নিজস্ব প্রতিবেদক, রাবি (০৫ ডিসেম্বর):
ভিসি’র অনিয়ম-দূর্নীত, নিয়োগ বাণিজ্য ও ছাত্রলীগ কর্তৃক সাংস্কৃতিক জোট সভাপতিকে মারধরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদী আন্দোলন কর্মসূচীতে উত্তাল হয়ে উঠেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। বুধবার ভিসি প্রফেসর আব্দুস সোবহানের অনিয়ম-দূর্নীতি, দলীয়করণ ও সীমাহীন নিয়োগ বাণিজ্যের প্রতিবাদে প্রশাসন ভবন অবরোধ করে অবস্থান ধর্মঘট কর্মসূচী পালন করে সচেতন শিক্ষক, কমকর্তা-কর্মচারীরা।
একই সময়ে সাংস্কৃতিক জোট সভাপতিকে মারধরের ঘটনায় অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বহিস্কারের দাবিতে প্রতিবাদ কর্মসূচী পালন করে সাংস্কৃতিক জোট ও প্রগতিশীল ছাত্র জোট নেতাকর্মী।
অন্যদিকে জামায়াত-শিবির প্রতিহতে ছাত্রলীগের পৃথক মানববন্ধন কর্মসূচী ও ভিসি সমর্থিত শিক্ষকদের জোটবদ্ধ মহড়া দেয়ার ঘটনায় উত্তেজনা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় ক্যাম্পাসে। তবে আগামী ৯ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ম সমাবর্তনের ঠিক ৪ দিন আগে ক্যাম্পাসের সৃষ্ট এ উত্তপ্ত পরিস্থিতি, সাদা দলের সমাবর্তন বয়কট এবং একই দিনে বিরোধী দলের রাজপথ অবরোধের কর্মসূচীকে ঘিরে সমাবর্তন বাসত্মবায়ন নিয়েও উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে এখানকার শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অংশগ্রহনকারীদের মধ্যে।
তবে পরিস্থিতি শান্ত রাখতে ক্যাম্পাসে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। ভিসি সমর্থিত শিক্ষকরাও পাল্টা কর্মসূচী দিতে ভিসিকে চাপ দিয়েছে বলেও প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে।অন্যদিকে ঐক্য পরিষদের ব্যানারে বঙ্গবন্ধু পরিষদ ও ছাত্রলীগের লাগাতার ভিসি বিরোধী আন্দোলন কর্মসূচীর কারণে অচলাবস্থা অব্যাহত রয়েছে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (রুয়েট)। ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকসহ সব একাডেমিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে অবস্থান ধর্মঘট পালন করেছে আন্দোলনকারীরা।
ভিসি’র নিয়োগ বাণিজ্যের প্রতিবাদে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের অবস্থান ধর্মঘট
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ৪ বছরে ভিসি প্রফেসর আব্দুস সোবহানের নিয়োগ বাণিজ্য, অনিয়ম-দূর্নীতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যাক্ট লঙ্ঘন, ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নির্যাতন ও সন্ত্রাসীদের লালনের প্রতিবাদে সকাল সাড়ে ১০টায় প্রশাসন ভবনে অবরোধ করে অবস্থান ধর্মঘট কর্মসূচী পালন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। দুই ঘন্টা ব্যাপী চলা এ অবরোধ কর্মসূচীর কারণে ভিসিসহ প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।
জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের সভাপতি প্রফেসর ড. আফরাউজ্জামান খান চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক ড. ফজলুল হকের পরিচালনায় অবস্থান ধর্মঘট চলাকালীন সমাবেশে বক্তব্য রাখেন, সাদা দলের আহবায়ক মু আজহার আলী, ইবির সাবেক ভিসি মু. রফিকুল ইসলাম, ড. আব্দুর রহমান সিদ্দিকী, ড. আব্দুর হাই তালুকদার, এম আব্দুর রাজ্জাক, ড. এম আবুল হাশেম, ড. জিলস্নুর রহমান, ড. এনামূল হক, ড. সৈয়দা আফরীনা মামুন, ড. নিজাম উদ্দিন, ড. শহিদুর রহমান চৌধুরী, কর্মকর্তা-কর্মচারী নেতা মনোয়ার হোসেন উৎপল, রুহুল আমিন, শহিদূল ইসলাম বাবু প্রমুখ। এসময় অন্যান্যের মধ্যে ড. মামনুনুল