ঢাকা (১৪ ডিসেম্বর) : চৌদ্দই ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ইতিহাসের পাতায় কালো আখরে উৎকীর্ণ বেদনা বিধূর কালবেলা। ১৯৭১ সালের এ দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আলবদর-রাজাকার বাহিনীর সহযোগিতায় নারকীয়ভাবে হত্যা করেছিল এ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের।
চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের ঠিক দু’দিন আগে দিশাহারা হানাদার পাকিবাহিনী পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে দেশকে মেধাশূন্য করার পরিকল্পনা নিয়ে এই নির্মম হত্যাকাণ্ড চালায়।
জাতির বহুল আকাঙ্ক্ষিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে এসেছে। এ বিচার বর্তমান সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার। এবারের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস তাই পালিত হচ্ছে ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে।
রাজাকার ও মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের শীর্ষ নেতারা এখন কারাগারে বন্দি। বিজয়ের একচল্লিশ বছর পরে হলেও যুদ্ধাপরাধীরা এখন আনুষ্ঠানিক বিচারের মুখোমুখি। শত ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত ও বাধার মুখেও বর্তমান সরকারের মেয়াদেই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন ও রায় কার্যকরের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। গোটা জাতি আজ অধীর আশায় বুক বেঁধেছে, হয়ত বিজয়ের মাস ডিসেম্বর থেকেই ঘৃণ্য নরপশু বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী যুদ্ধাপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার রায় জাতি দেখতে পারবে।
আজকের দিনটিতে তাই জাতি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করার পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ শেষ করে দ্রুত রায় কার্যকরের দাবি জানাবে সোচ্চার কণ্ঠে।
স্বাধীনতার দীর্ঘদিন পরে হলেও গোটা জাতি আজ অধীর আশায় বুক বেঁধেছে, বিচারের রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে জাতি আরেকটি কলঙ্কের হাত থেকে মুক্তি পাবে।
১৯৭১ সালের ৯ মাস রক্তগঙ্গা পেরিয়ে গোটা জাতি যখন উদয়ের পথে দাঁড়িয়ে, পূর্ব দিগন্তে টগবগিয়ে বিজয়ের লাল সূর্য উদিত হচ্ছে, দেশ যখন স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে- ঠিক তখনই বাঙালির কৃতি সন্তানদের নৃশংসভাবে হত্যা করে পরাজয়ের গ্লানিমাখা পাকিস্তানি হানাদার আর তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস ও শান্তিকমিটির সদস্যরা।
বধ্যভূমিতে বড় অসহায়ভাবে নিঃশেষে প্রাণ দেন দেশসেরা শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীরা।
রণক্ষেত্রে বীর বাঙালির হাতে নাস্তানাবুদ হয়ে শেষে এ জাতিকে মেধাশূন্য করতে সুদূরপ্রসারী ঘৃণ্য নীলনকশা আঁকা হয়েছিল। এর ইন্ধনে ছিল রাজাকার বাহিনী। তারাই পাকিস্তানি খান সেনাদের চিনিয়ে দিয়েছিল কাকে হত্যা করলে এ দেশ মেধাশূন্য হবে। রাজাকাররা চেয়েছিল, জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে।
এ রাতেই তালিকা ধরে ঘর থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে নিয়ে যাওয়া হয় অজ্ঞাত স্থানে। হত্যা করে ফেলে রাখা হয় নিস্তব্ধ ভুতুড়ে অন্ধকারে। জাতি হারায় তার অসংখ্য মেধাবী সন্তানকে। পরদিন ঘুম থেকে জেগে প্রায় ছুঁই ছুঁই স্বাধীনতার আনন্দে উদ্বেল মানুষ জানতে পারেন এ নৃশংস হত্যাযজ্ঞের কথা। মুহূর্তে স্থবির হয়ে যায় সব আনন্দ-কোলাহল।
অন্যদিকে, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করে উল্লাসে ফেটে পড়ে এ দেশীয় নরঘাতকরা।
স্বাধীনতার ৪১ বছর পরও শুক্রবার গভীর কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করছে দেশের শহীদ কৃতিসন্তানদের। শোকাহত মানুষের ঢল নামবে সেদিনের সেই হত্যাযজ্ঞের স্মৃতিবিজড়িত রায়েরবাজারে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থান আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতিস্তম্ভে। সেখানে অর্পণ করা হবে পুষ্পার্ঘ্য। শোকে আপ্লুত বাঙালি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে প্রয়াত বুদ্ধিজীবীদের। বেদীমূল ঘিরে থাকবে তাদের পরিবারের সদস্য, ভক্ত-শুভানুধ্যায়ীদের চাপাকান্না ও অশ্রুতে ভিজে উঠবে স্বজনের ভালবাসার অর্ঘ্য। দেশের সর্বখানে আজ জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। শোকের প্রতীক কালো পতাকাও উড়বে।
ডিসেম্বরের ১০ থেকে ১৪ তারিখ পর্যন্ত সে তালিকা ধরে বৃদ্ধিজীবী হত্যার ঘৃণ্যতম অপকর্মটি করে এই ঘাতক চক্র। সান্ধ্য আইনের মধ্যে রাতের আঁধারে তালিকাভুক্ত বুদ্ধিজীবীদের বাসা থেকে চোখ বেঁধে রায়েরবাজার এবং মিরপুর বধ্যভূমিতে নিয়ে গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বিজয় অর্জনের পর স্বাধীন বাংলাদেশে রায়েরবাজার, মিরপুরসহ কয়েক জায়গায় পাওয়া যায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ক্ষতবিক্ষত বিকৃত লাশ।
