আকাশ ভেঙে শ্রাবণের বৃষ্টি ঝরে। বৃষ্টির ফোঁটারা আছড়ে পড়ে টিনের চালে, পিচঢালা সরু পথে অথবা লোহার গ্রিলের জালে আবদ্ধ দোতলা এই বাড়িটির সঙ্কীর্ণ বারান্দায়। গ্রিল ধরে নববিবাহিত মেয়েটা তার স্বামীকে নিয়ে বৃষ্টিভেজা গভীর কালো রাতের নির্জীব আকাশ দেখে। বৃষ্টির ফোঁটায় শরীর দোলানো শিহরণ খোঁজে। ভেজা আকাশেই সুখ খোঁজে, স্বপ্ন আঁকে। স্বামীটা মেয়েটির খোলা চুলে মাতাল হয়। চরম উচ্ছৃঙ্খল হয় নিগূঢ় ভালোবাসায়। স্বামীর ছিটিয়ে দেয়া বৃষ্টির ফোঁটায় তন্বী মেয়েটা চমকে ওঠে সময়ের শ্রেষ্ঠতম ভালোবাসায়…।
আর ছেলেটাও যতটা কেঁপে কেঁপে ওঠে বৃষ্টির ফোঁটায় তার চেয়েও বেশি তার চোখের আশ্রুজলে। চৌচালা টিনের চালার এই বাড়িটি যতটা একা আশপাশের বড় বড় উঁচু উঁচু পাকা উট্টালিকার তুলনায়, তার চেয়েও বড় বেশি একা জানালার পাশে বসে থাকা এই ছেলেটা। সে শুধু বৃষ্টি পড়া দেখে আর তার চোখের জল ক্রমাগত বিলীন হয় বৃষ্টির ফোঁটার সাথে। বৃষ্টির জলছাপে সে ছবি আঁকে। একটা প্রিয় মুখের মুখচ্ছবি কেন যেন হয়েও হয় না। অস্পষ্ট ছবিটা শ্রাবণের বৃষ্টির পানিতে ধুয়েমুছে একাকার হয় শুধু…
এখনো পায়ে চলা মেঠোপথটার মাটি আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে বৃদ্ধ বটগাছটা। ছেলেটা যখন এসে দাঁড়াল বটগাছটার ছায়ায়, তখন আচমকা ঝড়ো বাতাসের ঝাপটার সাথে পরিচিত ভাঙা ভাঙা ধূসর ছবিও চলে এলো সামনে। কলেজ ফাঁকি দিয়ে তারা প্রায়ই এখানে চলে আসত। থাকত সন্ধ্যার আঁধার অবধি, পাশাপাশি। কখনো মেয়েটা হাত রাখত ছেলেটার হাতে। কখনো বা মাথা রাখত ছেলেটার বুকে। এলোমেলো বাতাসে মেয়েটার চুলগুলো যখন ছেলেটার চোখেমুখে পরশ বুলিয়ে দিত, তখন পরম প্রাপ্তির আনন্দে ছেলেটা চোখমুখ বুজে রাখত। এই খোলা চুলেই ছেলেটা খুঁজে নিত তার না পাওয়াকে; তার সাধ, সাধনাকে। আর মেয়েটা শুধু হাসত। মেয়েটার হাসি ক্রমেই মিলিয়ে যেত দূর আকাশে। ছবিগুলো কেমন ঝাপসা হয়। ক্রমেই মিলিয়ে যায় সান্ধ্য আঁধারে। ছেলেটা দাঁড়িয়ে থাকে একা। বটগাছ আর সে পাশাপাশি। তার চার পাশ সঙ্কুচিত হয়। ব্যথারা তার পাঁজর চেপে ধরে। তার চোখ টলমলিয়ে ওঠে ব্যথাতুর অশ্রুজলে…
মেয়েটার চোখেও জল আসে পেঁয়াজের ঝাঁজে। বারবার চোখ তালুতে মুছেও জল ফুরায় না। সে এখন রান্নায় মহাব্যস্ত। মেহেদির বঙ এখনো মুছে যায়নি। এখনই সে পাকা রাঁধুনি। শাড়ির আঁচলটা কোমরে গুঁজে সে যখন বঁটিতে মাছ কোটে অথবা ধোয়া কাপড়গুলো শুকাতে দেয় বারান্দার গ্রিলে, তখন তাকে অদ্ভুত সুন্দর দেখায়। আজ তার সাহেব অফিসে যায়নি। সারা দিন সারাক্ষণ ঘরেই থেকেছে। কত যে খুনসুটি করেছে। কখনো বা খোঁপায় বাঁধানো চুলগুলো খুলে দিয়েছে। কখনো হাতের কাচের চুড়িগুলো একটা একটা করে ভেঙেছে। টুকটাক খাওয়া সাহেবের খুব পছন্দ। খুব যতœ নিয়ে ডালের বড়া আর খুব পেঁয়াজ দিয়ে কী একটা ভেজেছে। থালাভর্তি খাবার নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরোতেই এই দোতলা বাড়িটার একমাত্র আমগাছটা চোখে পড়ল মেয়েটার। নির্জীব ঠায় দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ। তারপর পা বাড়াল নিজঘরের পথে। আমগাছটা আমগাছই রইল। মেয়েটার স্মৃতিকাতর বটগাছ আর হলো না…।