কেরামত, ড. মো. শামসুল আলম সরকার, ড. এফ নজরুল ইসলাম, সি এম মোসত্মফা, ড. মো. আমজাদ হোসেন, ড. আমিনুল হকসহ প্রায় দুই শতাধিক শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, বর্তমান ভিসি দায়িত্ব গ্রহনের পরই ক্ষমতার অপব্যবহার করে সম্পূর্ণ দলীয় দৃষ্টিকোন থেকে হল প্রাধ্যক্ষ ও বিভিন্ন ইনস্টিটিউটের পরিচালকদের অপসারণ করে অবাধে নিয়োগ বাণিজ্য চালাতে প্রশাসনে নিজস্ব বলয় তৈরী করে। সম্পূর্ন দলীয় বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ ও দপ্তরে বিজ্ঞাপিত পদের বিপরীতে দ্বিগুন সংখ্যাক অতিরিক্ত শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রায় ৫৩ কোটি টাকার বাজেট ঘাটটিতে ফেলে দেয়। তার দায়িত্বে থাকাকালীন গত ৪ বছরে ৫ ছাত্র নিহতসহ অসংখ্যা ছাত্র-শিক্ষক,কর্মকচারী নির্যাতনের শিকার হলেও তিনি কোন ঘটনার বিচার না করে উল্টো ছাত্রলীগকে চাঁদা তোলার কাজে উৎসাহিত করে হত্যাকান্ডকে আরও উস্কিয়ে দিয়েছে।
বক্তারা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যাক্ট লংঘন করে রাষ্ট্রপতির পরিবর্তে শিক্ষামন্ত্রী ও ঢাবির একজন বিতর্কিত শিক্ষককে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ম সামাবর্তন করতে যাচ্ছে। সাদা দলের শিক্ষ আসন্ন সমাবর্তন বয়কটের ঘোষণা দিয়ে বলেন, ভিসি তার অবশিষ্ট মেয়াদে কোন রকম নিয়োগ দেয়ার চেষ্টা করলে ভিসি পতনের একদফা আন্দোলনে যাবে শিক্ষকরা। পরে শিক্ষকরা ভিসির সাথে দেখা করে তাকে স্বারকলিপি দেন।
হামলাকারী ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের বহিস্কারের দাবিতে সাংস্কৃতিক জোটের র্যালী সমাবেশ:
গত সোমবার রাতে কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি আরিফ পারভেজের উপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে এবং জড়িতদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারসহ দৃষ্টামত্মমুলক শাসিত্মর দাবিতে গতকাল প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও র্যালী করেছে কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক জোট। বুধবার সিনেট ভবনের সামনে তারা এ কর্মসূচি পালন করে। একই ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে প্রগতিশীল ছাত্র জোট নেতারা।
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাকসু ভবন থেকে অর্ধশতাধিক সাংস্কৃতিক কর্মী মাথায় লাল কাপর বেধে র্যালি করে। র্যালী শেষে সিনেট ভবনের সামনে এক প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সেখানে তারা অস্ত্রমুক্ত ক্যাম্পাস চাই বিষয়ে একটি নাটিকা ও একাধিক গান পরিবেশন করে। এসময় সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বিশববিদ্যালয় নাট্যদলের সভাপতি আজমল হুদা মিঠু বক্তব্য রাখেন। পরে সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ভিসিকে সাথে সাক্ষাত করে জড়িত ছাত্রলীগ কর্মী সেতুর ছাত্রত্ব বাতিল ও তার সাথে থাকা ছাত্রলীগ কর্মী আসিফ এবং শাওন হলের আবাসিকতা বাতিল, ক্যাম্পাসে সাংস্কৃতিক কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানান।
তবে আন্দোলনের এক পর্যায়ে ভিসিপস্থী শিক্ষক ও প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের সভাপতি আনন্দ কুমার সাহার নেতৃত্বে একদল শিক্ষক এসে তাদের আন্দোলন বন্ধ করতে বলে। জোট নেতাকে মারধরে ঘটনায় বঙ্গবন্ধু হলের আবাসিক শিক্ষক এটিএম রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে হল প্রশাসনের উদ্যোগে তিন সদস্যের একটি তদমত্ম কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
ছাত্রলীগের মানববন্ধন:
