রুপসীবাংলা, রংপুর(২৪ নভেম্বর) : রংপুর সিটি কর্পোরেশনের(রসিক)মেয়র পদে মনোনয়ননিয়ে ইমেজ সঙ্কটে পড়েছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। আসন্ন নির্বাচনে তারমনোনীত ও সমর্থিত জাপা প্রার্থী মশিউর রহমান রাঙ্গার ভরাডুবির আশঙ্কা করছেনদলের সমর্থক ও ভোটাররা।
অতীতে এরশাদ যার জন্যই বলেছেন তাকেই ভোটদিয়েছেন রংপুরের জনগণ। কিন্তু এবার তেমনটি হবে না বলেই মত তৃণমূলেরভোটারদের। শুক্রবার দিনভর রসিকের উত্তম, হজিরহাট, বুডিরহাট, বাহাদুরসিং, তপোধন, শেখপাড়া এলাকায় সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে এই মনোভাবই জানাগেছে।
নির্বাচন ২০ ডিসেম্বর। এখনও ২৫দিন বাকি। সময় রয়েছে প্রার্থিতাপ্রত্যাহারের, তাছাড়া এখনও প্রতীক বরাদ্দ হয়নি। কিন্তু কাকে ভোট দেবেন, এমন সিদ্ধান্ত এরই মধ্যে নিয়ে ফেলেছেন অনেক ভোটারই। রংপুর শহর ঘুরে সাধারণভোটারদের সঙ্গে কথা বলে সেটাই মনে হলো।
কেউ কেউ তো রাখ ঢাক না করেই নিজের মতামত প্রকাশ করলেন। প্রকাশ্যেই বলছেন কাকে ভোট দিতে চান তারা।
রিক্সাচালকএকজন ভোটার জানালেন, শরফউদ্দিন ঝন্টু ও জাতীয় পার্টির বিদ্রোহী প্রার্থীসাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার মধ্যেই মূলপ্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। এই দুই জনের মধ্যে একজনের প্রতি তার সমর্থনও সরাসরিব্যক্ত করে দিলেন এই ভোটার।
এদিকে, প্রার্থী মনোনয়নের ব্যাপারেজাতীয় পার্টির সমর্থক সাধারণ ভোটাররা এরশাদের উপর চরমভাবে ক্ষোভ প্রকাশকরেছেন। তাদের ভাষায়, “মামা যারেই কইছে তারেই ভোট দিছি। কিন্তু এবার আরনয়।” কেউ কেউ এক ধাপ আগ বাড়িয়ে বলেছেন, “এরশাদ সারাকাল হামার মাথা বেচিখাবে, এটা এবার হবান্নয়।”
এরশাদের উপর ক্ষিপ্ত হওয়া ও তারপ্রার্থীকে ভোট দিতে না চাওয়ার কারণ সম্পর্কে উত্তম বটতলা এলাকার ব্যবসায়ীরেজওয়ানুল হক লাল জানান, “মামুর(এরশাদ)কথায় ওয়েক(রাঙ্গা)একবার এমপি ভোটদিছন। ভোট নিয়ে চলি গেইল। তারপর ওয়ের ছাঁয়াও দেকপ্যার পাইনেই।”
উত্তমএলাকার আনসার আলী বলেন, “২০০১ সালের নির্বাচনে রংপুর-১(গঙ্গাচড়া) আসন থেকেরাঙ্গাকে মনোনয়ন দেন এরশাদ। তখন বহিরাগত রাঙ্গাকে মানুষ এরশাদের এক কথায়বিপুল ভোটে বিজয়ী করেন। কিন্তু এরপর আর রাঙ্গা এলাকায় যাননি। রাঙ্গার সঙ্গেযোগাযোগ করতে চাইলে আগে তার পিএস’র (ব্যক্তিগত সহকারী) অনুমতি নিতে হতো। এনিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম ক্ষোভ রয়েছে।”
এদিকে, স্থানীয়দেরসেই ক্ষোভের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ওই আসনে জাতীয় পার্টির বর্তমান সংসদ সদস্যআসিফ শাহরিয়ারের কর্মকাণ্ড । ২০০৮ সাল জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়এরশাদের ভাতিজা আসিফ শাহরিয়ারকে। তিনিও ভোট নেওয়ার পর স্থানীয়দের সঙ্গেকোনো প্রকার যোগাযোগ রাখছেন না।
জরুরি প্রয়োজনে একাধিক দিন ধর্ণাদিয়েও তার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না বলে জানান এলাকাবাসী। এছাড়া এলাকার উন্নয়নকরতেও তিনি ব্যর্থ হয়েছেন বলে মনে করেন তারা।
রসিকে অন্তর্ভুক্তগঙ্গাচড়া উপজেলার গ্রামগুলোতে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন (আওয়ামী লীগেরবিদ্রোহী প্রার্থী) সাবেক এমপি শরফউদ্দিন আহমেদ ঝন্টু।
রতন নামের একএলাকাবাসী বলেন, “ঝন্টু ১৯৯৬ সালে রংপুর-১ আসন থেকে জাপারটিকিটে এমপি নির্বাচিত হন। তিনি ব্যাপক উন্নয়ন করতে সক্ষম হয়েছেন। বিশেষকরে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করতে সক্ষম হন তিনি। এর পরের দুইএমপি(রাঙ্গা-শাহরিয়ার) নতুন রাস্তা পাকা করা থাকাতো দূরের কথা।পুরনোগুলোরই সংস্কার করতে ব্যর্থ হয়েছেন।”
