ফিচার ডেস্ক: বীরভূম জেলার সদর দফতর সিউড়িতে। তবে এই জেলার প্রধান আকর্ষণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তি নিকেতন। শান্তি নিকেতনে গিয়েই শুনেছিলাম, সিউড়ি এই জেলার সদর শহর ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র।
এই জেলার মহকুমা ৩টি- বোলপুর, রামপুরহাট ও সিউড়ি। রামপুরহাট ও বোলপুর ধান চাষের বাণিজ্যকেন্দ্র। সাঁইথিয়া বাণিজ্য কেন্দ্র। এখানের আহম্মদপুরে আছে চিনির কল। ইসলামবাজার গালা শিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ।
শ্রী নিকেতন চামড়া এবং অন্যান্য হাতের কাজের জন্য প্রসিদ্ধ। বক্রেশ্বর উষ্ণ প্রস্রবণ হয়েও অনেকেই এখানে যান। নানুর বৈষ্ণব কবি চ-িদাস আর কেন্দুলি কবি জয়দেবের জন্মস্থান।
বোলপুরের কাছে শান্তি নিকেতনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত আশ্রম ও বিশ্ব ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। তারাপীঠ সাধক বামাক্ষ্যাপার লীলাক্ষেত্র ও সিদ্ধপীঠ।
বীরভূমের থানাগুলো হলো- দুবরাজপুর, বোলপুর, ইলামবাজার, খয়রাশোল, লাভপুর, মাড়িগ্রাম, নলহাটি, নানুর, রামপুরহাট, সিউড়ি, সাঁইথিয়া, সাদাইপুর। এ জেলার আয়তন ৪ হাজার ৫৪৫ বর্গ কিমিঃ। ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে মোট জনসংখ্যা ৩৫ লাখ ২ হাজার ৩৮৭ জন।
এই জেলার মাটি সাধারণতঃ লাল। পশ্চিম দিকের অঞ্চলসমূহ পাথুরে উঁচু-নিচু এবং স্থানে স্থানে ছোট ছোট পাহাড়ও রয়েছে। এইস্থানে কিছু কিছু সাঁওতাল, মু-া আদিবাসীর বাসভূমি। অজয়, ব্রাহ্মণী, দ্বারকা, ময়ূরাক্ষী, বক্রেশ্বর, কোপাই এখানের প্রধান নদ-নদী।
বীরভূম জেলার পূর্বে মুর্শিদাবাদ আর বর্ধমান জেলা। পশ্চিমে বিহার রাজ্য। উত্তরে বিহার রাজ্য আর দক্ষিণে অজয় নদী। ট্যুরিস্ট লজ আছে- বোলপুরে, তারাপীঠে, বক্রেশ্বরে, শান্তি নিকেতনে আর রামপুর হাটে।
শান্তি নিকেতনে গিয়ে পরিচয় হলো বাউল সমীরের সঙ্গে। কথায় কথায় সমীর জানালো, কলকাতা থেকে রেলপথে শান্তি নিকেতনের দূরত্ব ১৩৬ কিমিঃ। শান্তির স্বর্গ বসেছে এখানে। বোলপুর এখান থেকে ৩ কিমিঃ দূরে।
উঠেছিলাম বোলপুরের এক হোটেলে। ১৮৬১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রায়পুরের জমিদারের কাছ থেকে নিকডাঙ্গায় ২০ বিঘা জমি কিনে পরের বছর শান্তির নীড় গড়েন। নাম রাখেন এর শান্তি নিকেতন। কালে কালে বাড়ি থেকে জায়গার নাম হয় শান্তি নিকেতন। এখানেই দেবেন্দ্র নাথের গড়ে তোলা আশ্রমটি ১৯০১ সালের ২২ ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথের হাতে ৫ জন ছাত্র নিয়ে রূপ পায় ব্রহ্মচর্যাশ্রমে।
ইটে গড়া বাড়িগুলো থেকে দূরের নীল আকাশের নিচে সেদিনের সেই ব্রহ্মচর্যাশ্রমটি আজ সারাবিশ্বে নন্দিত। পড়–য়া আসছে দেশ-দেশান্তর থেকে। ১৯২২ সালের ১৬ মে এটি গড়ে ওঠে বিশ্ব ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে। বিশ্ব এখানে এক জগৎ সংসারের প্রতিটি বিষয় শিক্ষা দেয়া হয় এখানে …।
কথাগুলো শুনে পা বাড়ালাম সামনের দিকে। দেখি, ক্লাস বসেছে শাল-বকুল-আশ্রকুঞ্জের ছায়ায় নীলাকাশের নিচে। এসব দেখে অভিভূত না হয়ে কী পারা যায়। হঠাৎ কানে ভেসে এলো- ‘আমার হৃদয় তোমার আপন হাতের দোলে দোলাও/ কে আমারে কী- যে বলে ভোলাও ভোলাও/ ওরা কেবল কথার পাকে নিত্য আমায় বেঁধে রাখে/ বাঁশির ডাকে সকল বাঁধন খেলাও …’। এ গানটি গাইতে গাইতে অচেনা একজন যুবক আমার পিঠে হাত রাখলো। আপনি বুঝি শান্তি নিকেতনে বেড়াতে এসেছেন?
