পাকিস্তানি প্রভাবশালী দৈনিকের সংবাদ সময় হয়েছে ক্ষমা চাওয়ার

0
353
Print Friendly, PDF & Email

ঢাকা (১৬ ডিসেম্বর) : স্বাধীনতার পর একে একে ৪১ বছর পেরিয়ে গেছে। এক সময়ের রুগ্‌ণ, যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ আজ স্বাবলম্বী, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম আঞ্চলিক শক্তি। কিন্তু ৪১ বছর আগের সেই ক্ষত এখনো মুছে যায়নি বাংলাদেশের শরীর থেকে। একাত্তরের সেই অপূরণীয় ক্ষতির জন্য বারবার পাকিস্তানকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ।

কিন্তু এ বিষয়টি বরাবরের মতোই উপেক্ষা করে এসেছে পাকিস্তান। এমনকি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। ১৬ ডিসেম্বর রোববার বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে প্রভাবশালী পাকিস্তানি দৈনিক এক্সপ্রেস ট্রিবিউন। উল্লেখ্য, এটিই পাকিস্তানের প্রথম আন্তর্জাতিক অনুমোদনপ্রাপ্ত (নিউ ইয়র্ক টাইমসের) পত্রিকা।

চলতি বছরের নভেম্বর মাসে যখন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানি খার ইসলামাবাদের ডি-৮ সম্মেলনের আমন্ত্রণ নিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এসেছিলেন, তখন পাকিস্তানকে একটি শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। তা হলো, ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের জন্য ক্ষমা চাইতে হবে।

বেশ কূটনৈতিক উত্তর দিয়েছিলেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, “বাংলাদেশের অতীতকে ভুলে এগিয়ে যাওয়া উচিত, যাতে দুই পক্ষের সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়।”

ফলাফল যা হবার তাই হলো। বাংলাদেশ থেকে ঘোষণা এলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন না।

নতুন করে তোলা এই ক্ষমা প্রার্থনা দাবিকে এমনিতে মনে হতে পারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের একটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ। কিন্তু একটু গভীর চোখে দেখলেই হয়তো আরও কিছু চোখের পড়বে। বাংলাদেশের সব পর্যায়ের মানুষেরই আজ একই অনুভূতি, এবার সময় হয়েছে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই পররাষ্ট্রনীতির আওতাভুক্ত এ দাবি সরকারের উচ্চ পর্যায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। সেসময় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আলমগীর বাশার খান বাবরের সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির বৈঠকের পর থেকেই প্রসঙ্গটি নতুন করে চাঙ্গা হয়।

এ ব্যাপারে চলতি সপ্তাহে দীপু মনি এক্সপ্রেস ট্রিবিউনকে বলেন, “আমরা কখনোই এ দাবি সরিয়ে রাখিনি। আমরা এ বিষয়ে ক্রমাগত চাপ দিতে থাকব। আশা করছি, এক পর্যায়ে পাকিস্তানের নীতিনির্ধারকরা ক্ষমা চাইতে রাজি হবেন।”

এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয় বিভাগের অপর এক কর্মকর্তা জানান, এখন থেকে প্রতিটি দ্বিপাক্ষীয় বৈঠকেই সম্পূর্ণ কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় বিষয়টি তোলা হবে।

বাংলাদেশের সুশীল সমাজ অনেক আগে থেকেই এই আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনার দাবি জানিয়ে আসছেন। সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান (বর্তমানে বিমানমন্ত্রী) এক জনসমাবেশে এ দাবি জানিয়ে বলেছিলেন, এর ফলে দুই দেশের সম্পর্ক বৃদ্ধি পাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুনের মতে, অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে ক্ষমা চাওয়া এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ তার দাবিদার।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি, বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পের প্রতি পাকিস্তানের আগ্রহের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বাংলাদেশের এখন পাকিস্তানকে যতোটা প্রয়োজন, তার চেয়ে পাকিস্তানের অনেক বেশি প্রয়োজন বাংলাদেশকে।”

বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ লেখক, সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধের একজন সক্রিয় কর্মী শাহরিয়ার কবিরের মতে, এটা নিছক বাণিজ্যিক দাবি নয়।

হিনা রাব্বানির মন্তব্যকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, “তার জবাবে স্পষ্ট, পাকিস্তান ব্যাপারটাকে উপেক্ষা করছে।” তার মতে, একটি আনুষ্ঠানিক ক্ষমাপ্রার্থনার অর্থ, পাকিস্তান তাদের দায় দায়িত্ব ও ভুল বুঝতে পেরেছে।

তিনি আরও জানান, ৪৭ থেকে ৭১ পর্যন্ত কিভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করা হয়েছে, সেটা এখনকার পাকিস্তানের অধিবাসীদেরও জানা দরকার। তাহলে তারাও ক্ষমাপ্রার্থনার জন্য চাপ দেবে।

স্বাধীনতার পর থেকেই অবশ্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ক্ষমাপ্রার্থনার দাবি উঠে আসছে। এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানও এই দাবি জানিয়েছিলেন। পাকিস্তানকে ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে চাপ প্রয়োগ করার জন্য তিনি অন্যান্য দেশকেও আহবান জানিয়েছিলেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ফরহাদ হোসেন বলেন, “পাকিস্তান জানে ক্ষমা চাইলে তাদের আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।”

তিনি আরও বলেন, “আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা করলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যা দাবি করবে তাই দিতে বাধ্য পাকিস্তান। এটাই পাকিস্তান সরকারের ভয়।”
 
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমানের মতে, বাংলাদেশে আটকেপড়া পাকিস্তানের সঙ্গে এই ইস্যুটি সরাসরি সম্পৃক্ত। বর্তমানে দুই লাখেরও বেশি উর্দুভাষী মানুষ বাংলাদেশের ১০০টির মতো উদ্বাস্তু শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করছে।

স্বাধীনতার পর থেকে তাদের অনেককেই পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলেও মাত্র অল্প কয়েকজন এ পর্যন্ত যেতে পেরেছে। পাকিস্তানের ইতিবাচক পদক্ষেপের মাধ্যমে এ সমস্যাটি সমাধান করা সম্ভব বলে মনে করেন মিজানুর রহমান। তিনি আরও বলেন, “কিন্তু পাকিস্তান সমাধান চায় কিনা, সেটাই এখন প্রশ্ন।”

নিউজরুম

শেয়ার করুন