সাহিত্য ডেস্ক: প্রবাদ আছে, প্রেমের মরা জলে ডুবে না। হুজুরের প্রেম আজও ডুবে নাই চাইলতার জলে। প্রেম ভাইসা আছে জমিলা খাতুনের মনের মধ্যে। সেই প্রেমে সাঁতরায়ে জমিলা খাতুন চাইলতা পুকুর পাড়ি দেয়, তীরে পৌঁছায়।
ঘটনা দুইটা। ঘটে একসাথে, উৎস এবং গতিও একদিকে কিন্তু ফাইনালি প্রবাহিত হয় ভিন্ন দিকে। ঘটনা এক : প্রবাসী কুদ্দুসের বউয়ের প্রতি মাদ্রাসার হুজুরের (হুজুর ঐ বাড়িতে জায়গীর থাকে) আসক্তি লোকচক্ষে ধরা পড়া, ঘটনা দুই : রাকায়েতের স্পর্শকাতর সম্পর্ক জানাজানি হলে বিয়েতে পরিসমাপ্তি। দুইটা ঘটনাই সমাজে ভীষণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। গ্রামের মাতব্বররা প্রথম ঘটনা ধামাচাপা দেন কৌশলে, যেভাবে ঠিক চল্লিশ বছর আগে একাত্তরে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় কবর দেয়া হয়েছিল সোনাকান্দা গ্রামের শ’খানেক নিরীহ মানুষের লাশ ঐ মাইল্লা ছরার কবর স্থানে। ফজর বেলা হুজুর যখন জমিলা খাতুনের শাড়িটা চাইলতা তলার পুকুর ঘাটে কাচতেছিলেন তখন মসজিদের মুয়াজ্জিন দেখে ফেলেন। কথাটা সমাজের দু এক জন গণ্যমান্যের কানে দেন। হুজুররা যতই খারাপ কাজ করুক তা প্রকাশ করা যাবে না এই মনোবাক্যে সবাই চুপ হয়ে যায়। গোপন বিচারের ব্যবস্থা করে। কাক পক্ষিও টের পায় না বিচারের রায় কি হয়। অন্যদিকে রাকায়েতের বেলায় গ্রাম্য সালিশ বসে। রাকায়াতের গোপন প্রণয় বন্ধ করা হয় বিয়ের মাধ্যমে। রাকায়াতের বেশরিয়তি সম্পর্কের ইতি ঘটে শরিয়ত মতে আর হুজুরের গোপন প্রণয় ধামাচাপা দেয়া হয় ইজ্জতের ভয়ে।
স্বয়ং আমার চোখের সামনেই যেহেতু ঘটনাদ্বয় ঘটা, সাক্ষী আমি নিজেই। কাহিনী দুইটার সূত্রপাত বেশ কিছুটা লম্বা সময় ধরে। এই যেমন বছর দশেক ব্যাপৃত। ঘটনার সাথে কিছু রটনাও যে নেই তা নয়। পাড়াগাঁয়ে যারা বাস করেন তারা জানেন, ঘটনার পাশাপাশি রটনা কিভাবে ঢোল পিটায় সদম্ভে।
ঐ বছরই দেখা দেয় অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্যোগ। একেবারে বিনা মেঘে বজ্রপাত। আবাদি ফসলি জমিগুলা যাদের সারা বছরের বাঁচার অবলম্বন সেখানে ফসলের এত বড় ক্ষতি গজবই ঠাহর করে নেয় মসজিদের জবরদস্ত ইমাম সাহেব। ধানের ছরাগুলা শুকিয়ে চিট ধরে যায়। বৃষ্টির অভাবে মাঠ ফেটে চৌচির হয় হা করা বাঙ্গির মতো। নানা জনে নানান কথা বলেছে এ নিয়ে। অনেক তদবির অনুসন্ধানে কারণ নির্ধারণ করে ফতোয়াও দেন ইমাম সাহেব। রাকায়াতকে দেশ ছাড়া করা হয়। হুজুর থাকেন বহাল তবিয়তে। রাতে জমিলা খাতুনের ঘর থেকে লোটা হাতে তাকে বের হতে দেখা যায় হর হামেশাই। দুর্যোগের রেশ এখনও জ্বলছে গ্রামের মানুষগুলার মনে, জ্বলছে খড়ের বেণিতে লাগা আগুনের মতো গইয়ে গইয়ে, হুঁকোর কল্কেতে জ্বলা টিক্কা-তামাক যেমন করে জ্বলে।