বললুম, হ্যাঁ দাদা।
– বাংলাদেশ থেকে এসেছেন বুঝি।
– হ্যাঁ। আপনার নাম?
একটু হেসে- রঞ্জিত রায়। এখানেই লেখাপড়া করি। বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে আমার বাড়ি। আপনি ঠিক সময়েই এসেছেন কাল বাদে পরদিন ৭ পৌষ। এই ৭ পৌষে শান্তি নিকেতনের জন্মদিন। উৎসব হবে জাঁকালো। মেলা বসে, আতশবাজি পোড়ে আকাশকে রাঙিয়ে দিয়েÑ এরই নাম পৌষ মেলা।
৭ পৌষ শুরু হলো উৎসব। আতশবাজি পোড়ে যেনো আকাশকে রাঙিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল। সেদিন রঞ্জিত রায় সঙ্গে ছিল। বললো, দেখুন, ওই যে গ্রামগঞ্জ থেকে বাউলেরাও এসেছে। বাউলেরা নাচবে-গাইবে। জানেন, একেক সময় ইচ্ছে জাগে, বাউল হতে। বাউল হলে দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়ানো যায়।
এদিকে মাইকে শিল্পীরা গেয়ে উঠলো : ‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়–ক, আমি তোমায় ছাড়বো না মা/ আমি তোমার চরণ/ মাগো, আমি তোমার চরণ করব শরণ, আর কারও ধার ধারবো না মা/ কে বলে তোর দরিদ্র ঘর, হৃদয়ে তোর রতনরাশি/ আমি জানি গো তার মূল্য জানি, পরের আদব কাড়ব না মা/ মানের আসে দেশ-বিদেশে যে মরে সে মরুক ঘুরে/ তোমার ছেঁড়া কাঁথা আছে পাতা, ভুলতে সে যে পারবো না মা/ ধনে মানে লোকের টানে ভুলিয়ে নিতে চায় সে আমায়। ওমা, ভয় যে জাগে শিয়র বাগে, কারও কাছেই হারবো না মা …।’
এদিকে রাত দশটা বাজতেই হোটেলে ফিরে গেলাম।
পরদিন রিকশা নিয়ে বের হলাম। যে দিকে তাকাই দু’চোখ যেনো এক আনন্দের পরশ খুঁজে পায়। ভাবলাম, কবিগুরুর স্মৃতি বিজড়িত শান্তি নিকেতন সাপ্তাহিক ভ্রমণের চমৎকার জায়গা। আহা কী সুন্দর। দেখলাম, রবীন্দ্রনাথের নামকরণ করা অনেকগুলো সুন্দর বাড়িঘর রয়েছে গাছপালার ছায়াবীথির ফাঁকে ফাঁকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্বণ-পার্বণ চলছে মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে। কবিগুরুর ব্যবহৃত নানা জিনিসপত্র, পা-ুলিপি ইত্যাদি প্রদর্শিত হচ্ছে রবীন্দ্র মিউজিয়ামে। এসবও ঘুরে ঘুরে দেখলাম। শুধু দেখলাম না নোবেল পুরস্কারটি।
শান্তি নিকেতনের পাশে শ্রীনিকেতনে চলছে কুটির শিল্প। পৌষ মেলায় উপরিপাওনা প্রাণচঞ্চল, সঙ্গীতমুখর শান্তি নিকেতনের মনভোলানো পরিবেশ। এক-আধবেলার অবকাশে দেখে আসা যায় বল্লভপুর ডিয়ার পার্ক, কোষাই নদী, কংকালীতলা আর খোয়াইয়ের মন উদাস করা সৌন্দর্য।