একাত্তরের ডিসেম্বরে হত্যাযজ্ঞের শিকার শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রকৃত সংখ্যা এখনও নিরূপণ করা হয়নি। প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বাংলা পিডিয়ায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের যে সংখ্যা দাঁড় করানো হয়েছে, সে অনুযায়ী, একাত্তরে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ছিলেন ৯৯১ শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ চিকিৎসক, ৪২ আইনজীবী এবং ১৬ জন শিল্পী-সাহিত্যিক ও প্রকৌশলী।
এঁদের মধ্যে রয়েছেন- ড. জি সি দেব, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক জ্যেতির্ময় গুহঠাকুরতা, সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য. ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীরুজ্জামান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরী, ড. গোলাম মোর্তজা, ড. মোহাম্মদ শফি, শহীদুল্লাহ কায়সার, সিরাজউদ্দিন হোসেন, নিজামুদ্দিন আহমেদ লাডু ভাই, খন্দকার আবু তালেব, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, শহীদ সাবের, নাজমুল হক, আলতাফ মাহমুদ, নূতনচন্দ্র সিংহ, আর পি সাহা, আবুল খায়ের, রশীদুল হাসান, সিরাজুল হক খান, আবুল বাশার, ড. মুক্তাদির, ফজলুল মাহি, ড. সাদেক, ড. আমিনুদ্দিন, সায়ীদুল হাসান, হাবিবুর রহমান, মেহেরুন্নেসা, সেলিনা পারভীনসহ আরও অনেকে।
যথাযোগ্য মর্যাদায় শোকের আবহে শুক্রবার পালিত হচ্ছে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস।
এ উপলক্ষে রায়েরবাজার বধ্যভূমি ও মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্তান এলাকায় নেওয়া হয়েছে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। দেশব্যাপী বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নিয়েছে নানা কর্মসূচি।
এর মধ্যে রয়েছে শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, আলোচনাসভা, গান, আবৃত্তি, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ও আলোকচিত্র প্রদর্শনী, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা।
দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি তাঁর বাণীতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেন, “বিজয়ের প্রাক্কালে হানাদার বাহিনী পরিকল্পিতভাবে এদেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পীসহ বহু গুণীজনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। জাতিকে মেধাহীন করাই ছিল তাদের হীন উদ্দেশ্য। এ বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে নতুন প্রজন্মকে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে এগিয়ে আসবে বলে আমার বিশ্বাস।”
প্রধানমন্ত্রী তাঁর বাণীতে দলমত নির্বিশেষ দেশের সব নাগরিককে একাত্তরের ঘাতক, মানবতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী জামায়াতচক্রের সব ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ বাধাগ্রস্ত করতে একাত্তরের পরাজিত শক্তি জামায়াত ও তাদের দোসররা নতুন করে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। দেশব্যাপী ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। বর্তমান সরকার দেশে আইনের শাসন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখতে সব হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং দেশবিরোধী যে কোনো ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে বদ্ধপরিকর।”
কর্মসূচি:
যথাযোগ্য মর্যাদায় ও শোকের আবহে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন নিয়েছে বিস্তারিত কর্মসূচি। অনুষ্ঠানের পবিত্রতা রক্ষার্থে ডিএমপি পুলিশ ভিআইপিদের পুষ্পস্তবক অর্পণের সময় মাইক না বাজানো এবং তাঁদের গমনাগমনের পথে তোরণ নির্মাণ না করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
আওয়ামী লীগের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- ১৪ ডিসেম্বর ভোরে কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু ভবন ও সারাদেশের দলীয় কার্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন, জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ, সকাল ৮টায় মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে, সাড়ে ৮টায় বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে এবং সকাল ৯টায় রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন এবং বিকেল ৩টায় ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আলোচনা সভা।
সাজেদা চৌধুরীর সভাপতিত্বে এতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাখবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বিএনপি কালো পতাকা উত্তোলন, জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ এবং মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে শ্রদ্ধা নিবেদন ছাড়াও বিকেল ৩টায় নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।
জাতীয় পার্টি, সিপিবি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, সাম্যবাদী দল, গণফোরাম, জাতীয় পার্টি (জেপি), মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বাংলা একাডেমী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিসহ অজস্র সংগঠন বুদ্ধিজীবী দিবস পালনে নিয়েছে বিস্তারিত কর্মসূচি।
এ ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন দিনটি পালনের জন্য কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।
নিউজরুম