‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে/কত প্রাণ হলো বলিদান/লেখা আছে অশ্রুজলে’

0
320
Print Friendly, PDF & Email

ঢাকা:(১৬ ডিসেম্বর):  ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে/কত প্রাণ হলো বলিদান/লেখা আছে অশ্রুজলে’ কৃষ্ণ চন্দ্র দের গভীর আবেগে লেখা এ গণসঙ্গীত আমাদের মনে করিয়ে দেয় ৩০ লাখ শহীদের বলিদানের কথা। যে দেশের জন্য দুই লাখ মা-বোনকে দিতে হয়েছে সম্ভ্রম। অনেক রক্ত আর ত্যাগের বিনিময়ে যে দেশ, সেখানে এখনও শত্রুদের সোল্লাসে বসবাস কুলষিত করছে দেশের মানচিত্রকে।

৪১ বছর ধরে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ৪২ তম বিজয়ের দিন এসেছে দুয়ারে। আবারও ফিরে এসেছে বিজয়ের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। রোববার মহান বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য অর্জিত হয় এ বিজয়। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর জেনারেল এএকে নিয়াজী ৯৩ হাজার সৈন্য নিয়ে ঢাকার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে(তৎকালিন রের্সকর্স ময়দানে) মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে।

তবে আমাদের বিজয়ের আনন্দ তখনই স্বার্থক হবে যেদিন যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার হবে স্বাধীন এই বাংলাদেশে।

প্রধান স্বাধীনতা বিরোধীরা এখন কারাগারে। চলছে বিচার-প্রক্রিয়া। বিজয়ের মাসে জাতির বহু কাঙ্ক্ষিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ের অপেক্ষায় এখন বাঙালি।

বিজয়ের এ দিনে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া জুড়ে কেবলই একই আওয়াজ-যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই।
১৬ ডিসেম্বর। ৪২তম মহান বিজয় দিবস। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের দিন। পূর্বাচলে আজ উদিত যে-সূর্য, প্রতিদিনের হয়েও সে প্রতিদিনের নয়; তার রক্তিমতায় ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত আমাদের মনে পড়বে; আকাশ যে-কোমলতায় আজ উদ্ভাসিত, একাত্তরের সম্ভ্রমহারা দুই লাখ মা-বোন-জায়ার ক্রন্দনধোয়া সে-উদ্ভাস। ভোরের যে-রাঙা আলোটি আজ স্পর্শ করেছে ভূমি, স্বদেশের সেই পবিত্র ভূমি ভিজে আছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর রক্তে; আর সেই রক্তস্রোতে মিশে আছে জাতীয় চার নেতার উষ্ণ শোণিত। দেনদরবার নয়, কারও দয়ার দানে নয়, সাগর সমান রক্তের দামে বাংলাদেশ অর্জন করেছে স্বাধীনতা, রক্ত সাগর পেরিয়ে বাঙালি জাতি পৌঁছেছে তার বিজয়ের সোনালি তোরণে।

৫৫ হাজার বর্গমাইলের এই সবুজ দেশে ৪১ বছর আগে আজকের এই দিনে উদয় হয়েছিল হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সূর্য। যে সূর্য কিরণে লেগে ছিল রক্ত দিয়ে অর্জিত বিজয়ের রং। সেই রক্তের রং শ্যামল-সবুজ বাংলায় মিশে তৈরি করেছিল লাল সবুজ পতাকা। সেদিনের সেই সূর্যের আলোয় ছিল নতুন দিনের স্বপ্ন, যে স্বপ্ন অর্জনে অকাতরে প্রাণ দিয়েছিল এ দেশের ৩০ লাখ মানুষ। কিন্তু বিজয় অর্জনের ৪১ বছর পরও সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পায়নি, শেষ হয়নি মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রাম। সেই সাম্যে দেশ আজও হয়ে ওঠেনি বাংলাদেশ।

আনন্দ-উৎসব এবং শোক-শ্রদ্ধার অপূর্ব সম্মিলনে দেশজুড়ে রোববার উদযাপিত হবে ৪২তম বিজয় দিবস। মুক্তিযুদ্ধে সুমহান বিজয়ের ৪১তম বার্ষিকী।

নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের আজকের দিনটিতেই বাঙালি জাতি চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করেছিল। ঢাকায় দখলদার পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে এদিনই স্বাধীনতার রক্তিম সূর্যালোকে উদ্ভাসিত হয়েছিল স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।

একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বাধীনতার স্পৃহায় জেগে ওঠা বাঙালিকে স্তব্ধ করতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ২৫ মার্চ কালরাতে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যায় মেতে ওঠে। সেই গণহত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষের ভাগ্যাকাশে নেমে এসেছিল ঘোর অমানিশা।
 
দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অবশেষে এগিয়ে আসে বিজয়ের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ঢাকার ত‍ৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজীর নেতৃত্বে আত্মসমর্পণ করে ৯৩ হাজার হানাদার সেনা। ১৬ ডিসেম্বর বিকেল ৪টা ৩১ মিনিটে মুজিবনগর সরকারের পক্ষে গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকারের উপস্থিতিতে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল জ্যাকবের তৈরি করা আত্মসমর্পণ দলিলে সই করেন পাকিস্তানের পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী এবং মিত্রবাহিনীর পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। আর অবিস্মরণীয় সেই মুহূর্তেই পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নেয় বাংলাদেশ নামে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাঙালি জাতি পায় লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত এবং মানচিত্র। রক্তাক্ত পথ ধরে মুক্তিযুদ্ধের এই বিজয় অর্জন ছিল ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতি।

মহান বিজয় দিবস পালনে এবার নতুন সাজে সেজেছে বিজয়ী দেশের মানুষ। সারাদেশ ছেয়ে গেছে রক্তস্নাত লাল-সবুজ পতাকায়।

প্রত্যুষে ঢাকায় ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে মহান বিজয় দিবসের সূচনা হবে। আজ সরকারি ছুটির দিন। সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে নামবে কৃতজ্ঞ জনতার ঢল। বীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মহান ত্যাগের কথা স্মরণ করে কৃতজ্ঞ জাতি শহীদ বেদিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করবে। দেশব্যাপী আজ সব ভবনের শীর্ষে উড্ডীন থাকবে জাতীয় পতাকা। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া পৃথক বাণী দিয়েছেন।

এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক আহ্বান— এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।

সেদিন বঙ্গবন্ধু আরো নিদেংশ দেন, ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যার কাছে যা কিছু আছে তাই নিয়েই প্রস্তুত থাক।

২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালির ওপর অতর্কিতে হামলা করে গণহত্যা চালায়। এই রাতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেফতারের আগেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বানে সারা দিয়ে বাঙালি যার কাছে যা ছিল তাই নিয়ে প্রবল প্রতিপক্ষ পাকি হানাদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।

শুরু হয় চূড়ান্ত মুক্তিযুদ্ধ।

ছাত্র, যুবক, নারী, পুরুষ, কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষক, আইনজীবী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ সকল শ্রেণী পেশার মানুষ, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে।

মুক্তিযুদ্ধে দীর্ঘ নয় মাস পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আল বদর, আল সামস বাহিনী গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নি সংযোগ, লুটতরাজ চালায়। শহরের পর শহর, গ্রামের পর গ্রাম, বাড়ি, ঘর, ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দেয়।

নিরীহ সাধারণ বাঙালির ওপর চলে অকথ্য অত্যাচার, নির্যাতন। পাকিস্তানি বাহিনীর এই বর্বরতার বিরুদ্ধে ও বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ব বিবেক জাগ্রত হয়ে ওঠে।

প্রতিবেশী দেশ ভারত সরাসরি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। অস্ত্র, সৈন্য, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও সাধারণ মানুষকে আশ্রয় ও খাদ্যের ব্যবস্থা করে।

পাশাপাশি বিশ্বের গণতন্ত্রপন্থি ও মুক্তিকামী মানুষ বিভিন্নভাবে সমর্থন দিয়ে বাঙালির পাশে দাঁড়ায়।

মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় পাকি বাহিনী। পরাজয়ের শেষ মুহুর্তে হানাদাররা বাঙালিকে মেধাশূণ্য করার বর্বরকাণ্ডে মেতে উঠে।

নীল নকশা মোতাবেক আত্মসমর্পণের এক দিন আগে ১৪ ডিসেম্বর জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে নিশংসভাবে হত্যা করে। রাজধানীসহ সারাদেশে তারা তালিকা করে বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞ চালায়।
এদিকে, যথাযোগ্য মর্যাদায় মহান বিজয় দিবস উদযাপন উপলক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পসত্মবক অর্পণ করবেন। দিবসটি উপলক্ষে আজ সকালে তেজগাঁও পুরনো বিমানবন্দরের জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে সম্মিলিত বাহিনীর কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুচকাওয়াজ পরিদর্শন এবং সালাম গ্রহণ করবেন।

মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে সকল সরকারি-বেসরকারি টিভি চ্যানেলে প্রচার করা হবে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা, সংবাদপত্রগুলো বের করেছে বিশেষ ক্রোড়পত্র। রাতে গুরুত্বপূর্ণ ভবনসমূহে আলোকসজ্জা করা হবে। ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন শহরের প্রধান সড়ক ও সড়কদ্বীপসমূহ জাতীয় পতাকাসহ রঙ-বেরঙের পতাকা দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে। হাসপাতাল, কারাগার, এতিমখানা, ভবঘুরে কেন্দ্রসমূহে পরিবেশন করা হবে উন্নতমানের খাবার।

বহির্বিশ্বের বাংলাদেশের মিশনসমূহে বিজয় দিবস উদযাপন উপলক্ষে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। দেশের অব্যাহত শান্তি, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি কামনা করে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডায় বিশেষ দোয়া মোনাজাত ও প্রার্থনা করা হবে।

আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনগুলো যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে বিজয় দিবস উদযাপনের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

নিউজরুম

শেয়ার করুন