গাঁয়ের নাম সোনাকান্দা। দক্ষিণ মাথাভাঙা বাজারে যে কয়টা স্থায়ী অস্থায়ী দোকান তার অধিকাংশই সোনাকান্দার দোকানদার। বাজারের সাথে উত্তরমুখী মাটির রাস্তাটা লইচ্চা খালের পাশ দিয়ে সোজা গিয়ে উঠেছে সোনাকান্দা গ্রামের মুখে যে বিশাল পুকুর খানা রয়েছে তার দক্ষিণ পাড়ে কয়েক শ বছরের পুরনো চাইলতা গাছের গোঁড়ায়। সবাই ওই পুকুরটা চিনে চাইলতা তলার পুকুর নামে। চাইলতা গাছটা জিন ভূতের আবাস বলে অনেকে ঐ জায়গাটা মাড়ায় না সহজে। দক্ষিণ মাথাভাঙা বাজারে যে দু চারটা চায়ের দোকান আছে তার মাঝে হিরা মিয়ার চা দোকান বেশ নামকরা। সন্ধ্যার পর সবাই জমে তার দোকানে দেশী গরুর দুধের এক কাপ চা খেতে। গ্রামের যে কোন ঘটনা নিয়ে এখানেই বেশি আলোচনা সমালোচনা হয়। কিছুদিন ধরে দোকানে তুমুল আলোচনা হচ্ছে গ্রামে ঘটে যাওয়া ব্যপার দুইটা নিয়ে। আলোচকদের অধিকাংশই চাষাভূষা। উপস্থিত সবার মুখে একই কথা, এই কাজটা কেমনে ঘটলো? অবশ্য এমন কাজ এর আগেও হয়েছে ভুরি ভুরি, কেউ কথা বলা তো দূরের কথা মাথাই ঘামায় নি তখন। দেশ-কাল বদলেছে, সামাজিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তিত হয়েছে, মানুষের চিন্তা ভাবনার বিকাশ ঘটেছে, শিক্ষার আলো ঢুকতে শুরু করেছে ঘরে ঘরে। তাই সামান্য ঘটনাও মানুষ কে ভাবায় আজকাল। আর এতো অনেকটা নেক্কার জনকই বলা চলে। ঘটনার সাথে জড়িত কিনা মক্কা ফেরত ঐ মানুষটা! বলাবলি হচ্ছে ঐ মানুষটার স্বভাব-চরিত্র নিয়েও। অশিক্ষিত জনু চাষাও কায়দা করে বলে ফেলল ‘বুঝলেন ভাই! কয়লা যায় না দুইলে (ধুইলে) আর স্বভাব যায় না মল্লে (মরলে)। মক্কা শরীফ থাইক্কা আইলেই কি আর অলি অইয়া যাইব নি কিতা? আগের কাহিনী মাইনসের জানা নাই নি কিতা।’ চল্লিশ বছর আগের কাহিনী আবার চাঙ্গা হয় লোক মুখে। একথা সে কথার মাঝে অনেক গোপন কথাও বেরিয়ে আসতে থাকে। অনেকে আবার রসিয়ে রসিয়ে বলে পান চিবানুর রসের মতো করে, অতি মোলায়েম সুরে। সুযোগে দু’চার লাইন বাড়িয়ে বলতেও ছাড়ে না কেউ কেউ।