শান্তি নিকেতনের কাছেই অজয় নদের তীরে গিয়ে অবাক হলাম। দেখি ওখানেও চলছে বাউল গানের মহামেলা। কবি জয়দেবের স্মৃতি বিজড়িত মন্দিরটি দেখে শুধু যে তাকিয়ে থাকা। হঠাৎ দেখি ওই মন্দির থেকে কৃষ্ণ বেরিয়ে আসছে। আমাকে দেখেই গাইতে শুরু করলো ‘এই করেছ ভালো, নিঠুর হে, নিঠুর হে, এই করেছে ভালো/এমনি করে হৃদয়ে মোর তীব্র দহন জ্বালো/আমার এ ধুপ না পোড়ালে/আমার এ দ্বীপ না জ্বালালে দেয় না কিছুই আলো/যখন থাকে অচেতনে এ চিত্ত আমার/আঘাত সে যে পরশ তব, সেই তো পুরস্কার/অন্ধকারে মোহে লাজে চোখে তোমায় দেখি না যে/বজ্রে তোলা আগুন করে আমায় যত কালো…।’
কওড়া ও শিয়ালদহ থেকে অনেকগুলো ট্রেন যায় শান্তি নিকেতনের সংযোগকারী স্টেশন বোলপুরে। হাওড়া থেকে কালপুর ১৫৫ কি.মি.। শান্তি নিকেতন এক্সপ্রেস কিংবা কাঞ্চনজঙ্খা এক্সপ্রেস যাতায়াত করাটাই বেশি সুবিধাজনক।
শান্তি নিকেতনের আরেক আকর্ষণ উত্তরায়ণ পেরুতেই ত্রিমুখী বাঁকের মুখে তালধ্বজা। আর ক্যানালের পাড়ে রয়েছে বল্লভপুর অভয়ারণ্য বা ডিয়ার পার্ক। ১৯৭৭ সালের ১১ জুলাই ৭০০ একর জমি জুড়ে শাল, পিয়াল, শিশু, কাজু, হরীতকী, আমলকী, বহেরা, শিরীষ, জাম, মহুয়া, সোনাঝুরি, আকাশমণিতে ছাওয়া পার্কে রয়েছে হরিণ আর হরিণ।
এরা ঘুরে বেড়ায় এই পার্কে। সারাদিন ঘুরে বেড়ানোর এক সুন্দর জায়গা এই ডিয়ার পার্ক। ময়ূর, খরগোশ, বেজি, শিয়াল, সাপ ও বিভিন্ন প্রজাতির পাখির বাস রয়েছে এখানে।
কৃষ্ণ ও আমি এই ডিয়ার পার্ক দেখা শেষ করে বেলা ১২টার দিকে রওনা হলাম বক্রেশ্বরের দিকে। শান্তি নিকেতন থেকে ৫৯ কিমিঃ দূরে বক্রেশ্বর। বাসেই এলাম। নানা কিংবদন্তিতে ঘেরা এই বক্রেশ্বর। ওখানে গিয়ে উঠলাম, ট্যুরিস্টলজে।
বক্রেশ্বরে গিয়ে শুনলাম, এখানের উষ্ণ জলের প্রস্রবণ খুবই পর্যটকপ্রিয়। ব্রহ্মকু-, অগ্নিকু-, জীবিতকু-, চন্দ্রকু- বা সৌভাগ্যকু-, সূর্যকু-, খরকু-, ভৈরবকু– মন্দিরকে ভর করে পাশাপাশি অবস্থান এদের। অগ্নিকু-ের জলপাড়ে অম্ল রোগের নিরাময় মেলেÑ গরম বেশি অগ্নিকুন্ডের জল।
অগ্নিকু-ের কাছে এসে দেখলাম, এখানের জল বিক্রি হচ্ছে। গ্লাসে নিয়ে কেউ কেউ পান করছে। খরকু-ের জলও যথেষ্ট গরম। আর জীবিতকু-ের জল ঠা-া। সন্তান কামনা করে বন্ধ্যা নারীরা জীবিতকু-ে স্নান করে থাকেন।
ওখানেই পরিচয় হলো এক ঠাকুরের সঙ্গে। ঠাকুর আসবেন। আপনারা তো গর্ব করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, আব্বাস উদ্দিন আহমেদ, বেগম রোকেয়াকে নিয়ে। এদের বাড়ি এই পশ্চিমবঙ্গে। এরমধ্যে বেগম রোকেয়ার পৈতৃকবাড়ি রংপুরে হলেও তিনি কিন্তু থেকে গেছেন কলকাতার মোদপুরে। বেগম রোকেয়ার কবরও তো মোদপুরে।
ঠাকুরের কথাগুলো শুনেই যাচ্ছি। বেশ ভালই লাগছিল সেই মুহূর্তে। ঠাকুরকে নমস্কার জানিয়ে বললাম ‘আবার দেখা হবে। সময় পেলে আসবো। এবার চলি…।
