নদীর পাড়ে মাটিতে একটি নারকেল গাছে হেলান দিয়ে বসে আছে হাফিজ। নদীর ঢেউ পাড়ে এসে আছড়ে পড়ছে। প্রতি বছর জমিতে পদ্মার পলি জমে তার জমিকে করেছে উর্বর। প্রতি বছর ফসল ফলিয়ে সংসার চালায় সে। একটি মাত্র ছেলে তার। গাঁযের দস্যি ছেলেদের সাথে চলাফেরা করে লেখাপড়া করা হয়নি একমাত্র ছেলের। তাতে তার কোনো ক্ষোভ নেই। জমি চাষ করে দিনতো ভালোই যাচ্ছে তাই বলে কখনো আফসোস করেনি হাফিজ। এর মধ্যে বিয়েও করে ফেলেছে। তাই তার আর কোনো দুশ্চিন্তা নেই তার। অভাব অনটন না থাকলে দুশ্চিন্তা কিসের। পদ্মা তাই অনেক প্রিয় চাষী হাফিজের। সূর্যের আলো পদ্মাজলে পড়ে চিকচিক করছে। মনে হচ্ছে সোনায় মিশে গেছে জল। সারা জীবন পদ্মার এ চাকচিক্য ভালো লাগলেও আজ তার কিছুতেই ভালো লাগছে না পদ্মার জল খেলা।
ভালো না লাগার অন্যতম কারণ হলো পদ্মা আজ তাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। উচ্চবিলাস কিংবা আভিজাত্য তার কখনো প্রত্যাশা না থাকলেও দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের ব্যবস্থা ছিলো তার সাধ্যের মধ্যে। তবু বিধিবাম। পাকা ধানে মই দিলো পদ্মা। রাক্ষুসী পদ্মা কেড়ে নিলো হাফিজের নগন্য অবলম্বনটুকু। তাই পদ্মার পাড়ে বসে স্মৃতিরোমন্থন করছে সে। নিজে কী করবে ছেলে, ছেলে বৌকে কী খাওয়াবে, কই থাকবে সে ভাবনায় কিনারা পায় না সে। অনেকটা গভীর সমুদ্রের তলদেশ খুঁজে না পাওয়ার মতো।
শ্বশুর বাড়ি নদী গর্ভে চলে যাওয়ার মাথা গোঁজার অভাবে বাপের বাড়ি চলে গেছে ছেলে বৌ নাজমা। বৌয়ের সাথে শ্বশুর বাড়িতে ঘাঁটি গেড়েছে হোসেন। কাজ কর্ম না থাকায় বেশ কিছুদিন অর্ধাহারে অনাহারে এ-দুয়ার ও-দুয়ার ঘুরে দিন যাচ্ছে হাফিজের। না খেয়ে না খেয়ে খানিকটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে সে। উপায় না পেয়ে বিয়াই বাড়ি আশ্রয় নিলো হাফিজ।
মধ্যাঙ্ক
দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়ে সাময়িক সময় কাটলেও এখন দিনে দিনে দুর্বিষহ হয়ে উঠছে হাফিজের জীবন। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে সে। এই শরীরখানা আজ তার কাছে ভার হয়ে পড়েছে। কিছুতেই বয়ে বেড়াতে পারছে না। জীবনাকাশের পশ্চিম কোণে হেলে পড়েছে সূর্যখানা। সংগ্রামী জীবনের পড়ন্ত বেলায় পরাজিত সৈনিকের মতো অসহায় হয়ে পড়েছে হাফিজ। নিজের শরীরে বল না থাকায় কাজ করতে পারে না। একমাত্র ছেলে কাজের অভাবে শ্বশুর বাড়িতে ঘর জামাই হয়ে বৌ এর কথায় উঠে বসে। অদৃশ্য শেকলে বাঁধা তার পা। প্রতিনিয়ত জন্মদাতার সাথে বাগদত্তার অমন অসময় আচরণ দেখেও চোখ বুঁজে সহ্য করতে হয়। বাবার অমন অসহায়ত্বে কোনো ভূমিকা রাখতে না পারায় নিজের উপর প্রচণ্ড বিরক্ত সে। আবার বাবার উপরও কিছুটা বিরক্ত হয়। যখন তার সোনালি সুদিন ছিলো তখন কেন বাবা পদ্মা থেকে দূরের বিলে এক খণ্ড জমি কিনেনি। কেন কিছু টাকা ব্যাংকে জমা রাখেনি। তবেইতো আজ এ দুঃসময় পার করতে হতো না। আবার নিজের উপর বিরক্ত হয় নিজে কেন লেখাপড়া করলো না। কিছুটা লেখা পড়া জানা থাকলে অন্তত শহরে গিয়ে কাজ করে দু’বেলা দু’মুঠো অন্নের সংস্থানতো করতে পারতো। প্রচণ্ড বিরক্তিতে নিজের চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে তার।