ছোট বেলায় মা হারা রাকায়েত নানার আশ্রয়ে বড় হয় কোনাবাড়িতে। বাবা বিয়ে করে অন্যত্র সংসার গোছায়। একমাত্র নাতিকে সৎ মায়ের আশ্রয়ে না রেখে নিজের কাছে নিয়ে আসেন নানা। নাতিকে নিয়ে অক্ষরহীন নানার স্বপ্ন জলাঞ্জলি যায়। বড় দুঃখে শেষ কটা দিন কাটিয়ে নানা কাছন আলি আজ পরপারে। অশিক্ষিত কাছন আলি নাতিকে শিক্ষিত করতে যারপরনাই চেষ্টা করেন। নাতি কেবলই বের হয়ে গেছে বাইন মাছের মতো নানার শাসন গলিয়ে। তারও অবশ্য কারণ আছে। রিক্সা চালক গহর আলির বাঁশির সুরে রাকায়েত আনমনা হয়। চাইলতা তলাতে প্রতিদিন ভরদুপুরে বাঁশি বাঁজায় গহর। রাকায়েত পেছন দিকে এসে বাঁশির বাজানো শুনে একমনে। একদিন ইচ্ছার কথা বলতে গিয়ে গহর আলির রাম ধমক খায়। কিন্তু রাকায়াত দমবার পাত্র নয়। শেষে ছেলটার জেদ দেখে সাগরেদ বানায় গহর। সবাই বলে গহরের যুগ্যি সাগরেদ রাকায়েত। অনেকে টিপ্পনী কাটে গুরু মারা সাগরেদ। এতে গহরের গর্বে বুকের ছাতিটা বেড়ে আড়াই হাতি হয়ে যায়। নানা কাছন আলি যতদিন বেঁচে ছিলেন মোটেও সহ্য করতে পারতেন না নাতির এই বিধর্মীপনা। রাতে যখন চোরের মতো বের হয়ে চাইলতা তলে রাকায়াত বাঁশিতে সুর তুলত নানা তখন বেহেস্ত দোজখ এক করে গালির ফুয়ারা ছুটাতেন। বয়সের ভারে ক্লান্ত কাছন আলি আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পরতেন এক সময়।
গাঁয়ের সম্পর্কের খালা পাশের বাড়ির ছুটনী যখন স্বামীর ঘর ছেড়ে ভাইয়ের ডেরায় পা রাখে তখন রাকায়েত নিতান্তই কৈশোর ছাড়িয়ে যৌবনে। বয়সের তফাৎ কম করেও হলে পনের বছর। ছুটনীর উত্তাল যৌবনের ঢেউ কারো দৃষ্টি এড়ায় না। বিশেষ করে উঠতি বয়সের ছোকরারা ঘুর ঘুর করে তার আশেপাশে। আঁটসাঁট দশ হাতি জীর্ণ মলিন শাড়িখানা বাধ মানে না শরীরের ভরা জোয়াড়ে। সব কিছুই উপেক্ষা করে কেন জানি ছুটনী রাকায়েতকে কাছে টানে। মাতৃ স্নেহের দোহাই দিয়ে। কেউ ঘূণাক্ষরেও সন্দেহ করে না। এভাবেই চলতে থাকে মাস, বছর। বিষয়টা যখন আর দশ জনের নজরে পরিষ্কার হয় ততক্ষণে আর কিছুই করার থাকে না তাদের। না থাকে ছুটনীর বড় ভাই জামসেদের না সমাজের। কেবল মাথা খুটা ছাড়া।
সোনাকান্দা গ্রামের পুকুর পাড়ের চইলতা গাছটা ঘিড়ে বেশ লোম খাড়া কিচ্ছা-কাহিনী আছে লোকমুখে। জিন ভূতের সাথে ওইখানে মাঝে মাঝে পরীও নামে। ভরা পূর্ণিমার রাতে যখন জ্যোৎস্নার আলো ঝরে পরে দুনিয়া কাঁপায়ে, যখন মাথাভাঙ্গায় রাকায়েতের বাঁশি বাজে পাগলা সুরে তখন পরী নামে চইলতা তলে। নাচে যতক্ষণ না বাঁশি বাজা থামে। দুই চোখ বন্ধ করে রাকায়েত বাঁশিতে ঠোঁট বোলায় পরম আবেশে। পরদিন বিহানে বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকে রাকায়েত চইলতা তলে। ফজর নামাজের দু’এক জন মুসল্লি (যারা তার রক্ত সম্পর্কীয়) তারে ঘরে দিয়ে যায় কোন কোন দিন। বেশিরভাগ নামাজিই নাউজুবিল্লাহ বলে চলে যায় পাশ কাটিয়ে। সারা মাসে ঐ একদিনই ভরা পূর্ণিমার রাতে রাকায়েত বেহুঁশ হয়। অনেকটা ইচ্ছা করে কিনা তা রাকায়াতই ভালো জানে। পরীও আসে কিনা তাও কেউ দেখেনি কোনদিন। সবই ধারণা মাত্র।
