উৎপল দত্ত (১৯২৯-১৯৯৩) জন্মেছিলেন এক সংক্ষুব্ধ সময়ের বুকে। সমগ্র বিশ্বএবং বিশেষ করে পাক-ভারতীয় উপমহাদেশে তখন কালকের সকালটি কেমন হবে একথা বলাছিল দুষ্কর। বিশ শতকের প্রথম দশক থেকে বৈশ্বিক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনেরসঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতে থাকলো অর্থনৈতিক অবস্থা, সামাজিক মূল্যবোধেরপ্যাটার্ন, মানুষের আর্ন্তজাগতিক ভূগোল এবং তৎসম্পর্কিত বাহ্যিক আচার-আচরণ, যা চল্লিশের দশকে গিয়ে আরও পরিণত হলো। উৎপল দত্তের বেড়ে ওঠা এই কালখণ্ডে।এই সময়ের কল্যাণে যিনি বিশ্বের পাশে পেয়েছিলেন জীবনের অসংখ্যশাখা-প্রশাখাময় বৈচিত্র্যের সন্ধান। সেই কালোত্থিত জীবনের বৈচিত্র্যসংযাতরাজনৈতিক রসায়ন উৎপল দত্তের নাটকের প্রধান মনোযোগ।
রাজনৈতিকনাট্যশালা এক অনন্য রণক্ষেত্র। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ রাজনৈতিক সংগ্রামের এইরণাঙ্গনে নানা ভূমিকায় নানা রূপে উৎপল দত্তের প্রবেশ ও সংগ্রাম। অভিনেতা, প্রযোজক, পরিচালক, নাট্যকার, নাট্যান্দোলন কর্মী- যখন যে রূপে প্রয়োজন তখনসে রূপে আবির্ভূত উৎপল দত্ত। অন্যদের থেকে তিনি স্বতন্ত্র কারণ এই সবগুলোক্ষেত্রে তাঁর সফলতা ছিল তুঙ্গে। তবে নাট্যকার হিশেবে সকল প্রতিভাকেঅতিক্রম করেছেন তিনি। এই শিল্পী-যোদ্ধার অক্ষয় তূণীরের শ্রেষ্ঠ আয়ূধ তাঁরনাটক। রাজনীতি যেমন মানুষকে মানুষের খুব কাছে নিয়ে যায়, চিনতে শেখায়, অধিকার সচেতন করে, সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথের দিশা দেখায়, ভুল-শুদ্ধ-প্রয়োজন-অপ্রোয়জনীয়তাকে বোঝার মঞ্চ তৈরি করে দেয়, তেমনি নাটকমানুষের সঙ্গে সরাসরি রাজনৈতিক, আত্মিক, সামাজিক, সাংস্কতিক, ঐতিহ্যিকসংগ্রামের যোগাযোগ স্থাপন করে।
নাটক এবং রাজনীতি মানুষের অধিকারপ্রতিষ্ঠা এবং অধিকার আদায়ের ভিন্ন দুটি মাধ্যম। দুটিরই আছে অনেকগুলি শাখা।নাটক কখনো কখনো প্রচার করতে চায় রাজনৈতিক আদর্শ। তবে কি রাজনীতি আর নাটকএক অন্যের পরিপূরক? সেটা জানার জন্য প্রয়োজন রাজনীতি কী তা একবার স্বল্পপরিসরে জানা। চেম্বারস অভিধানে রাজনীতি বলতে সরকার, রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিকক্রিয়াকলাপ অথবা মতামত পরিচালনার কলাকৌশলকে রাজনীতি বলা হয়েছে। ভিন্ন কিছুঅভিধানে রাজনীতি বলতে বোঝানো হয়েছে সরকার বা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পদ্ধতি বাআন্দোলনকে। রাজনীতি প্রায় সময় দেশে সামাজিক বিপ্লব সংঘটিত করতে চায়, রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের চেষ্টা চালায়, নিজ দল বা মতাদর্শের পক্ষে জনমত সৃষ্টিরচেষ্টা করে। বলা যায়-
