রুপসীবাংলা, ঢাকা (২২ নভেম্বর) : আব্দুল আলীমের নেতৃত্বে শান্তি কমিটির সদস্যরা তার বাবা জব্বার হোসেনকে নির্যাতন শেষে হত্যা করেন বলে অভিযোগ করেছেন বিউটি খানম। বৃহস্পতিবার মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত সাবেক বিএনপি নেতা আব্দুল আলীমের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে-২ সাক্ষ্য দানকালে এ অভিযোগ করেন তিনি।
বিউটি জানান, সে সময় জয়পুরহাট মহকুমা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ও রাজাকার কমান্ডার আব্দুল আলীম ও তার সহযোগী সদস্যরা পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতা করতেন।সাক্ষ্য দিতে গিয়ে তার বাবাকে নির্যাতন ও হত্যার মর্মস্পর্শী বর্ণনা দেন বিউটি। বাবার কথা বলতে গিয়ে তিনি বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ সময় এজলাসকক্ষের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে।
জয়পুরহাটের পাঁচবিবির বালিঘাটা গ্রামের শহীদ ইপিআর সদস্য জব্বার হোসেনের কন্যা বিউটি আলীমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের অষ্টম সাক্ষী। এর আগে বিউটির স্বামী গোলাম রসুল ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিতে এসে একই ঘটনার একই ধরনের বর্ণনা দিয়েছেন।আলীমের বিরুদ্ধে ৭ম সাক্ষী শহীদ জব্বার হোসেনের জামাতা গোলাম রসুল সোমবার তার সাক্ষ্যেও জানিয়েছিলেন, আলীমের নেতৃত্বে শান্তি কমিটির সদস্যরা তার শ্বশুর জব্বার হোসেনকে নির্যাতন শেষে হত্যা করেন।
সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে আসামি আব্দুল আলীমকে কাঠগড়ায় শনাক্ত করেন বিউটি খানম। পরে আলীমের আইনজীবী আবু ইউসুফ মো. খলিলুর রহমান তাকে জেরা শুরু করেন। জেরার কার্যক্রম আগামী ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুলতবি করেছেন চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।
বর্তমানে ৫৫ বছর বয়সী সাক্ষী বিউটি খানম বর্তমানে পাঁচবিবি এনএম সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে উচ্চমান সহকারী হিসেবে কর্মরত। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি নবম শ্রেণীর ছাত্রী ছিলেন।তখন তার বয়স ছিল ১৪/১৫ বছর। তখন তার বিয়ে হয়। পরে তিনি বিএ ও এমএড করেছেন।
সাক্ষ্যে বিউটি বলেন, ‘‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি আমার গ্রামের বাড়ি বালিঘাটায় বসবাস করতাম। ১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল দুপুরের দিকে ঘোড়াঘাট থেকে পাকিস্তানি সেনারা পাঁচবিবির হাটে এসে অনেক জ্বালাও-পোড়াওসহ বর্বোরোচিত ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। আমি এসব ঘটনা লোক মুখে শুনে অত্যন্ত ভীত-সন্ত্রস্ত হই।’’
তিনি বলেন, ‘‘ঘটনার দিন পাঁচবিবির হাট থেকে লোকজন দৌড়াদৌড়ি করে আসতে থাকেন। আমি তাদের কাছ থেকে জানতে পারি যে, পাকিস্তানি সেনারা পাচঁবিবি হাটে আসছে। সে সময় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ও রাজাকার কমান্ডার আব্দুল আলীম ও তার সহযোগী সদস্যরা পাকিস্তানি সেনাদেরকে সহযোগিতা করতেন।’’
