রুপসীবাংলা, চুয়াডাঙ্গা (২৮ নভেম্বর) : চুয়াডাঙ্গার তিতুদহ গ্রামের খাসপাড়ায় গ্রাম্য সালিশের নামে মধ্যযুগীয় কায়দায় স্বামী-স্ত্রীকে জুতাপেটাসহ সমাজচ্যূত করে গ্রামছাড়া করেছে স্থানীয় মাতবররা।
দরিদ্র দিনমজুর আবদুর রহিম ও তার স্ত্রী শেফালী এ অপমান সইতে না পেরে ২০ নভেম্বর, মঙ্গলবার রাতের আঁধারে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। জোর করে ভিটেবাড়ি দখল করতে চাইলে তার প্রতিবাদ করায় গ্রাম্য সালিশে তাদের এ সাজা দেওয়া হয়।
জানা গেছে, সালিশে দিনমজুর রহিমের স্ত্রী শেফালীকে জুতাপেটা করার নির্দেশ জারি করা হয়। সে সময় স্ত্রীর সম্ভ্রম বাঁচাতে নিজের পিঠ পেতে দিয়ে সমাজপতিদের জুতার আঘাত সহ্য করেছেন রহিম।
গত ২০ নভেম্বর মঙ্গলবার রাতে এই হতভাগ্য দিনমজুর দম্পতি কোথায় পালিয়ে গেছেন, তা কেউ-ই বলতে পারছেন না। তবে কথিত সমাজপতিরা বহাল তবিয়তেই গ্রামে রয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে এখনও কেউ টুঁ-শব্দটি করার সাহস পর্যন্ত পাচ্ছেন না। দেরিতে পাওয়া খবরে গ্রামে গিয়ে এ তথ্য জানা গেছে।
এদিকে, এ ঘটনায় ২৫ নভেম্বর, রোববার রাতে আবদুর রহিমের মা জুলেখা বেগম ৯ জনের বিরুদ্ধে চুয়াডাঙ্গা সদর থানায় মামলা (নং-৩৯, তাং-২৫/১১/১২) করলেও এ পর্যন্ত কোনো আসামিকেই পুলিশ গ্রেফতার করতে পারেনি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার তিতুদহ ইউনিয়নের খাসপাড়ার বজলু ফকিরের ছেলে দরিদ্র আব্দুর রহিম ১৪/১৫ বছর আগে ২ কাঠা জমি বিক্রি করেন একই গ্রামের তাহের আলীর ছেলে সামাদ আলী ও মাহমুদ আলীর কাছে।
সম্প্রতি, সামাদ ও মাহমুদ মাঠের জমির পরিবর্তে আবদুর রহিমের কাছে বাড়ির ভিটেবাড়ির জমি দাবি করে। তাতে আবদুর রহিম রাজি হননি।
এরই এক পর্যায়ে সামাদ ও মাহমুদ আলী গ্রামের কথিত মোড়ল-মাতবরদের সঙ্গে যোগসাজশ করে গ্রাম্য সালিশের আয়োজন করে।
২০ নভেম্বর, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় গ্রামের খাসপাড়া বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে সালিশ বৈঠক বসে। ওই বৈঠকে আবদুর রহিমকে দোষী সাব্যস্ত করে গ্রামের মাতবর আবদুল হকের ছেলে গিয়াসউদ্দিন, জালাল ব্যাপারীর ছেলে চাঁদ মিয়া, আকমান আলীর ছেলে হাকিম মণ্ডলসহ সালিশে উপস্থিত আরও কয়েকজন।
সাবেক ইউপি সদস্য আব্দুল গফুরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সালিশে সিদ্ধান্ত দেয় ৫ সদস্য বিশিষ্ট জুরিবোর্ড।
এ জুরিবোর্ডে মাতবরদের মধ্যে ছিলেন আব্দুস সাত্তার, জামাল উদ্দিন শিকদার, হাবিবুর রহমান মোল্লা ও হাবিবউল্লাহ মাস্টার।
জুড়িবোর্ড রহিম ও তার স্ত্রী শেফালী বেগমকে ৩ হাজার টাকা জরিমানা, জুতাপেটা ও একঘরে করে রাখার ঘোষণা দেয়।
এসময় মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে চাঁদ আলী ও হযরত আলীসহ বেশ কয়েকজন সিদ্ধান্ত তখনই বাস্তবায়নের জন্য হৈচৈ শুরু করে।
মাতবরদের রায় হিসেবে তাৎক্ষণিক দিনমজুর আবদুর রহিমের পিঠে ২০ ঘা জুতা মারা হয়। তার স্ত্রী শেফালীকে ১০ ঘা জুতা মারারও ঘোষণা দেয় সালিশকারীরা।
স্ত্রীর সম্ভ্রম বাঁচাতে আবদুর রহিম করজোরে স্ত্রীর পরিবর্তে তাকে জুতা মারতে অনুরোধ করলে গ্রামের মাতবররা তা মেনে নিয়ে আবদুর রহিমের পিঠে আরও ১০ বার জুতা দিয়ে আঘাত করে।
জুতাপেতা করা ছাড়াও আবদুর রহিমকে একঘরে করে রাখার ঘোষণা দেওয়া হয় ওই সালিশ থেকে। তাকে মসজিদে যেতেও নিষেধ করা হয়।
একইসঙ্গে আবদুর রহিমের বাড়ির সঙ্গে থাকা ছোট্ট একটি পান-বিড়ির দোকান বন্ধ করে রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়।
