রুপসীবাংলা কুড়িগ্রাম (২২ নভেম্বর) : ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফেরগুলিতে কুড়িগ্রাম সীমান্তে বাংলাদেশি কিশোরী ফেলানী নিহত হওয়ার ঘটনা শুধু ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’ই ছিল না, বিশ্বজুড়েই তা তোলাপাড় তুলেছিল। বিপন্নবিশ্ব মানবতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলন্ত ফেলানীরলাশের ছবি।
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার বানারভিটা সীমান্তে ফেলানীরমৃত্যু কোনো বিশেষ সময় বা পরিপ্রেক্ষিতে আবদ্ধ কোনো ঘটনা নয়। যুগ যুগ ধরেবাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকায় এমন ঘটনা ঘটে আসছে অহরহ।শুধুফেলানীই নয়- তার দাদা হাফেজ উদ্দিনও ২০ বছর আগে সীমান্তে একইভাবে বিএসএফেরগুলিতে নিহত হয়েছিলেন। কুড়িগ্রামে ফেলানীর বাড়িতে গিয়েই পাওয়া গেলো এমনতথ্য।
শুধু ফেলানী বা তার দাদাই নন, ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সীমান্তপাড়ি দিতে গিয়ে বিএসএফের গুলিতে ঝরে গেছে অনেক প্রাণ। পাশাপাশি গুলিবিদ্ধঅনেকেই পরবর্তী জীবনে বেঁচে রয়েছেন পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে। বিএসএফের হাতেআটক ও নির্যাতনের ঘটনাও ঘটছে অহরহ।
মানব পাচারকারীদের খপ্পরে পড়েসীমান্ত এলাকার দরিদ্র ও নিরীহ এসব নারী-পুরুষ প্রায় প্রতিদিনই কাজেরসন্ধানে অবৈধভাবে পাড়ি জমাচ্ছেন ভারতের উদ্দেশ্যে। সীমান্ত ডিঙাতে গিয়েবিএসএফের গুলি এবং নিগ্রহের শিকারও হচ্ছেন প্রায় প্রতিনিয়ত।
ফেলানীরমৃত্যুর আগেও একইভাবে ২০০০ সালে ফুলবাড়ীর খালিশা কোটাল গ্রামের দুই ভাইসগির (২৫) ও একরামুল (৩০), ২০০১ সালে করলা গ্রামের সিরাজুল ইসলাম (২৬), ২০১০ সালে মইনুল (২২) ও মিঠু (২৬) বিএসএফের গুলিতে নিহত হন।
২০০৯সালে গুলিবিদ্ধ হয় আশরাফুল (১৪)। এছাড়া বিএসএফ ধরে নিয়ে গেছে ১০ জনকে। শুধুরৌমারী-রাজিবপুর সীমান্তেই গত ২০ বছরে বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছেন ৫৬ জন।ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ৩০ জনেরও বেশি বাংলাদেশিকে।
স্থানীয়সীমান্তবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়- নাগেশ্বরী উপজেলার নাগরাজ, শাহাটারি, ভাওয়াইলটারি, দেওয়ানিটারি, শিংগেরভিটা, মিস্ত্রীটারি, গোয়ালটারি, কলোনিটারিসহ সীমান্তঘেঁষা গ্রামগুলোর শত শত পরিবার এখন ভারতে অবস্থানকরছে। এরা যখন ফিরে আসবে তখনও ফেলানীর মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তির আশংকা রয়েছে।এ সমস্যা সমাধানে কোনো সরকার কখনই উদ্যোগ নেয়নি বলে জানালেন সীমান্ত এলাকার অধিবাসী গোলাম মোস্তফা, ওবায়দুল হক ও আব্দুল জব্বার।
বিএসএফমাঝে মাঝে অবৈধভাবে ভারতে যাওয়া লোকজনকে ‘পুশ-ইন’ করে বলে জানালেন তারা।তবে শুধু এসব অবৈধ নাগরিকদেরই ‘পুশ-ইন’ করে না, বহু বছর আগে ভারতে গিয়েনাগরিকত্ব নেয়া ভারতীয় স্থায়ী বাসিন্দাদেরও ফেরত পাঠানো হয় তাদের সাথে। ফলেসৃষ্টি হচ্ছে জটিলতা।
সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার সময় প্রায় প্রতিনিয়তইনিগ্রহের শিকার হয় এসব মানুষ। দালালচক্র ভারতের বিএসএফের সঙ্গে রফা করেসীমান্তের জিরো লাইন থেকে ১৫০ গজ দূরের কাঁটাতারের বেড়ার দু’পাশে মই লাগিয়েমানুষ পারাপার করে। এদের সহযোগিতা করে বাংলাদেশের পাচারকারীরা। রফা না করেসীমান্তরক্ষীদের দৃষ্টি এড়িয়ে পাচার করতে গেলে নজরে আসার সঙ্গে সঙ্গে গুলিকরে বিএসএফ।
ফেলানী এমনই একটি ঘটনার শিকার হয়েছে বলে জানা গেলস্থানীয়দের কাছে। ভারতের দালাল মোশাররফ হোসেন ও বজরত আলীকে ভারতীয় ৩ হাজাররুপি দিয়ে তাদের লাগানো মই দিয়ে কাঁটাতারের বেড়া পার হতে গিয়েই বিএসএফেরগুলিতে মারা যায় ফেলানী।
কুড়িগ্রাম জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গেলো, গত ৬ মাসে অবৈধভাবে ভারতে গিয়ে আটক হয়ে জেলে গেছেন এ জেলার ১৪০ জনের মতোবাসিন্দা। এদের পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য কয়েক দফায় চিঠিও এসেছিলো বলে জানাগেলো।