‘রাজনীতি হলো একটা লড়াই, প্রতিকূল একটাশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাকে পরাভূত করাই হলো লক্ষ্য। রাজনীতি হলোক্রমান্বয়িক গতিশীলতা, প্রতিকূলতাকে পরাজিত করেও তাকে এগিয়ে যেতে হয়।রাজনীতি হলো একটি বিজ্ঞান, যার একটা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া আছে, পদ্ধতি আছে।’
মার্কসবাদীদৃষ্টির আলোকে রাজনীতি বলতে মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক, শ্রেণীগতব্যক্তিগত সব কর্মকাণ্ডকে বোঝায়। রাজনীতির প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য হলোকর্তৃত্ব বা ক্ষমতা। রাজনৈতিক দল হলো সেই লক্ষ্যের বা অভিযানের সামগ্রিকবাহিনী। সেই লক্ষ্য অর্জনে সবথেকে বেশি প্রয়োজন হলো নিজ মতাদর্শের প্রতিমানুষের দৃষ্টিকে আকৃষ্ট করা। রাজনীতির এই ব্যাপকতার আলোকে কোন নাটককে তখনইরাজনৈতিক নাটক বলা যায় যখন সেটি সরকার, রাষ্ট্র এবং রাজনীতি নিয়ে কথা বলে।কোন একটি ভাবনা বা মতাদর্শকে একটি বিশেষ রাজনৈতিক অবস্থান থেকে হয় সমর্থননয় আক্রমণ করে। কথনো প্রকাশ্যে, কখনো পরোক্ষভাবে, কখনো রূপকের সাহায্যেরাজনৈতিক নাটক তার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চায়। সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থারভুল-ত্রুটি নির্ণয় করে দর্শককে পরিবর্তন করতে চায়। সব মিলিয়ে বলা যায়, যদিকোন নাটক নির্দিষ্ট এক জনমণ্ডলীর কাছে কোন রাজনৈতিক, সামাজিক বা অর্থনৈতিককোন নির্দেশ বা ধারণা বহন করে নিয়ে যায়, রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে প্রশ্নতোলে সেই নাটককে বলা যায় রাজনৈতিক নাটক।
অপরিহার্যভাবে প্রাসঙ্গিকবিবেচনায় আলোচনার শুরুতে আমরা স্মরণ করবো শিল্প-সাহিত্য সমালোচনা প্রসঙ্গেমার্কসবাদের অন্যতম পুরোধা তাত্ত্বিক ও প্রবক্তা, মহান বিপ্লবী মাও সেতুং-এর ইয়েনান ভাষণের সেই অভ্রান্ত সিদ্ধান্ত :
‘শিল্প ও সাহিত্যসমালোচনার দুটি মানদণ্ড আছে : একটি রাজনৈতিক অপরটি শৈল্পিক। …শ্রেণীবিভক্ত সমাজে প্রত্যেক শ্রেণীর নিজস্ব রাজনৈতিক ও শৈল্পিক মানদণ্ডআছে। কিন্তু সমস্ত শ্রেণীবিভক্ত সমাজে সমস্ত শ্রেণীই সর্বদা শৈল্পিকমানদণ্ডের চেয়ে রাজনৈতিক মানদণ্ডকে স্থান দিয়ে থাকে।’ তাঁর মহামূল্যবানসুস্পষ্ট নির্দেশ : ‘আমরা দাবি করব রাজনীতি ও শিল্পকলার ঐক্য, বিষয়বস্তু ওআঙ্গিকের ঐক্য, বিপ্লবী রাজনৈতিক বিষয়বস্তু এবং যত উচ্চমানের সম্ভব উৎকৃষ্টশিল্পগুণান্বিত আঙ্গিকের ঐক্য।’
উৎপল দত্তের নাটক বিশ্লেষণকালে আমরা এই মহান নেতার শিল্প ও রাজনৈতিক আদর্শের প্রভাব এবং নাট্যকারের সফলতা-বিফলতা পর্যলোচনা করবো।
