কুষ্টিয়া ৩ উপজেলার অধিকাংশ আখ চাষীরা কুষ্টিয়া চিনিকলে আখ সরবরাহ না করে নিজেরাই বাড়িতে পাওয়ার ক্রাশারে (স্যালো ইঞ্জিনচালিত আখ মাড়াই মেশিন) আখ মাড়াই করে গুড় তৈরি করছেন। জেলার ৩ উপজেলার প্রায় দুই শতাধিক পাওয়ার ক্রাশারে আখ মাড়াই করার কারনে চিনিকলের বিভিন্ন ইক্ষু ক্রয় কেন্দ্র গুলোতে আখ সরবরাহ কমে গেছে। ফলে চলতি ২০১২-১৩ মাড়াই মৌসুমে কুষ্টিয়া চিনিকলে এবার ৮৫ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে ৫ হাজার ৪০০মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে। চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হওয়ার আশংকা রয়েছে। কুষ্টিয়া চিনিকলের এক শ্রেনী কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা গুড় তৈরি করার সাথে সহযোগিতা ও জড়িত রয়েছে। এরা পাওয়ার ক্রাশারের (স্যালো ইঞ্জিনচালিত আখ মাড়াই মেশিন) মালিকদের কাছ থেকে উৎকোচ গ্রহন করছে।
ভেড়ামারা দৌলতপুর ও মিরপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের কৃষকরা বাড়িতে ও আখের জমিতে পাওয়ার ক্রাশার মেশিন বসিয়ে আখ মাড়াই করে গুড় তৈরি করছেন । স্যালো ইঞ্জিনের সাথে মাড়াই মেশিন সংযুক্ত করে তৈরি ‘পাওয়ার ক্রাশার’ চলে ডিজেলে। ক্রাশারের হুইল (চাকা) যতক্ষন ঘুরবে, ততক্ষন আখ মাড়াই চলবে। মাড়াইকরা আখের রস একদিকে পাত্রে সংরক্ষন করা হয় এবং অপরদিকে ছোঁবড়া বের হয়। পরে রসগুলো বড় একটি লোহার পাত্রে জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করা হয়। এই গুড়কেই ঝোলা গুড় বলা হয়।
আখচাষীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কুষ্টিয়া চিনিকলে আখ সরবরাহ করার তুলনায় পাওয়ার ক্রাশারে আখ মাড়াই করা লাভজনক। চিনিকলে এক গাড়ি (১২০০ কেজি) আখ দিলে ২৯১৪ টাকা ৪৪ পয়সা পাওয়া যায়। অপরদিকে পাওয়ার ক্রাশারে আখ মাড়াই করলে পাওয়া যায় ৩৮’শ থেকে ৪২’শ টাকা। এ ছাড়াও আখ ক্রয়কেন্দ্রে ওজনে কম দেয়া, চিনিকল থেকে দেরিতে পুর্জি (আখ সরবরাহের অনুমতিপত্র) পাওয়া ও পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারনে কৃষকরা চিনিকলে আখ সরবরাহ করছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাদের অভিযোগ, সময় মতো পুর্জি না পাওয়ার কারনে দীর্ঘদিন ধরে জমিতে আখ পড়ে থাকে। তখন আস্তে আস্তে আখ শুকিয়ে যায়। জমিতে আখ থাকায় অন্য ফসল আবাদ করা কৃষকের পক্ষে সম্ভব হয় না। পরবর্তী ফসল আবাদ ও চিনিকলের হয়রানি থেকে রেহাই পেতেই কৃষকরা পাওয়ার ক্রাশারে আখ মাড়াইয়ের প্রতি ঝুঁকে পড়ছেন।
চিনিকল এলাকায় পাওয়ার ক্রাশারে আখ মাড়াই অবৈধ হওয়ার কথা জেনেও কৃষকরা গোপনে আখ মাড়াই অব্যাহত রেখেছেন। এ প্রসঙ্গে গোলাপনগর গ্রামের আখচাষী আসাদুল বলেন, পাওয়ার ক্রাশারে আখ মাড়াই করা অবৈধ তা আমরা জানি। কিন্তু কি করবো ? সুগার মিলে আখ দিলে টাকা পেতে অনেক দেরি হয়। ঝামেলা এড়াতে আমরা আখ মাড়াই করে গুড় তৈরি করছি। কুষ্টিয়া চিনিকলের এক শ্রেনী কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা গুড় তৈরি করার সাথে সহযোগিতা করছে। এরা তাদের দালালের মাধ্যমে প্রতি সপ্তাহে আমাদের কাছ থেকে মোটা অংকের উৎকোচ নিয়ে যায়।