বৃদ্ধ হাফিজ বাড়ির বাইরে পথের ধারে বসে বাচ্চাদের মতো কঁকিয়ে কাঁদছে। কাজের সন্ধান শেষে বাড়ি ফেরার পথে বাবাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে হোসেন। বেশ কিছুদিন বাবার সামনে পড়ে না সে। বাবাকে দেখলে চোরের মতো লুকিয়ে থাকে। নিজের অসহায়ত্বের কাছে পরাজিত হয়ে জীবন থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে হোসেন। বাবার চোখে জল, আর সহ্য হয়না এই অত্যাচার। বাবার পাশে বসতেই আবেগী হয়ে পড়ে হাফিজ। হাউমাউ করে কেদে উঠে সে। হাফিজ বলছে আমি আর পারতাছিনা বাজান। আমারে হয় মাইরা ফালা না হয় একটু ভালো কইরা খাইতে দে। চোখের জল ধরে রাখতে পারে না হোসেন। কিন্তু সে নিরুপায়। নিজেই বেঁচে আছে শ্বশুর বাড়ির দয়ায়।
আজও খেতে দেয়নি হাফিজকে তার ছেলের বৌ। আজ তিন দিন হলো খাবার বন্ধ করে দিয়েছে। এর আগে বেশ কয়েক মাস একবেলা দু’বেলা স্বল্প পরিমাণে খেতে দিতো। যে পরিমাণ খাবার প্রয়োজন তার তুলনায় নগন্য হওয়ায় প্রতিদিনই ক্ষুধার জ্বালায় কাতরাতো হাফিজ। ছেলের কাছে বলেও কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি। হাফিজের মতে সাড়া দিলো না নিজের ঐরশের সন্তান। কিন্তু বাবাকে লুকিয়ে খাবার চেষ্টা করেছে সে। দু’এক বার মিশন সফল হলেও বেশির ভাগ মিশন ব্যর্থ হয়ে শাস্তিস্বরূপ নিজকেই উপোস থাকতে হয়েছে। বাবার কষ্টে নীরবে কেঁদেছেও হোসেন। কিন্তু নিজের উপার্জন ক্ষমতা না থাকায় অসহায়ত্বের কারণে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে বারবার।
জমি চাষ ছাড়া অন্যকোনো কাজ জানা নেই তার। গ্রামে জমি চাষ ছাড়া তেমন কাজও নেই, শহরে অনেক ধরনের কাজ থাকে। রঙিন শহরের সাথে তার পরিচয় নেই। হাফিজের পৃথিবী অত্যন্ত ছোট। এই ছোট পৃথিবীর আলোও দিনে দিনে কমে আসছে। এখনি নামবে বুঝি অন্ধকার।
শেষাংক
নাজমাদের বাড়িতে পুলিশ। বাড়ীর চারপাশে উৎসুক গ্রামবাসীর অসংখ্য চোখ বাড়িটির দিকে। এক নজর দেখার জন্য। পুলিশি ব্যারিকেডের কারণে বাড়ির আঙ্গিনায় প্রবেশ করতে পারছে না পড়শিরা। ভেতরে কী হচ্ছে তা জানতে উৎসাহী মানুষের কৌতূহল যেন বেড়েই চলছে। ভেতরে কী হচ্ছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। অস্পষ্ট আওয়াজ খরগোসের মতো কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করছে সবাই।
নাজমাদের ঘর থেকে একজন একজন করে বের হচ্ছে পুলিশ। রহস্যের পরিসমাপ্তি ঘটার পথে। পুলিশ এসে কৌতূহলি গ্রামবাসীদের মধ্য থেকে স্বাস্থ্যবান চারজনকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো। এরমধ্যে কিছুটা সময় গত হয়েছে। অপেক্ষর প্রহর যেন শেষ হচ্ছে না। অবশ্য গ্রামের মানুষের তেমন কাজ কর্ম নেই, তাই ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে বায়োস্কোপ দেখার মতো অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নাজমাদের ঘরের দিকে। পুলিশের বের হতে দেরি দেখে ভেতরে গিয়ে দেখতে চায় আসলে কী ঘটছে। কিন্তু বাধা আছে। পুলিশ হলুদ প্লাস্টিকের ফিতা লাগিয়ে দিয়েছে। যাতে লেখা ডোন্ট ক্রস দিস এরিয়া। নিরক্ষর গ্রামবাসীদের প্রতি এ এক প্রহসনই বটে।
এই মাত্র কিছু একটা কাঁধে নিয়ে ঘর থেকে বের হচ্ছে পুলিশ। হোগলা পাতার পাটিতে মুড়িয়ে ঘর থেকে কী বের করছে পুলিশ গ্রামের এই সাধারণ মানুষের তা বুঝবার কথাও নয়। কারণ তারা থানা পুলিশ কিংবা আইনি পরিস্থিতে তেমন অভ্যস্ত নয়। সবাই উদগ্রীব হয়ে আছে কী করে হলো তা জানতে। এই মাত্র আমজাদ এসে হাজির হলো তার বাড়ি। বাড়ির উপর এতো মানুষ, পুলিশ। ঠিক বুঝতে পারছে না কেন এ অবস্থা। আমজাদ ভিড় ঠেলে এগিয়ে যায় সামনের দিকটায়। পুলিশের কাছে জানতে চায় কী হয়েছে? ঘটনা শুনে আমজাদ জানতে চায়, ঘরে কাউকে পাওয়া গেছে কিনা। পুলিশ না-সূচক মাথা নাড়ে। একমাত্র সাক্ষী হিসেবে আর্ভিভাব ঘটে আমজাদের।
পুলিশের প্রাথমিক তথ্য বিবরনীতে রিপোর্ট লেখা হয়, ক্ষুধার তাড়নায় আত্মহত্যা করেছে হাফিজ।