বাংলারাজনৈতিক নাটকের ইতিহাস শুরু বলা যায় দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকেরমাধ্যমে। উনিশ শতকের মধ্যভাগে বাংলা নাটকের মূল চালিকাশক্তি ছিল সমাজসংস্কারের মানসিকতা। রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’রা সেকালে সমাজেযে প্রবল প্রগতিশীল আন্দোলন উপস্থিত করেছিলেন, সেকালের নাটক মূলত তারইপ্রতিফলন। খুব সূক্ষ্ণ বিচারে অবশ্য দেখা যাবে আমরা ‘সমাজ সংস্কার-চেতনারনাটক’ বলেছি, তাও প্রকৃতপক্ষে রাজনীতি-বিবর্জিত কিছু নয়। তাঁদের নাটকে Negation-র লক্ষ্য ছিল আপন সমাজের মধ্যযুগীয় কুসংস্কার, ব্রিটিশসাম্রাজ্যবাদ নয় এখানেই দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ স্বতন্ত্র। ‘নীলদর্পণ’-এ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শোষণের নির্মম চিত্র উদঘাটনই ছিল মূললক্ষ্য। এরপর জাতীয়তাবাদের উন্মেষ পর্বে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, কিরণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, হরলাল রায়, উপেন্দ্রনাথ দাস, উমেশচন্দ্র গুপ্ত, প্রমুখ মূলত ইতিহাসের প্রচ্ছদে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাজনৈতিক নাটক রচনাকরেছিলেন। পরবর্তীকালে এই ধারা গিরীশচন্দ্র-দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রমুখেরমধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছে। আর বিশ শতকেরমাঝামাঝি পর্বে বাংলা নাটককে প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক নাটকের ধারা হিশেবে এগিয়েনিয়ে গেছেন উৎপল দত্ত।
এই ধারায় উৎপল দত্তের অনন্যতা, সফলতা, বিশিষ্টতা বা স্বতন্ত্রতা কোথায়? পূর্বসূরিরা যে রাজনৈতিক নাটকের ধারাসৃষ্টি করেছিলেন সেখানে সরাসরি রাজনীতিকে উপস্থাপন করা কঠিন ছিল ব্রিটিশদেরপদাবনত থাকার কারণে। তাঁরা ইতিহাসের উপর রাজনীতি আরোপ করে নাটক লেখারচেষ্টা করেছেন। কিন্তু উৎপল দত্ত অন্য নাটকের পাশাপাশি রাজনৈতিক নাটকেশাসক, শোষকশ্রেণীর বিরুদ্ধে কথা বলেছেন সরাসরি। শুধু তাই নয়, নাটক নিয়েতিনি চারদেয়ালে ঘেরা থিয়েটারে আবদ্ধ থাকেননি, পৌঁছেছেন গণমানুষের কাছে; নাটকে সম্পৃক্ত করেছেন হাজার হাজার সাধারণ মানুষকে।
উৎপল দত্তেররাজনৈতিক নাটকগুলোর মধ্যে আবার পাওয়া যায় শ্রেণীচেতনা, ইতিহাস চেতনা ওমধ্যবিত্ত চেতনা। ‘টিনের তলোয়ার’, ‘রাতের অতিথি’, ‘ছায়ানট’, ‘সূর্যশিকার’, ‘মানুষের অধিকার’ প্রভৃতি নাটকে যেমন পাওয়া যায় শ্রেণীচেতনা সচেতনতা, তেমনি ‘টোটা, ‘লাল দুর্গ’, ‘তিতুমীর’, ‘কল্লোল’,‘দিল্লী চলো’, ‘ক্রুশবিদ্ধ কুবা’ প্রভৃতি নাটকের ইতিহাস চেতনা, ‘অঙ্গার’, ‘ফেরারী ফৌজ’ প্রভৃতি নাটকেরমধ্যবিত্ত চেতনা তাঁর নাটককে দেয় ভিন্নমাত্রা।