এসব কারণে এবার এলাকায়এরশাদ আসলেই ভোটারদের মনোভাবে তেমন কোনো পরিবর্তন হবে বলে মনে করছেন নাস্থানীয় জাপা নেতারা। তারা মনে করছেন রাঙ্গাকে না দিয়ে ক্লিন ইমেজেরমোস্তফাকে সমর্থন দিলে কিছু সুবিধা পেতো জাতীয় পার্টি।
গ্রাম পর্যায়ের জাপাকর্মীরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এরশাদ নিজে এলেও পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হবে না।
তাদের মতে, এরশাদ রাঙ্গাকে সমর্থন দিয়ে বিশাল ভুল করেছেন। আরেকটি বড় ভুল করবেন রাঙ্গার পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিলে।
একজাপাকর্মীর মতে, “অজনপ্রিয় রাঙ্গার পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিলেএরশাদের নিজেরও ক্ষতি হবে। এর প্রভাব পড়বে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে।তছনছ হয়ে যেতে পারে জাপার দুর্গ রংপুর।
গ্রামের সাধারণ ভোটাররা জানিয়েছে রাঙ্গার পক্ষে প্রচারণায় নামলে নেতিবাচক পরিস্থিতির মুখে পড়তে হতে পারে এরশাদকে।
জাপাকর্মী শেখপাড়া গ্রামের বাসিন্দা সাবেক ইউপি সদস্য আফসার আলী বলেন, “এরশাদ এলে জনগণের অপমানজনক প্রশ্নের মুখে পড়তে পারেন। আমরা চাই নাওনি(এরশাদ)মানী লোক এখানে এসে অপমান হউন।”
জাপার এক প্রেসিডিয়ামসদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এরশাদ সমর্থিত প্রার্থীর ভরাডুবিরশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এতে আগামী নির্বাচনে রংপুরসহ সারা দেশে নেতিবাচকপ্রভাবের আশংকায় চিন্তিত হয়ে পড়েছেন স্বয়ং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদসহ জাপারসিনিয়র নেতারা।
তার মতে “রসিক নির্বাচন জাপার গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। না পারছেন গিলতে না পারছেন ফেলতে।”
তারা মনে করছেন, চোরবালিতে আটকে গেছে জাপার ভবিষ্যৎ। এখন পথ খুঁজছেন বের হয়ে আসার।
এদিকেজাপার একটি বিশাল অংশ শুক্রবার পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেননি।তারা মনে করছেন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হতে পারে। তাছাড়া এখন পর্যন্ত এরশাদতাদের প্রচারণায় অংশ নেওয়ার নির্দেশ দেননি। এতে করে জাপা প্রার্থীপ্রচারণায় দিক থেকেও রয়েছেন অনেক পিছিয়ে।
জাপা সমর্থিত প্রার্থীমশিউর রহমান রাঙ্গা প্রচারণায় কিছুটা পিছিয়ে থাকার কথা স্বীকার করেছেন।তিনি বাংলানিউজকে বলেন, “অন্য প্রার্থীরা বেপরোয়া ছিলেন এরশাদ সমর্থন দিনআর নাই দিন তারা নির্বাচন করবেন। তাই তারা আগে থেকেই প্রচারণায় রয়েছেন।”
“কিন্তুআমার ভাবনা ছিল, এরশাদ সমর্থন দিলে ভোট করব না হলে নয়। তাই আমি আগে থেকেসেভাবে প্রচারণা চালাইনি। এ জন্য এখন পর্যন্ত অনেক এলাকায় যেতে পারিনি।”
রসিকনির্বাচন নিয়ে আওয়ামী, বিএনপি এমনকি জামায়াতও নানা সমীকরণ কষছে। জাপার একপ্রার্থীকে বিএনপি-জামাত জোট গোপন সমর্থন দিতে পারে বলেও বাতাসে গুঞ্জনচলছে। আর তেমনটি হলে ভোটের হিসেব নিকেশ বদলে যেতে পারে।
কারণ বিগতনির্বাচনগুলোর পরিসংখ্যানে দেখা গেছে এখানে জামায়াতের ১৩ থেকে ১৫ শতাংশ আরবিএনপির ৭ থেকে ৮ শতাংশ সমর্থন রয়েছে। অন্যদিকে জাতীয় পার্টির ৪০ থেকে ৪৫শতাংশ আর আওয়ামী লীগের রয়েছে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ সমর্থন।সে হিসেবে জাপার ভোট ভাগ হলে আর বিএনপি জামায়াতের ভোট এক বাক্সে গেলে বদলে যেতে পারে দৃশ্যপট।
নিউজরুম