ঢাকা (১৪ ডিসেম্বর) : পদ্মাসেতু দুর্নীতির দীর্ঘ নাটকীয়তার পর অবশেষে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীকে এজাহারভুক্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
বৃহস্পতিবার মামলার দিনক্ষণ পিছিয়ে সোমবারই এ দু`জনসহ নয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করার প্রস্তুতি নিয়েছে দুদকের অনুসন্ধান টিম।
বিশ্বব্যাংকের কাছে দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদন গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ প্রমাণ করতেই শেষ পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। তবে মামলার এজাহারে আবুল হোসেন ও আবুল হাসানকে সরাসরি আসামি করা না হলেও পরোক্ষভাবে আসামি করছে কমিশন।
পদ্মাসেতুর পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে বৃহস্পতিবার মামলা হবে বলে গত বুধবার জোর দিয়ে বলেছিলেন দুদক কমিশনার মো: সাহাবউদ্দিন চুপপু। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়েও তাই গণমাধ্যমকর্মীদের ভিড় ছিল লক্ষণীয়। শেষ পর্যন্ত মামলার দিনক্ষণ পেছায় দুদক।
প্রথমবারের মতো ষড়যন্ত্রের অপরাধে মামলা
দুদকের আইন বিভাগ জানায়, বাংলাদেশে এই প্রথম দুর্নীতির অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র হিসেবে মামলা হচ্ছে। ইতিপূর্বে দেশে ষড়যন্ত্রমূলক অপরাধের (অপরাধ সংঘটিত হয়নি তবে পরিকল্পনা ছিল) কোনো মামলা হয়নি। পদ্মাসেতু দুর্নীতির ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে মামলার মাধ্যমেই দেশের আইনে নতুন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন হবে। এর মাধ্যমে মানুষ বুঝবে অপরাধ হওয়ার আগেই অপরাধের পরিকল্পনা করলেও মামলা হয়।
দুদকের আইন উপদেষ্টা আনিসুল হক বাংলানিউজকে বলেন, “অপরাধ করার পরিকল্পনা করলেও ষড়যন্ত্রকারী বা পরিকল্পনাকারী হিসেবে আইনে তাকে দোষী বলা যায়। যদি বোঝা যায় যে তিনি বা তারা অপরাধ করতে চেয়েছেন। অপরাধ সংঘটিত হওয়া যেমন অপরাধ তেমনি অপরাধ করার চেষ্টা বা চিন্তা করাও আইনের ধারায় অপরাধ।”
মামলার দিনক্ষণ পেছানোর কারণ
বৃহস্পতিবার সরকারের উচ্চমহলের `গ্রিন সিগনাল` ও দুদকের একটি অংশের কঠোর অবস্থানের কারণেই বৃহস্পতিবার মামলার তারিখ পরিবর্তন করে আগামী সোমবার মামলা করার সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে দুদককে বারবার বলা হয়েছিল পদ্মাসেতু প্রকল্পে দুর্নীতির সঙ্গে আবুল হোসেনসহ কয়েকজনের ভূমিকা ছিল। তাকে ছাড়া ব্যবস্থা নিলে তা দুদকের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। বিশ্বব্যাংকও জানতে পেরেছে আবুলকে ছাড়া মামলা করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে দুদক তাই গত শনিবার সংস্থাটির পক্ষ থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়, সুষ্ঠু প্রতিবেদন না হলে এ প্রকল্পে অর্থায়ন করবে না কমিশন। দুদকের ভূমিক গ্রহণযোগ্য করতে শেষ পর্যায়ে আবুলের বিরুদ্ধে পরোক্ষ বা সহযোগী আসামি হিসেবে মামলার সিদ্ধান্ত নেয় দুদক।
দুদকের অনুসন্ধান সূত্র জানায়, প্রতিবেদনে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে এ প্রকল্পে দুর্নীতির সঙ্গে তারও ভূমিকা ছিল। এজন্য তাকে দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে তার সংশ্লিষ্টতার কথা উল্লেখ করে মামলার সুপারিশও করেছিল অনুসন্ধান টিম। ৪ নভেম্বর নয়জনের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশসহ অনুসন্ধান টিম তাদের প্রতিবেদন কমিশনে জমা দেয়।
প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে কমিশন প্রথমে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে ছাড়া মামলা দায়ের করবে। বৃহস্পতিবারই মামলা করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কিন্তু একপর্যায়ে কমিশন বুঝতে পারে এতে দুদকের ভূমিকা বিশ্বব্যাংক ও দেশের মানুষের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। শেষ পর্যন্ত সেই অবস্থান থেকে ফিরে আসে দুদক।
বৃহস্পতিবার সকালে দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান, দুই কমিশনার মো: বদিউজ্জামান, মো: সাহাবউদ্দিন চুপপু ও মহাপরিচালক (আইন) কামরুল হোসেন মোল্লা মামলার বিষয়ে বৈঠক করেন। বৈঠকেই সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসানকে মামলায় এজাহারভুক্ত করার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়।