উৎপল দত্তের নাটকেভারতবর্ষের সমাজ, রাজনীতির পাশাপাশি উঠে এসেছে বিশ্বরাজনীতি, অত্যাচারেরবিরুদ্ধে সংগ্রাম, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া, সাম্রাজ্যবাদেরবিরুদ্ধে সংগ্রাম ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রয়াস, মানবতার জয়তুজীবনজিজ্ঞাসা প্রভৃতি বিষয়। ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ আজীবন সংগ্রামী। এখানেযেমন অন্যায়, অত্যাচার, দখল, শাসন-শোষণ নিত্য চলেছে, তেমন নিপীড়িত, শোষিত, সর্বহারা মানুষ তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে বারবার; আদায় করেছে তাদেরকাঙ্ক্ষিত অধিকার। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক গণ-বিপ্লবের কাহিনী তাঁর নাটকেরঅন্যতম বিষয়বস্তু। গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়কালে হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, ১৮৫৭ সালের ভারতীয় মহাবিদ্রোহ, নীলবিদ্রোহ, সন্ন্যাসীবিদ্রোহ, ওয়াহাবি আন্দোলন, জালিয়ানওয়ালাবাগেররক্তাক্ত অধ্যায়, আজাদ হিন্দ ফৌজের দুঃসাহসিক অধ্যায়, ভারতের নৌবিদ্রোহ, দেশবিভাগের মর্মদন্তু ঘটনা ইত্যাদি। শুধু তাই নয়, বিশ্বের সংগ্রামী মানুষেরমরণপণ সংগ্রামী ঘটনাগুলিও তাঁর নাটকে ধরা পড়েছে গভীর ইতিহাসবীক্ষার আলোকে।পৃথিবীর প্রথম শ্রমিকশ্রেণীর রাষ্ট্রগঠনের যে ঘটনা আজও সর্বহারা শ্রেণীরচোখের মণি সেই প্যারি কমিউন, অক্টোবর বিপ্লবের পূর্ব ও উত্তরকাল, ফ্যাসিবিরোধী সংগ্রাম, চীনের বিপ্লব, ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধ, কিউবা, ইন্দোনেশিয়া, একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রেরবিপর্যয় ও প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের কলঙ্কজনক ভূমিকা- সবই তিনি লিপিবদ্ধকরে গেছেন তাঁর নাটকের বিষয়বস্তুতে।
নিজেকে তিনি বলতেন ‘প্রোপাগান্ডিস্ট’। প্রচলিত সমাজব্যবস্থার ভিত কাঁপিয়ে দেওয়া ছিল তাঁরপ্রোপাগান্ডার বিষয়। প্রোপাগান্ডা করতে গেলে দরকার মানুষকে ক্রুদ্ধ করেতোলা। গণ-আন্দোলনের পথে নামলে প্রকাশ পাবে সেই ক্রোধ ও সংগ্রামেরমুষ্টিবদ্ধ প্রয়াস। উৎপল দত্ত তাঁর সমগ্র নাট্যজীবনে এই ব্রতকেই শিরোধার্যকরেছিলেন।
ইতিহাস আশ্রিত নাটকগুলোর মধ্যে ‘কল্লোল’, ‘ব্যারিকেড’, ‘একলা চলো রে’, ‘জনতার আফিম’, ‘তিতুমীর’, ‘সন্ন্যাসীর তরবারি’, ‘ক্রুশবিদ্ধকুবা’, ‘টোটা’, ‘অজেয় ভিয়েতনাম’ উল্লেখযোগ্য।
ভারতের ঐতিহাসিকনৌ-বিদ্রোহ নিয়ে লেখা ‘কল্লোল’ উৎপল দত্তের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক নাটক।এই নাটকের মধ্য দিয়ে তিনি ইতিহাসের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। ইতিহাসেরদৃষ্টিকোণ থেকে এই বিদ্রোহ নতিস্বীকার করেছিল। কিন্তু না, ‘কল্লোল’ নাটকেকরেনি। উৎপল দত্তের নিজস্ব ভাষ্যে পাওয়া যায় :