এদিকে বেলা সাড়ে ১২ট টার দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি, হরতালের নামে দেশব্যাপী নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি্র প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে মানববন্ধন করে ছাত্রলীগ। এর আগে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ক্যাম্পাসে মহড়া দেয়। মানববন্ধনে প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের আহবায়ক প্রফেসর আনন্দ কুমার সাহা, ছাত্রলীগ সভাপতি আহম্মেদ আলী, সহ-সভাপতি ইলিয়াস হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক জহিরম্নল জাকিরসহ ৩০/৩৫জন নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। পরে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বক্তরা বলেন-জামায়াত-শিবির যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতেই দেশব্যাপী হরতালের নামে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে সীমাহীন দুর্ভোগ সৃষ্টি করছে। তারা ইতিপূর্বে কখনো জনকল্যাণে কাজ করেনি। এখনও করছে না। তারা শুধু মানুষকে দুর্ভোগে ফেলাতে পারে। বক্তারা জামাত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধেরও দাবি জানান।
ভিসিপন্থী শিক্ষকদের মহড়ায় উত্তেজনা:
এদিকে প্রশাসন ভবনের সামনে ভিসি বিরোধী কর্মসূচী নিয়ে সচেতন শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবস্থান ধর্মঘটের সময় তার পাশেই ভিসিপন্থী শিক্ষক-কর্মচারীদেরকে মহড়া দিকে দেখা গেছে। প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের আহবায়ক প্রফেসর আনন্দ কুমার সাহার নেতৃত্বে প্রায় শতাধিক শিক্ষক-কর্মচারী ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
প্রশাসনের একটি সূত্র জানিয়েছে, ভিসি প্রফেসর আব্দুস সোবহন তার অনুসারী ওই শিক্ষক-কর্মচারী ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদেরকে দিয়ে বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষককের আন্দোলনে ভয়-ভীতি সৃষ্টি করতেই সেখানে উপস্থিত থাকার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। পরে তারা ভিসির সাথে সাক্ষাত করে অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করেন। এসময় শিক্ষকরা বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের বিরম্নদ্ধে পাল্টা কর্মসূচী দেয়ার পরামর্শ দেন।
রুয়েটের অচলাবস্থা অব্যাহত:
ভিসি অপসারণ আন্দোলনের কারণে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) অচলাবস্থা অব্যাহত রয়েছে। গত ১৩ নভেম্বর থেকে ভিসি অপসারণের দাবিতে ঐক্য পরিষদের ব্যানারে বঙ্গবন্ধু পরিষদ ও ছাত্রলীগের লাগাতার আন্দোলনে ক্লাস-পরীক্ষসহ একাডেমিক সব কার্যক্রস বন্ধ রয়েছে রুয়েটে। ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকসহ সব একাডেমিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে অবস্থান ধর্মঘট করেছে আন্দোলনকারীরা।
রুয়েট ভিসি প্রফেসর ড. সিরাজূল করিম চৌধুরী বলেন, বুধবার রাতে উদ্ভত পরিস্থিতি নিয়ে সিটি মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা এএইচএম খায়রুজ্জামানের সাথে আন্দোলনকারীদের নিয়ে একটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে আমাকেও থাকতে বলেছে।
হয়তো সেখানে কোন সমাধান হতে পারে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়কে জিম্বি করে আন্দোলনকারীদের সমালোচনা করে তিনি বলেন, এভাবে একটা বিশ্ববিদ্যালয়কে জিম্বী করে রাখার অধিকার কোন গোষ্ঠীর নেই। তিনি আন্দোলনকারীদের অযৌক্তিক আন্দোলন প্রত্যাহারের দাবি জানান।
সম্পাদনা আলীরাজ,