মো: ফারুক রানা, মধ্য রসুলপুর
কামরাঙ্গীরচর, ঢাকা
সবুজ শাড়ি
অরুণের সাথে শাহানার প্রথম পরিচয় সাংস্কৃতিক আসরে। শাহানা সেই আসরে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছিল, আর অরুণ দর্শক সারিতে বসে শাহানার গান শুনেছিল। সবুজ শাড়ি পরা সুন্দরী শাহানাকে দেখে অরুণ মুগ্ধ হয়। গান শেষে শাহানা সবার প্রশংসা পায়। শাহানা মঞ্চ থেকে নেমে আসার পর অরুণ তার সামনে এসে বলেÑ ‘আপনার গান আমার অনেক ভালো গেলেছে।’ শাহানাও হেসে বলেÑ ‘ধন্যবাদ আপনাকে।’ অনুষ্ঠান শেষে শাহানা রিকশায় চড়ে বাড়ি চলে যায়। অরুণ শাহানার পানে তাকিয়ে মনে মনে বলেÑ ‘কী সুন্দর একটা মেয়ে!’
২। অরুণ তার বন্ধু আসলামের কাছে জেনেছে, শাহানা নাকি ভালো গান করে বলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার ডাক পড়ে। সুরেলা কণ্ঠে গান শুনিয়ে সবাইকে মাতিয়ে রাখে। তাই অরুণ কোনো সাংস্কৃতিক আয়োজন হলে সেখানে গিয়ে হাজির হয় শাহানাকে দেখতে। তারপর অপেক্ষার বাঁধ ভেঙে শাহানা মঞ্চে এসে গান শুরু করে। অরুণ শাহানার পানে অপলক তাকিয়ে থাকে। গান শেষ হয়। দর্শক করতালি দেয়।
৩। নিউ মার্কেটের এক ফুল দোকানে সেদিন শাহানার সাথে অরুণের দেখা। অরুণ ফুল দোকানে শাহানাকে দেখে কাছে আসে। শাহানাও অরুণকে চিনতে পারে। দু’জনে কথা বলে। শাহানা একগুচ্ছ গোলাপ কিনে অরুণের সাথে দোকান থেকে বেরিয়ে আসে। দু’জনে একটি ফাস্টফুডের দোকানে বসে। খুটিনাটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। আলোচনার বিষয়বস্তু মূলত গান নিয়ে। শাহানা বড় শিল্পী হতে চায়। অরুণ শাহানার ফোন নাম্বার চেয়ে নেয়।
শাহানা ফুলগুলো নিয়ে ধানমন্ডি যাবে। সেখানে তার বান্ধবী মিলির জন্মদিনের আয়োজন চলছে।
৪। নিশি রাত। অরুণের ঘুম আসছেনা। বারবার শাহানাকে মনে পড়ছে। শাহানাকে ফোন দেয় অরুণ। দু’জনে কথা বলে। অরুণ কাঁপা গলায় শাহানাকে বলেÑ ‘আপনাকে আমার ভালো লাগে।’ শাহানা চুপসে যায়। কিছুক্ষণ পর সে লাইন কেটে দেয়। অরুণ নার্ভাস ফিল করে। মন খারাপ হয়ে যায়।
৫। সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা। দর্শক সারিতে অরুণ বসে আছে। বিভিন্ন ছেলেমেয়েরা গানবাজনা, আবৃত্তি, কৌতুক বলে সবাইকে আনন্দ দিচ্ছে। সবার ভিড়ে অরুণ শাহানাকে খেঁাঁজে। কিন্তু শাহানার কোনো আভাস নেই। মেয়েরা মঞ্চে এসে গান গেয়ে চলে যায়। তবুও শাহানা আসে না। অরুণ শাহানাকে কল দেয়। সংযোগ পায় না।
৬। যাত্রাবাড়ীর মেইন রোড দিয়ে হাঁটছে অরুণ। হঠাৎ এক ভয়াবহ দৃশ্য দেখে সে। রাস্তার মাঝখানে একটা বাস উল্টে পড়ে আছে। অনেক যাত্রী প্রাণ হারিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় লুটিয়ে পড়ে আছে। দুর্ঘটনায় নিহত মানুষগুালাকে দেখে মন খারাপ হয় অরুণের। হঠাৎ সবুজ শাড়ি পরা একটা মেয়ের লাশ দেখে অরুণ চিৎকার দেয়। লাশটি শাহানার। অরুণ হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।
জোবায়ের রাজু, আমিশাপাড়া, নোয়াখালী