‘৪৬-এর নৌ-বিদ্রোহ একবৈপ্লবিক প্রক্রিয়ার সূচনা। এই সেই প্রক্রিয়া যা ব্রিটিশ কংগ্রেস-মুসলিমলিগ চক্রের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত করতে বাধ্য করলো স্বতঃসিদ্ধভাবে।ইতিহাসের প্রক্রিয়াই তাই। এই সেই প্রক্রিয়া এবং ষড়যন্ত্র যাতে সমগ্রভারতবর্ষটাই প্রজ্জ্বলিত হলো বিদ্রোহে। এই সেই প্রক্রিয়া যার অমোঘ নিয়মেভারতী বুর্জোয়া সশস্ত্র সংগ্রামের দুঃস্বপ্নে আজও ভীত। এই প্রক্রিয়াবৈপ্লবিক স্বপ্নের। বিপ্লবের। তাই থিয়েটারের বর্ণমালায় ‘খাইবার’ আত্মসমর্পণকরেনি যেমন আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটেনশিপ পোটেমকিন’-এ করেনি, যদিও ইতিহাস বলেকরেছিল। পোটেমকিনের বিদ্রোহীরা মহান অক্টোবর বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে এসেনিজেদের উপনীত করেছিল। ইতিহাসের মানদণ্ডে পোটেমকিন নাবিকদের আত্মসমর্পণ কোনবিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ার তার পুনঃসূচনা। সেই বৈপ্লবিকপ্রক্রিয়ার এক অন্যতম উপাচার কল্লোল।’
এই নাটকের সব ঘটনাই ঐতিহাসিকএই অর্থে যে, ১৯৪৬ সালের নৌ-বিদ্রোহে যা ঘটেছিল তা থেকেই এর আদ্যোপান্তগঠিত। তার মানে এই নয় যে খাইবার নামক জাহাজে এই ঘটনা ঘটেছিল নাট্যকারএকাধিক জাহাজের অভিজ্ঞতাকে একত্রিত করে একটিমাত্র জাহাজে সন্নিবেশ করেছেন, সংক্ষেপন করেছেন। ‘খাইবার’কে এখানে প্রতীকীভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে সববিদ্রোহী জাহাজের প্রতিনিধি হিসেবে। প্রকৃত ইতিহাস যদি উন্মোচিত হয় তবেআমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে পারি কিভাবে সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল ওমোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ নাবিকদের বিনা শর্তে আত্মসমর্পণের উপদেশ দিয়ে শেষপর্যন্ত নাবিকদের বন্দী করালেন এবং ব্রিটিশ লৌহ শক্তির যবনিকায় প্রেরণ করেসকল প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অন্যতম শরিক হয়ে ইতিহাসের বিড়ম্বনায় রূপান্তরিতহলেন। এ কথা এখন স্পষ্ট যে দুই নেতার সরাসরি বিদ্রোহ-বিরোধীতা মোলায়েমভাষায় আত্মসমর্পণের জাল তৈরি করেছিল। কারণ তারা তখন নিয়মতান্ত্রিক উপায়েস্বাধীনতার দর-দস্তুর করতে অনেক ব্যস্ত ছিলেন। কংগ্রেসের এই দেউলিয়ারাজনীতি নাটকে স্পষ্ট। ‘কল্লোল’ নাটক একটি বিশেষ যুগকে ধরে রেখে সেই যুগেরসেই যুগের বৈশিষ্ট ফুটিয়ে তুলেছে। এ নাটক একটি যুগসৃষ্টির অধিকারী, এইকারণেই যে ঐ বিশেষ যুগের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক চেহারার যথাযথপ্রতিফলন ঘটে এ নাটকের সর্বত্রে।
