ছে অনেক প্রকল্প। হলমার্ক কেলেঙ্কারিসহ এ ধরনের অনেক দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে গত কয়েক বছরে। এর ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির প্রবণতা বেড়ে গেছে। নতুন প্রকল্পে অর্থায়ন করতে না পারায় ব্যাংকের আয়ও কমে গেছে। দুর্বল ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি রাখার অঙ্ক বেড়ে যাওয়ায় এক দিকে ব্যাংকগুলোর মুনাফা কমছে, অন্য দিকে আমানত ও ঋণের সুদের ব্যাপ্তি বেড়ে যাওয়ায় সুদের চাপ পড়ছে সৎ উদ্যোক্তাদের ওপর। সরকার পরিবর্তনের পর রাজনৈতিক প্রভাবে ঋণ দেয়ার প্রভাবের ব্যাপকতা আরো প্রকট হয়ে উঠবে।
আমরা মনে করি, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান একটি দেশের অর্থনীতির মূল প্রাণ। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক স্বার্থ ও অন্যায্য প্রলোভনের হাতে ছেড়ে দেয়া হলে তা রাষ্ট্রের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। ব্যাংকের মতো স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠানে হলমার্ক মার্কা লুটপাটের ঘটনা অনেক বড় ক্ষতি ডেকে এনেছে। যারা এ ধরনের কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী তাদের আবারো ব্যাংকে পরিচালক নিয়োগ কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। সরকারের উচিত বিতর্কিত নিয়োগগুলো সংশোধন করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে চলতে সহায়তা করা। তা না হলে দেশের অর্থনীতির অনেক বড় ক্ষতি হবে, যার জন্য মূল্য দিতে হবে অনেক দিন ধরে।
নিউজরুম