পরবর্তী সময়ে অনুসন্ধান করে এদের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েজবাব পাঠানো হয় বলে জানালেন পুলিশ সুপার মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘অবৈধভাবে ভারত গিয়ে আটক হওয়া কুড়িগ্রামের ৩৮ জন বর্তমানে ভারতের কারাগারেরয়েছে বলে নিশ্চিত হয়েছি আমরা’।
কুড়িগ্রাম জেলায় ভারত-বাংলাদেশসীমান্তের সাড়ে ৩০০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বাংলাদেশ ও ভারত দু’অংশেই মানবপাচারকারীদের অপতৎপরতা চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরেই।
এই দালালচক্র কাজদেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে দরিদ্র ও নিরীহ নারী-পুরুষকে প্রতি বছরই ভারতে পাচারকরে আসছে। মাঝে মধ্যে দু’একজন চেলাচামুণ্ডা ধরা পড়লেও মূল হোতারা রয়েযাচ্ছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
পাচার হওয়াদের ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কিঘটেছে তার হদিসও মেলে না কখনো। এমনিভাবে প্রায় ২৫ বছর আগে ফেলানীর বাবানুরুল ইসলাম নূরকে নিয়ে তার বাবা-মা ভারতের আসাম রাজ্যের বনগাঁওয়েরভাওয়ালগুড়ি এলাকায় গিয়ে বসতি গড়ে তুলেছিল।
সম্প্রতি সরেজমিনসীমান্ত এলাকা ঘুরে এরকম বিভিন্ন ধরণের তথ্য পাওয়া যায়। রামখানা ইউনিয়নের ১নং সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ডের সদস্য নাজমা খাতুনের স্বামী রফিকুল ইসলামজানান, এখানকার শত শত নিরীহ দরিদ্র নারী-পুরুষ যুগ যুগ ধরে কাজের সন্ধানেভারতে যাচ্ছে।
কিছুদিন থাকার পর আবার ফিরে আসছে। তিনি আরো জানান, বিএসএফের আচরণ সব সময় উগ্র। এজন্য জিরো লাইন সংলগ্ন জমিতে চাষাবাদ করতেগিয়েও ভয় পায় লোকজন। কিছুদিন আগে জাগির বালাটারি বিএসএফ ক্যাম্পের জওয়ানরাবাংলাদেশের নো-ম্যান্স ল্যান্ডে ঢুকে কৃষি জমিতে কর্মরত অবস্থায় জাইদুলনামের এক যুবককে বেদম মারপিট করে চলে যায়।
নাগেশ্বরীর মাস্টারটারিসীমান্তবর্তী গ্রামের আব্দুল জব্বার, কালাম, সিরাজুল ও এনতাজ আলী জানান, তাদের গ্রামের ছামাদ ও জামাল ১০ বছর আগে ভারতে গিয়ে সেখানে অবস্থান করছেন।
আলমগীরগেছেন সাত বছর আগে। তবে এখনও তার হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। আব্দুল জব্বার (৬০) জানান, ১০ বছর আগে তিনিও ভারতে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে ইটভাটায় কাজকরতেন তিনি।
মাত্র ৫০০ টাকা দিয়ে পশ্চিম রামখানা সীমান্ত গ্রামেরদালাল ইদ্রিস আলীর মাধ্যমে ভারতে গিয়েছিলেন বলে জানান তিনি। বছর খানেকথাকার পর দেশে ফেরার সময় ভারতের দালালরা টাকা-পয়সা সব কেড়ে নেয়।
চিলাখানাবহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক রেজাউল করিম ও দক্ষিণ রামখানা গ্রামেরইসমাইল হোসেন জানান, শিংগেরভিটা গ্রামের আব্দুলের পুত্র ময়েন, কলোনিটারিগ্রামের কোবাদ আলী ও আক্কাছ, দক্ষিণ রামখানা গ্রামের জোবেদা, হানু ও আমেনা, বোনিয়াটারির আব্দুল মালেক এখন ভারতে আছেন।
সীমান্তবাসীরা বলেন, এগুলো হচ্ছে প্রকৃত সত্য। এ বাস্তবতা এড়িয়ে যাওয়ার কোন উপায় নেই। সীমান্তেহত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হলে এই সমস্যাগুলোর গভীরে গিয়ে সমাধানের ব্যবস্থাকরতে হবে বলে উল্লেখ করেন তারা।
ফেলানীর বাবা মো: নুরুল ইসলামবাংলানিউজকে বলেন, ফেলানী মারা যাবার পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারাখাতুন ফেলানীর বাড়িতে গিয়েছিলেন।
এ সময় মন্ত্রীর সঙ্গে বর্ডারগার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো: রফিকুল ইসলাম, পুলিশের মহাপরিদর্শক খন্দকার হাসান মাহমুদ ও রংপুর বিভাগীয় কমিশনারজসীমউদ্দিন আহমেদও ছিলেন।
এ সময় তাদের সামনে অবৈধভাবে ভারতে যাওয়ারবিষয়টি উত্থাপিত হয় বলে তিনি জানান । বিজিবি প্রধান সে সময় বলেছিলেন, ‘অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দেওয়া আইনের পরিপন্থি।’
সাহারা খাতুন আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, ‘বৈধভাবে যাওয়া আসা সহজ করার বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
তারকথা তখন ভারতে অবৈধভাবে যাওয়া ব্যক্তিদের পরিবারগুলোকে আশ্বস্ত করেছিলো।তারা এখন এই আশ্বাস দ্রুত বাস্তবায়নের অপেক্ষায় দিন গুনছেন।
নিউজরুম