‘একলা চলরে’ নাটকে দেখি ‘দেশেরবিনা রক্তপাতে’ স্বাধীনতার সঙ্গে প্রকৃত গান্ধীবাদীদের নিগ্রহ। যারা নিগ্রহকরেছেন তারাও কংগ্রেসি, তবে তারা ভূস্বামী, জমিদার। স্বাধীনতার মুনাফাতারাই লুটেছেন বেশি। মুনাফার তাগিদে সাম্প্রদায়িকতার ইন্ধন তারাই জুটিয়েছেননির্লজ্জভাবে। চাষীর অন্ন খেয়ে ভুঁড়ি বাড়িয়ে কৃষক সমাজকে ভাগ করেছেনমুসলমান চাষী এবং হিন্দু চাষী আক্ষ্যা দিয়ে। নাট্যকার দেখিয়েছেন স্পষ্টভাবেশান্তি এবং ক্ষমার প্রতীক সত্যাগ্রহী কংগেসি পিতাও রেহাই পায়নি ব্রিঠিশরাজশক্তির পুলিশবাহিনীর হাত থেকে যখন তারা জানতে পেরেছে তার পুত্রব্রিটিশের মূলোচ্ছেদে সশস্ত্র বিপ্লবীদের সঙ্গে যুক্ত। পুত্র সহিংস বলেঅহিংস পিতাকে ক্ষমা করেনি।
‘রাইফেল’ নাটকের বিষয়বস্তু ত্রিশ থেকেচল্লিশের দশক পর্যন্ত। ১৯৩৪ সালে ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরেবিপ্লবী দলের যে অভ্যুত্থান ঘটেছিল সেটাকে নাট্যকার তুলে ধরেছেন এখানে।আন্দোলন নিয়ে বিপ্লববাদী ও গান্ধীবাদীদের মধ্যে যে মতদ্বৈততা ছিল তাকেনাট্যকার রূপায়িত করেছেন অসাধারণ নাট্যোৎকণ্ঠায়। অবশ্য এই মতদ্বৈততায় উৎপলদত্ত বিপ্লববাদেই বিশ্বাসী। নাটকের শুরুতেই নাট্যকার সূত্রধর চরিত্রেরমাধ্যমে সেই প্রশ্নই তুলে ধরেছেন-
‘‘কান পেতে শুনুন, চারিদিকে ঢক্কানিনাদ, দেশ স্বাধীন হয়েছে বিনা রক্তপাতে, অহিংস সংগ্রামের দৌলতে! দেশ নাকিস্বধীন হয়েছে খদ্দর পরার ফলে, আমরা একমনে চরকা কেটেছি বলে!
অহিংসসংগ্রামের ফলে দেশ স্বাধীন? তবে কি ক্ষুদিরামের নাম মুছে ফেলা হবে ইতিহাসথেকে? বিনা রক্তপাতে দেশ স্বাধীন? তবে কি সূর্যসেনের রক্ত রক্ত নয়? তবে কিসে যুগে ঝাঁসির রানী লক্ষ্ণীবাই আর তিতুমীর, আর এযুগে নৌ-বিদ্রোহী আরসুভাষচন্দ্রের সশস্ত্র আই. এন. এ. বাহিনী আমাদের কেউ নয়?’
এইসংলাপের মদ্য দিয়ে স্পষ্ট হয় নাট্যকারের আদর্শ। পরাধীন ভারতে যারা দোসর ছিলতারাই ’৪৭ পরবর্তী ভারতে ক্ষমতায় বসে। তাই গণমানুষের স্বাধীনতার স্বপ্নথেকেই যায়। উৎপল দত্ত বোধহয় এটাই দেখাতে চান যে, পরাধীন ভারতে ব্রিটিশরাযেমন সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতন চালাত, শাসন-শোষণ করত, ঠিক তেমনিভাবেশোষণ নির্যাতন করে স্বাধীন দেশের কংগ্রেসীরা। কংগ্রেসী স্বাধীনতাকেনাট্যকার স্বাধীনতা বলতে নারাজ। সেটা শুধু ক্ষমতার পালাবদল, কাঠামো বদল নয়।নাটকের শেষে তাই বিপ্লবীরা আবার ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করে। লুকিয়েরাইফেল নিয়ে তারা আবার ঘুরে দাঁড়াতে চায়। নাট্যকার স্পষ্টভাবে বোঝাতেচেয়েছেন অস্ত্র ছাড়া বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে জেতা সম্ভব নয়। তাইরাইফেল হয়ে ওঠে গণমানুষের হাতিয়ার।
