মম তনুর ময়ুর সিংহাসনে
এসো রূপকুমার ফরহাদ’
—কাজী নজরুল ইসলাম
এক.
আসাদ, আমার নাম মনে নাই তোর?
বুকের ভিতরে জাপটে ধ’রে রাখা সেই
বুকের উষ্ণতা হয়ে আরেকবার ডাক
আমার সমস্ত কিছু যা আছে আমার
আমার গলার মালা যা আছে আমার
যা আমার নাই তার না থাকার ফাগ
সবকিছু ফেলে দিয়ে তোর কাছে যাবো
বুকের-বিলয়-তলে বিজয়-বেদনা
রে আসাদ, বন্ধু মোর, শিশিরের কণা,
ঝাঁপ দে রে আমার বুকে, জন্মের শূন্যতা
চুমায় ভরিয়ে দে রে! আঁকড়ে ধর, যাদু!
এতো আলো এতো আলো কেন রে ভুবন!
আসাদ! আসাদ! আমি মরে যাচ্ছি রে!
দুই.
আমি খিলিপানের মতন ক’রে হাসি
কেন হাসি লাগে রে আমার তনু
জাগে রে আমার কেন আগে রে আমার
তুই পাবি? কেন এই হাড্ডির চিৎকার তুই
পান ক’রে যাবি? কেন আমার বিকার
রে আসাদ! কালো ঘোড়া! গত জনমের
পহেলা বৈশাখ তুই, আমি তোকে চাই
রগের ভিতরে রক্ত হয়ে তুই থাক রে আমার
ছিটকেপড়া বীর্যের বিরহ হয়ে থাক রে আমার!
খাঁখাঁ এই বুকে আয়, ঝাঁপ দে রে আসাদ
দুপুরের পুকুরে আমার! আমার শূন্যের বুকে
আমার দিগন্তে তুই নেমে আয়! খোকা!
সোনার ধানক্ষেত দিয়ে দৌড়ে ছুটে আসি
এই নে হাড্ডির রক্ত, পান কর, হাসি…
তিন.
আসাদ আমার বন্ধু, ভগ্নাংশ আমার
আমার জলার মাছ, লালপুঁটি, তার
বুকের ঢিপঢিপ ধ্বনি বাজে রে আমার
বুকের তলের জলে! দুধের বোঁটায়,
তলপেটে সে আমার থেঁতলে যাওয়া ছেলে!
সে আমার ঠোঁট থেকে আস্তে খুলে যাওয়া
ঠোঁটের অনুরাগ হয়ে সুদূরে মিলায়!
রে আসাদ! ভাই আমার! সোহাগের ধন!
ফিরে আয় ফিরে আয় ফিরে আয় বুকে
আমার আতার ফুল ছিঁড়ে আয় বুকে
আমার নাড়ির টান আমার পাতাল
আমার দাফন শেষে ছিটানো আতর
গন্ধের মতন তুই উড়ে যাবি, সোনা!
তোকে আর এই দেশে জীবনে পাবো না…
আমার বাংলাদেশ! আমার বিফল
তনু! ভীরু ধানক্ষেত! মায়ের পেটের
ভিতরের দুই ভাই আমি ও আসাদ…
চার.
আমি তোকে আর রক্ত দেখাবো না রে
আমি তোকে আর গলাবো না এই ক্ষার-এ
আমি শুধু এই এপারে আমার শুয়ে
রবো রে আসাদ, পারানির সিকি খু’য়ে
তুই তো আমার পাঁজরে পা রাখবি না
জানবি না কেন কাঁপে এই ছোট সিনা
মানবি না তোর পেড়ে আনা সেই মুখ
লুকায়ে রাখুক এই চির-উজবুক
পাঁচ.
আসাদ! আসাদ! চল আমরা খলখল ক’রে
দৌড়াই পাকা ধানের শীষের উপর দিয়ে
চল আমরা মেঘ খাই
চল দামামা বাজাই, চল রে আসাদ
আমরা সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাই
উপরের দিকে, উপরের সীমাহীনতার
ওপারের সাদাকালো গ্রাম
পার হয়ে আরও এক দূর…
গ্রামের ভেতর দিয়ে নূর
হয়ে মোরা বয়ে যাই চল…
ছয়.
চল আমরা কাঠবিড়ালির সাথে
লাফ দিয়া গাছে উঠি
গাছের ডালের ফাঁকের আলোছায়ায়
এ-ডাল ও-ডাল করার মতো খেলি
আমাদের হিরণ্ময় আমগাছগুলি
আমাদের আমের তলের ছোটঘর
আমরাই তো বাঁধিয়াছি হেসে
দুজনে দোঁহারে ভালোবেসে
সে-ভালবাসার দিন আদিঅন্তহীন
গোলাপের বাগানের মতো ফুটে রবে
এপারের এ-ঘরের
চালার উপর দিয়ে
উড়ে চলে যেতে গিয়ে থমকায়
যে-বাতাস, তার
হৃদয়ের গান আমি গাহিয়াছি
আমি তারে ডাকি রে আসাদ!
সাত.
আমার বাঁশের তলে পড়ে আছে বাঁশপাতা
রে আসাদ, তুই আমার
কবিতার খাতা রে! আসাদ!
তুই আমার ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে
ঝাউবন, বিবাহ-মন্দির…
তুই আমার স্বপ্নে-পাওয়া
সোনালি ধারের তলোয়ার…
তুই আমার আত্মারই আলয়
আদিকালে বৃষ্টির আঘাতে
ধ্বসে-পড়া জীবন্ত নগর
ভূ-পাতন, ইন্দ্রিয়ের শৈথিল্যের
নিচের শহর দিয়ে বয়ে যাওয়া চন্দ্রমুখী-নাও…
শৈবালে ঠোকর দেওয়া রাজহাঁস
উড়ে যাওয়া পাখিদের
উন্মূল ছায়ার নিচে
মম ভগবান!