নাম গোপন রাখার শর্তে দুদকের অন্যতম শীর্ষ কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, “সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীসহ অনুসন্ধান প্রতিবেদনে যাদের বিরুদ্ধে সুপারিশ করা হয়েছে শেষ পর্যন্ত সবার বিরুদ্ধে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে মামলার এজাহারভুক্ত আসামী করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর আগে সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করার অনুমতি দিয়েছিল দুদক। আজ (বৃহস্পতিবার) আরও একাধিক নাম যুক্ত হয়েছে। তাদের নাম এজাহারে সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে উপস্থাপন করা হবে।”
মামলায় আসামি হচ্ছেন যারা
বুধবার রাতে পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগের দুর্নীতির মামলায় সাতজনের বিরুদ্ধে এজাহার লেখার কাজ শেষ হয়। বৃহস্পতিবার এজাহারে আবুল হাসান ও আবুল হোসেনের নামও উঠে আসে।
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, এজাহারে নয়জনের বিরুদ্ধে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতার কথা লেখা হয়েছে। সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে রয়েছেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী।
এছাড়া প্রত্যক্ষভাবে মামলার আসামি করা হয়েছে-সাবেক সেতুসচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, সেতুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগে দরপত্র মূল্যায়নে গঠিত কমিটির সদস্য সচিব কাজী ফেরদৌস, সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী রিয়াজ আহমেদ জাবের, এসএনসি-লাভালিনের স্থানীয় এজেন্ট মো. মোস্তফা এবং এর তিন কর্মকর্তা সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেস, আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ সাহ ও সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইলকে।
মামলার বাদী হচ্ছেন যারা
সূত্র জানায় দুদকের চারজন কর্মকর্তা এসব মামলার বাদী হচ্ছেন। এরা হচ্ছেন জ্যেষ্ঠ উপ-পরিচালক আবদুল্লাহ-আল জাহিদ, মীর জয়নুল আবেদীন শিবলী, গোলাম শাহরিয়ার চৌধুরী ও উপ-পরিচালক মির্জা জাহিদুল আলম।
দুদকের অনুসন্ধান টিমের এক কর্মকর্তা জানান, পদ্মাসেতু দুর্নীতির মামলা রমনা মডেল থানা ও বনানী থানায় মামলা হতে পারে। অথবা এ দু`টির যেকোনো একটিতেই হতে পারে।
জানা গেছে, দুর্নীতির অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের জন্য দণ্ডবিধির ১২০ (খ) ধারা, ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫/২ ধারা এবং পরস্পরের যোগসাজশে অপরাধ সংগঠনের জন্য দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা করবে দুদক।
পদ্মাসেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে ২০১১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর দুদকের উপপরিচালক মির্জা জাহিদুল আলমকে এ বিষয়ে তদন্তের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৮ অক্টোবর নিয়োগ করা হয় মীর জয়নুল আবেদিন শিবলীকে। তিনি তদন্ত শেষে চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি আবুল হোসেনকে নির্দোষ উল্লেখ করে প্রতিবেদন দাখিল করেন। এতে বিশ্বব্যাংক অসন্তোষ প্রকাশ করলে দুদকের চারজন উপ-পরিচালককে তদন্ত টিমে অন্তর্ভুক্ত করে একটি শক্তিশালী টিম গঠন করা হয়। এ পর্যায়ে ১৪ অক্টোবর ও ১ ডিসেম্বর দু’দফায় বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেল ঢাকা সফরে এসে কিছু গাইডলাইন দিয়ে যায়। গত শনিবার বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়, দুদক নিরপেক্ষ তদন্ত না করলে পদ্মাসেতু প্রকল্পে অর্থায়ন করবে না দাতা সংস্থাটি।
পদ্মাসেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক কর্তৃপক্ষ ১২০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল করে গত ২৯ জুন। পরে সরকার অভিযোগ অনুসন্ধানে বিশ্বব্যাংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি সই করার পর ‘শর্তসাপেক্ষে’ বিশ্বব্যাংক আবার অর্থায়নে ফিরে আসার ঘোষণা দেয় গত ২০ সেপ্টেম্বর। তবে দুদকের এ মামলায় এখন বিশ্বব্যাংক কতটা সন্তুষ্ট হবে সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
নিউজরুম