‘ফেরারী ফৌজ’ নাটকে নাট্যকার১৯৪৭ পূর্ব ভারতবর্ষের রাজনীতি ও আন্দোলনকে তুলে ধরেছেন। বাংলার আন্দোলনেরইতিহাসে যা অগ্নিযুগ নামে পরিচিত সেই যুগটি যেন ভেসে ওঠে চোখের সামনে।ইতিহাসকে এখানে নতুন মাত্রায় উপস্থাপন
করেছেন। ’৬০ এর দশকে লেখা এই নাটকেরবিষয়বস্তু হিসেবে উঠে এসেছে স্বাধীনতা আন্দোলনে বিপ্লববাদীদের সাহসী ভূমিকাও কার্যকলাপ। তিনি ষাটের দশকে বিপ্লবীদের উত্থান-পতন, সংগ্রাম-বিচ্যুতিকেদেখিয়েছেন। এই বিপ্লবী আসলে কমিউনিস্টরা আর কংগ্রেস হলো রূপান্তরিত ব্রিটিশশক্তি। অশোক এই নাটকের অন্যতম প্রধান চরিত্র। শচী, বঙ্গবাসী, রাধারানীসবাই যেন বিপ্লবী। কেই প্রত্যক্ষ কেই পরোক্ষভাবে। এসব চরিত্রের মধ্য দিয়েনাট্যকার আমাদের ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে নারীদের সাহসিকতাকে তুলেধরেছেন।
কৃষকবিদ্রোহের নেতা তিতুমীরকে চব্বিশ পরগণার তৎকালীনব্রিটিশ রেসিডেন্ট এজেন্ট, ক্রফোর্ড পাইরন, একজন গবেষক হিসেবে হাজির করেছেন ‘তিতুমীর’ নাটকে । তিতুমীরের ঐতিহাসিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে অভিযানপরিচালনার ফাঁকে ফাঁকে তিনি বাংলার প্রাচীন পুঁথি গবেষণায় মত্ত। নাট্যকারএখানে একদিকে ক্রফোর্ড পাইরনের গবেষকের আপাত বিচ্ছিন্নতার সঙ্গে সঙ্গে তারঔপনিবেশিক স্বার্থরক্ষার বিষয়টিকে সুনিপুণ নাট্যকারের মতো আমাদেরতিতুমীরের সাম্প্রদায়িকতা বিরোধীতা, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতার লক্ষ্যে পৌঁছেদেয়। এ নাটকে তিতুমীর নাট্যকারের চোখে একজন অতিকথার নায়ক। ‘অতিকথা’ সমাজবিজ্ঞানীদের মতে মানুষকে এক বিশ্বাস প্রদান করে, যার ফলে সে নৈতিক বাধর্মীয় কাঠামোর মাধ্যমে ঐ বিশ্বাসের দ্বারা বর্তমান জীবনকে ব্যখ্যা করতেচায়। তিতুমীরের চোখে দেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামই ধর্মরক্ষা করারসংগ্রাম :
‘যার যা আছে সব কিছু দিয়ে দিতে হবে, তবেই সে এই সংগ্রামের প্রকৃত যোদ্ধার দায়িত্ব বহন করার উপযুক্ত হবে।’
নাটকউৎপল দত্তের কাছে নিছক অবসর-বিনোদনের আশ্রয় নয়, তা অস্ত্র ; এবং এইনাট্যকারের হাতে তা ‘টিনের তলোয়ার’ও নয়, তা ‘রাইফেল’। ‘তীর’, ‘টোটা’, ‘কৃপাণ’, ‘রাইফেল’, ‘সন্ন্যাসীর তরবারি’, ‘টিনের তলোয়ার’- নানাধরনেরঅস্ত্রের নাম ব্যবহার করে এত বেশি নাটকের নামকরণ আর কোনো নাট্যকারই কিকরেছেন? আর কোন নাট্যকারের নাটকে নানাধরনের যুদ্ধবিদ্যার অনুষঙ্গ- ‘ফৌজ’, ‘ব্যারিকেড’, ‘দুর্গ’- এত বেশি আছে? তাঁর নিজের কথাগুলোই এক্ষেত্রে আমাদেরবেশি সাহায্য করে :