ইক্ষু ক্রয় কেন্দ্রের পরিদর্শক বলেন, চাহিদা অনুযায়ী আমরা চাষীদের কাছ থেকে আখ পাচ্ছিনা। আমরা যদি ইক্ষু ক্রয়কেন্দ্র থেকে চিনিকলে পর্যাপ্ত আখ সরবরাহ করতে না পারি, তাহলে চলতি আখ মাড়াই মৌসুমে প্রত্যাশিত লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো সম্ভব হবে না। ইক্ষু ক্রয় কেন্দ্রে ওজনে কম দেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, বেশীরভাগ চাষীই অশিক্ষিত। সম্ভবত তারা ইক্ষু ওজন নিক্তির পরিমাপ (স্কেল) বুঝতে না পেরে হয়তো আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন।
পাওয়ার ক্রাশারে আখ মাড়াই প্রসঙ্গে কুষ্টিয়া চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজিজুর রহমান জানান, মিলজোন এলাকায় পাওয়ার ক্রাশারে আখ মাড়াই করা নিষিদ্ধ। অবৈধ ওই পাওয়ার ক্রাশারে যারা আখ মাড়াই করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। পাওয়ার ক্রাশারে আখ মাড়াই বন্ধ করতে কুষ্টিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা উৎকোচ নেওয়ার কোন সুযোগ নেই । এমন কোন প্রমান পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কুষ্টিয়া চিনিকলের গত মৌসুমের উৎপাদিত চিনির মধ্য সাড়ে ১৯শত মেট্রিক টন চিনি যার মূল্য সাড়ে ৯ কোটি টাকার চিনি গোডাউনে রেখেই ২০১২-১৩ মাড়াই মৌসুম শুরু হয়েছে। কেরিয়ারে আখ নিক্ষেপের মধ্য দিয়ে মাড়াই মৌসুমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধান মন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ও বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ। মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজিজুর রহমান জানান,আগামী মৌসুমে কুষ্টিয়া চিনিকলে বিপুল পরিমান আখ মাড়াই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি জানান,এবার ৮৫ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে ৫ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে। যার আহরন হবে ৭.২৫। গতবার ৩৫হাজার ৮শত মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে ২৩৫০মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন করা হয়। উৎপাদিত চিনির মধ্যে মাত্র ৪৫০ মেট্রিক টন চিনি বিক্রি হয় বাকী ১৯শত মেট্রিক টন চিনি যার মূল্য সাড়ে ৯কোটি টাকা অবিক্রিত অবস্থায় মিলের গোডাউনে পড়ে আছে। মিলের একটি সুত্রে জানা গেছে গত মৌসুমে মিল প্রায় ২২কোটি টাকার লোকশান গুনতে হয়েছে।
কুষ্টিয়া চিনিকলের আখ মাড়াই মৌসুম উদ্বোধনের দুই ঘন্টা পর বন্ধ হয়ে গেছে উৎপাদন কার্যক্রম। এতে চিনিকল বড় ধরনের ক্ষতির কবলে পড়েছে বলে দাবী সাধারণ শ্রমিকদের। বয়লারের স্টিমে নিম্নমানের ব্যাগাজ সরবরাহের কারনেই এমন পরিস্থিতি হয়েছে বলে দাবী করেছে শ্রমিকদের। চিনিকল শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি রেজাউল করিম দাবী করেছেন মাড়াই মৌসুমের শুরুতেই এমন বিপর্যয় মোটেও প্রত্যাশিত নয়। তিনি জানান দেশের বিভিন্ন চিনিকল থেকে বয়লারের স্টিম তোলার জন্য যে ব্যাগাজ ক্রয় করা হয়েছে তাতে বালি, ইটের অংশ বিশেষ আর ভেজা। একারনে ব্যাগাজে ফার্নেশ অয়েল ব্যবহার করেও স্টিম তোলা সম্ভব হচ্ছেনা। ব্যাগাজ আমদানীকারক(ঠিকাদার) ও কতিপয় সিবিএ নেতার কারসাজিতেই মিল শুরুতেই বিপর্যয়ের কবলে পড়েছে। মিলের বৃহত্তর স্বার্থে সংশি¬ষ্ট ঠিকাদার ও কতিপয় সিবিএ নেতার বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের দাবী জানান তিনি। এব্যাপারে কুষ্টিয়া চিনিকলের মহাব্যবস্থাপক(কারখানা) তোফাজ্জেল হোসেন জানান ঠিক কি কারনে বয়লারের স্টিম উঠছেনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে ব্যাগাজের কারনেও স্টিমে সমস্যা হতে পারে। বন্ধ থাকার পর পুনরায় মিল চালু হয়েছে।