হাত নেড়ে ঠাকুর বললেন, আকার আসবেন। ও হ্যাঁ সম্ভব হলে কংকালী পীঠ দেখবেন…।
প্রান্তিক বরল স্টেশন থেকে মাঠ পেরুতেই পিচঢালা পথ গিয়েছে সোজা কংকালী পীঠের দিকে। পথ যদিও পিচের তবে পায়ে হেঁটে যেতে হয়, কোনও গাড়ির চল নেই প্রান্তিক থেকে। তাই শান্তি নিকেতন ভ্রমণার্থীদের পায়ে পায়ে বা রিকশায় যাওয়া সুবিধার। দূরত্ব ৮ কিমিঃ।
ওখানে গিয়ে শুনলাম, গ্রামের নাম বেঙ্গুটিয়া। নতুন মন্দির হয়েছে কু-ের পাড়ে। দেবীর প্রতীকরূপী দেবতা ত্রিশূল, আর আছে পটে কালীরূপী কংকালী। মূল দেবী জলমগ্না। মন্দির লাগোয়া কু-েই অবস্থান তার। খুবই জাগ্রত এই দেবী। ৫১ পীঠের শেষ পীঠও এই কংকালী পীঠ। চৈত্র সংক্রান্তিতে এখানে উৎসব হয়। শ্মশানভূমিও আছেÑ এর পাশ থেকে বয়ে চলেছে স্বচ্ছসলিলা কোপাই নদী।
কোপাই নদী তীরে গিয়ে বসলাম কৃষ্ণ ও আমি। দূরের গ্রাম দেখে ভাবলাম, আমার বাংলাদেশের সঙ্গে এই পশ্চিম বাংলার মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখছি না। ওখানে নদী, এখানেও নদী। কত সুন্দর আমার এই বঙ্গজননী।
‘বীরভূমের শান্তি নিকেতনে এসেছিÑ তা চ-ীদাসের দেশে যে যাবে না, তা হতে পারে না।’ এ কথা বললাম কৃষ্ণকে। কৃষ্ণ বললোÑ চলুন এবার চ-ীদাসের দেশে।
বোলপুর থেকে প্রায় ৩১ কিমিঃ দূরে নানুর। বাস ধরে চললাম চ-ীদাসের দেশে। এক বৃদ্ধের সঙ্গে পরিচয় হতেই তিনি বললেন, অতীতে নানুর ছিল নানোর। তবে লোকমুখে আজ নানুর নামে খ্যাত হলেও সরকারি নথিপত্রে চ-ীদাস-নানুর নাম রয়েছে আজও।
‘চ-ীদাসের জন্মস্থানÑ এ কথা অনেকেই বলেন। আবার এ কথা কেউ কেউ স্বীকার করেন না। তবে আমি বলবো, নানুর চ-ীদাসের জন্মস্থান। নানুর ও কীর্ণাহারের বাতাসে চ-ীদাসের রজকিনী প্রেম কাহিনী, চ-ীদাসের সাধন ভজন আখ্যান, চ-ীদাসের মৃত্যু, কিংবদন্তির গাঁথা হয়ে ফেরে। জনশ্রুতি ১৪ শতকে কবি চ-ীদাসের জন্ম এই নানুরেই। সেই স্মৃতিতে নানুর পুণ্যতীর্থ।
নানুরে গিয়ে দেখলাম, বিশালাকার মন্দির, কবির বাড়ি, ধোপানির পাঠ ও রক্ষাকালী মন্দির। নানুর ঘুরে ঘুরে দেখছি। কৃষ্ণকে বললাম, চ-ীদাসের নানুর দেখে মনে পড়ছে দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা। ১৯৩২ সালে নির্মিত ‘চ-ীদাস’ ছবিতে দুর্গাদাস চ-ীদাসের ভূমিকায় অভিনয় করে দর্শকের মন জয় করেছিল।
সেই দুর্গাদাস নেই, চ-ীদাসও নেইÑ সবই যে সত্য! কৃষ্ণ বলো, এখন তো মিথ্যে বলে মনে হচ্ছে কেন? কৃষ্ণর জবাব- পৃথিবী ভুল! তাই আজ সব মিথ্যে মনে হয়। তবু মানুষের মধ্যে সবকিছুতে প্রতিযোগিতা নিয়ে কেন এতো-
মারামারি, হানাহানি?
নিউজরুম