স্বামীর বাড়ি থেকে বিতাড়িত ছুটনী যেদিন প্রথম রাকায়েতের বাঁশির সুর শুনে সেদিন থেকেই পাগল হয়। মুক্তা বেতের খালি চাটাইয়ে শুয়ে ঘুম আসে না ছুটনীর। কেবল এপাশ ওপাশ করে। ভরা পূর্ণিমার রাইতে রাকায়েতের বাশির সুর তাঁকে উতলা করে। তেল চটচটে বালিশটা কখনও বুকে চেপে ধরে, কখনও দু উরুর মাঝে। এমনি করে ঘুমে অঘুমে রাত কাটে ছুটনীর। যতক্ষণ বাঁশি বাজে ততক্ষণ ঘোরের মাঝে কাটে পুরাটা সময়। ক্যান যে এমন হয় তা জানে না। বাঁশি বাজলেই ঠাহর পায় কিসে যেন টানে বাইরের দিকে। যেতে পারে না লোক লজ্জার ভয়ে। ছলনা নারীর প্রতি অঙ্গে। আর তা দিয়েই ছুটনী রাকায়তকে আটকায় মায়া জালে। সদ্য যৌবনে পা দেয়া রাকায়াতও উতলা হয়। নেমে পড়ে মধু বিহারে।
বছরের পর বছর চলতে চলতে আচমকা একদিন রাকায়াত ঘোষণা দেয় সে ছুটনী ছাড়া বাঁচবে না। ঠিক যেন বৈশাখ মাসের ঠাটা পড়ে গ্রামে। সবাই তাজ্জব হয়। ছুটনীকে তার চাই-ই চাই। অশিক্ষিত রাকায়েত সমাজের প্রশ্নের জবাব দেয় চতুরতায়। মানুষ যাতে সন্দেহ না করে সেই জন্য এতদিন তাঁদের এই কথিত সম্পর্ক ছিল দেখানো। সবার মতের বাইরে একমাত্র হাজী সাহেব কে রাজি করায় রাকায়েত। যথা সময়ে বিয়েও হয় আরও দু’চার জন ইয়ার বন্ধু নিয়ে। আর সেই বছরই দেখা দেয় ফসলের চরম ক্ষতি। চারদিকে মরক লাগে। অনেকে না খেতে পেয়ে মারা যায়। অথচ বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ছুটনী-রাকায়াতের ঘর আলো করে সন্তান আসে। তাদেরকে গ্রাম ছাড়া করা হলে চালচুলাহীন রাকায়াত সংসার পাতে অন্য গ্রামে। রাকায়াত এখন রিক্সা চালায়। মাঝে মাঝে আজও দেখা যায় রাকায়াত আসে এদিকে তার রিক্সা নিয়ে। ওস্তাদ মরে যাবার সময় তাঁকে রিক্সা খানা দিয়ে যায়। মাদ্রাসার হুজুর এখনও জায়গীর আছে মালেকা খাতুনের আঁচল জড়িয়ে।
রাকায়াত সোনাকান্দা ছাড়ার পর আর জ্যোৎস্নার ঢল দেখা যায় নি কখনও। তাই জ্যোৎস্না পাগল, বাঁশির সুর পাগল দু’একজনের আজও বিশ্বাস রাকায়েত পরী নামাতে পারত ঠিকই। বিশেষ করে ছুটনী সব সময় বলে সেই কথা। আজ পরী নামে না বলেও তো জ্যোৎস্না ঝরে না আগের মতো। রাকায়াতের বাঁশিতে সত্যিই জাদু ছিল।
রাকায়েতের বাঁশির সুর না শোনার দুঃখ, জ্যোৎস্না না ঝরার দুঃখ আজও করুণ সুরে ঘুরে সোনাকান্দার চাইলতা তলে।
নিউজরুম