গ্রামের কেউ আবদুর রহিমের সঙ্গে কথা বললে বা কোনো ধরনের যোগাযোগ করলে তাকেও জুতাপেটা করা হবে বলে ঘোষণা দেয় সালিশে অংশগ্রহণকারীরা।
এর পর জুতাপেটার অপমান ও ক্ষোভে বুধবারের ভোরের সূর্য ওঠার আগেই গ্রাম ছাড়েন রহিম ও তার পরিবারের সদস্যরা।
এদিকে, রহিমের বাড়িতে তার বৃদ্ধা মা জুলেখা বেগম একা ঘরে বসে অঝোরে কেঁদে চলেছেন। বর্তমানে বাড়িতে আবদুর রহিমের বৃদ্ধা মা জুলেখা বেগম ও নাবালক ছেলে রিপন রয়েছে।
রিপনের উপস্থিতিতেই তার বাবাকে জুতাপেটা করা হয়। রিপন সড়াবাড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র।
তাকেও গ্রামের কারও সঙ্গে খেলতে মানা করা হয়েছে। এমনকী সরকারি রাস্তা ছাড়া অন্যের জায়গায় পা রাখার ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
অপরদিকে, মাঠে পাকাধান ঝরে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। আবদুর রহিমের সে ধানও কোনো মজুর যেতে পারবেনা বলে শাসিয়েছে মাতবররা।
ঘটনা জানতে পেরে রহিমের বৃদ্ধা মা জুলেখা বেগমের সঙ্গে দেখা করলে তিনি হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন। কাঁদতে কাঁদতে তিন বাংলানিউজকে বলেন, “খুব ভোরে গ্রামের মানুষ ঘুম থেকে জেগে ওঠার আগেই আমার ছেলে রহিম তার বউ শেফালীকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। তারা কোথায় গেছে জানি না। বাড়ির ভিটে কেড়ে নিতে আমার ছেলেকে জুতাপেটা করে গ্রাম ছাড়া করা হয়েছে।”
এবিষয়ে জানতে তিতুদহ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আখতার হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বাংলানিউজকে জানান, ২৩ নভেম্বর, শুক্রবার দুপুরে আবদুর রহিমের মা জুলেখা বেগমের কাছ থেকে তিনি ঘটনাটি জানতে পেরেছেন। জুলেখা বেগম তার কাছে এসে সব ঘটনা খুলে বলেছেন। এর আগে তিনি কিছুই জানতেন না।
এব্যাপারে তিনি বলেন, “গ্রামের কয়েকজন মিলে বিচারের নামে আবদুর রহিমকে জুতাপেটা করেছে। এ অধিকার তাদের নেই। আবদুর রহিমের বিরুদ্ধে কারও অভিযোগ থাকলে ইউনিয়ন পরিষদে লিখিত অভিযোগ দিতে পারতো। প্রয়োজনে থানা কিংবা আদালতে মামলা করতে পারতো। কিন্তু এভাবে মধ্যযুগীয় কায়দায় আবদুর রহিমকে জুতাপেটা করা অন্যায়।”
তিতুদহ পুলিশ ফাঁড়ির ইন-চার্জ উপপরিদর্শক (এসআই) গাজী আবদুর রহমান বলেন, “জুতাপেটার ঘটনা শোনার পর আমি গ্রামে গিয়েছিলাম। গ্রামের কেউ মুখ খুলতে চায়নি। আমি আবদুর রহিমের মাকে বলে এসেছি- আমার কাছে অভিযোগ করলে আমি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো। আর যারা সালিশ করেছিলেন, তাদের গ্রামে পাওয়া যায়নি।”
এদিকে, চুয়াডাঙ্গার তিতুদহ গ্রামের খাসপাড়ায় সালিশের নামে জুতাপেটার ঘটনায় ৯ জনকে আসামি করে থানায় মামলা হয়েছে।
গ্রাম্য মাতবরদের জুতাপেটার শিকার আবদুর রহিমের মা জুলেখা বেগম বাদী হয়ে ২৫ নভেম্বর, রোববার রাতে চুয়াডাঙ্গা সদর থানায় মামলা দায়ের করেন।
মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছেন, তারা হলেন- গ্রাম্য মাতবর গিয়াস উদ্দীন, চাঁদ মিয়া মাস্টার, আবদুল গফুর মণ্ডল, সামাদ আলী, মোহাম্মদ আলী, মিজানুর রহমান, আলী আহাম্মদ, আবদুল জব্বার, সাত্তার পিপিসহ অজ্ঞাতপরিচয় আরও ৮ থেকে ১০ জন।
চুয়াডাঙ্গা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এরশাদুল কবির চৌধুরী নিজেই এ মামলার তদন্তভার গ্রহণ করেছেন। তবে আসামিদের কাউকেই গ্রেফতার করতে পারেননি।
নিউজরুম