রুপসীবাংলা, চট্টগ্রাম (২৬ নভেম্বর) : স্বামী হারিয়ে শোকে পাথর জাহানারা বেগমের কোলে চুপচাপ বসে আছে মীম (৪)। ডাগর ডাগর চোখে সে খুঁজে ফিরছে বাবাকে। পাশে দাঁড়িয়ে বিলাপ করছে মীমের ভাই আরিফুল ইসলাম ফারুক, বোন ফারজানা, সুলতানা ও চুমকি।
শনিবার সন্ধ্যায় ঘটে যাওয়া বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার ট্র্যাজেডিতে না ফেরার দেশে চলে গেছেন এ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি মোহাম্মদ ইলিয়াছ প্রকাশ লেদু (৫৫)।
বাকরুদ্ধ কণ্ঠে জাহানারা জানান ‘অভিশপ্ত সেই সন্ধ্যা’র কথা।
‘‘আশুরা উপলক্ষে সারা দিন আমরা নফল রোজা রেখেছিলাম। ইফতারও করেছি সবাই মিলে। এরপর কিছুক্ষণ সংসারের টুকিটাকি, বড় মেয়ের স্বশুর বাড়িতে মহরমের ভাত-তরকারি দেওয়ার ব্যাপারে আলোচনাও করেছিলাম। একসময় এশার আজান শোনা যায়।উনি গেলেন বাজার করার জন্য। বলেছিলেন, তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন। যাওয়ার সময় মীমকে আদরও করে দিয়েছিলেন।’’
কান্নায় ভেঙে পড়লেন জাহানারা। প্রতিবেশী বোন এসে জড়িয়ে ধরলেন তাকে। কিছুক্ষণ কেঁদে চোখ মুছলেন। বললেন তার পরের ঘটনা।
‘‘উনি ঘর থেকে বেরোনোর ১০ মিনিট পরই শুনলাম বিকট শব্দ। কেঁপে উঠল মাটি।মনে করেছিলাম বুছাল (ভূমিকম্প) যাচ্ছে। কোনো দালান হয়তো ভেঙে পড়েছে। ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। জানতে পারলাম ফেলাইওভার (ফ্লাইওভার) ধসে পড়েছে। চারদিকে শোরগোল, হইচই। ছেলেকে পাঠালাম উনাকে খোঁজার জন্য। রাত সাড়ে ১০টায় ছেলে ফিরল বাবাকে ছাড়াই। এরপর সবাই মিলে বেরোলাম, হাঙ্গামা পেরিয়ে হাসপাতাল, অলিগলি তন্নতন্ন করে খুঁজলাম। কোথাও চিহ্ন পর্যন্ত পেলাম না। এভাবে চলে গেল পুরো রাত।’’
মীমকে দেখিয়ে বলেন,‘‘অবুঝ মেয়েটি বাবার পথ চেয়ে বসে আছে। বাবা বাজার থেকে ফেরার পথে আনবেন চকলেট-চিপস। কীভাবে বোঝাই ওর বাবা আর কোনো দিন ওকে কোলে নেবে না, আদর করবে না।’’
এবার কথা বলেন ইলিয়াছের একমাত্র ছেলে ফারুক, ‘‘হাজারো মানুষ, আগুনের লেলিহান শিখা। চিৎকার চেঁচামেচি। চারদিকে বীভৎস দৃশ্য। কিন্তু আমার সেদিকে খেয়াল ছিল না। শত বাধা পেরিয়ে খুঁজছিলাম বাবাকে। কিন্তু না পাইনি।মেডিক্যালে খুঁজলাম, পাইনি। অবশেষে রোববার সকাল আটটার দিকে পেলাম বাবার লাশ। মুখের একপাশ থেঁতলে গেছে। ঝুরঝুরে হয়ে চামড়া উঠে গেছে।’’
ছেলের কথার পর কিছুটা স্বাভাবিক হলেন জাহানারা। বললেন, ‘‘আমাদের মতো গরিব-দুঃখী মানুষগুলো মারা গেল কাদের দোষে। যারা দোষী তাদের বিচার চাই।সরকার যদি বিচার না করে আল্লাহ যেন বিচার করে। আমার ৩ মেয়ের বিয়ে দেবে কে, কীভাবে চলবে সংসার। কে দেখবে আমাদের।’’
‘‘ফ্লাইওভার কেন দিচ্ছে, কী লাভ হবে আমরা তা বুঝি না। আমরা শুধু জানি এ ফ্লাইওভারের জন্যই আমাদের বাবাকে হারিয়েছি। আমরা ফ্লাইওভার চাই না, বাবাকে ফেরত চাই। আমার বাবা সুস্থ মানুষ ছিলেন। কঠোর পরিশ্রম করে সংসার চালাতেন।’’ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন ইলিয়াছের ৩ মেয়ে।
সাংবাদিক এসেছেন শুনে ইতিমধ্যে পাড়াপড়শীর ভিড় জমে উঠেছে চান্দগাঁও ইয়াছিন হাজির বাড়ির কার্পেন্টার ইলিয়াছের কুঁড়েঘরে। টিনের বেড়ার ছোট্ট ঘরটিতে ফের জেগে উঠছে কান্নার রোল, আহাজারি।
নিউজরুম