সাক্ষী বলেন, ‘‘ওই দিন গোলাগুলিতে ছাত্তার ও ননী কুণ্ডু নামে দুই ব্যক্তি ছাড়াও অনেকে মারা যান। একই দিনে পাঁচবিবি বাজারেও ধ্বংসযজ্ঞ চালায় শান্তি কমিটি, রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা।
তিনি বলেন, ‘‘আমার বাবা জব্বার হোসেন চট্টগ্রামে ইপিআরের সুবেদার মেজর হিসেবে কাজ করতেন। আমার বাবা জখম হয়ে এসে ধুরুইল গ্রামে আমার স্বামীর বাড়িতে ওঠেন। আমার স্বামীর বাড়ি নিরাপদ নয় ভেবে তিনি পাশের ফিসকা গ্রামের নাজিম উদ্দিনের বাড়িতে আশ্রয় নেন। সে সময় পাঁচবিবি কামরুন্নেসা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প ছিল।পাঁচবিবি সিওতে(ডেভ) আরো একটি ক্যাম্প ছিল।’’
বিউটি খানম বলেন, ‘‘আমার বাবাকে গ্রেফতারের জন্য পাকিস্তানি সেনাদের কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার নেতৃত্বে রাজাকার ও শান্তিবাহিনীর সদস্যরা নাজিম উদ্দিনের বাড়ি ঘেরাও করেন।তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যান। আমি জানার পরে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত হই। এরপর আমার মায়ের সঙ্গে আমার স্বামী গোলাম রসুল দেখা করেন।’’
তিনি বলেন, ‘‘পরে জয়পুরহাট শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ও রাজাকার কমান্ডার আলীমের সঙ্গে মা, আমার ভাই জাহাঙ্গীর ও স্বামী গোলাম রসুল দেখা করে বাবার খোঁজ-খবর জানতে চান। আলীম আমার স্বামীকে বলেন, তোমার শ্বশুর জব্বার হোসেন চট্টগ্রামে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে গোলাগুলিতে অংশ নিয়েছেন। তাকে ছাড়া যাবে না। পরে স্বামীর অনুরোধে আলীম জানান যে, জব্বার হোসেনকে ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চে বসিয়ে রাখা হয়েছে।’’
‘‘এরপর আব্দুল আলিম একটি চিঠি লিখে দেন। আমার স্বামী সেটি রাজাকার রফিক বিহারীর কাছে দেন। রফিক বিহারী বগুড়া জেলখানা ও রাজাকার ক্যাম্পে খোঁজ নিয়ে জানান যে, জব্বার হোসেনকে পাওয়া যাচ্ছে না।’’
সাক্ষী বলেন, ‘‘আমার স্বামী আব্দুল আলীমের কাছ থেকে ফিরে ডাক্তার ফরিদের সঙ্গে দেখা করলে তিনি নিশ্চিত করেন যে, পাঁচবিবি শান্তি কমিটির কাছ থেকে এনে আব্দুল আলীমের নেতৃত্বে শান্তি কমিটির সদস্যরা আমার বাবাকে নির্যাতন শেষে হত্যা করেন।’’
বিউটি খানম বলেন, ‘‘মুক্তিযুদ্ধকালে আব্দুল আলীমের উপস্থিতিতে পাকিস্তানি সেনারা জয়পুরহাটের পাঁচবিবি এলাকায় মানুষ হত্যাসহ বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করেছে।’’
আলীমের বিরুদ্ধে এর আগে রাষ্ট্রপক্ষের আরো ৭ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। তারা হলেন, আব্দুল মোমেন, মোহাম্মদ সাইদুর রহমান, নুরুল ইসলাম, মোল্লা শামসুল আলম, আব্দুস সামাদ মণ্ডল, সোলায়মান আলী ফকির ও গোলাম রসুল। আসামিপক্ষ তাদের জেরাও সম্পন্ন করেছেন।
উল্লেখ্য, গত ১১ জুন ৭ ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের মোট ১৭টি অভিযোগে আলীমকে অভিযুক্ত করেন ট্রাইব্যুনাল-২।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে, আব্দুল আলীম জয়পুরহাটের ডা. আবুল কাশেম হত্যা ও ২৬ জন মুক্তিযোদ্ধার গণহত্যার সঙ্গে জড়িত। এছাড়া জয়পুরহাটের করাইকাদিপুর এলাকার গণহত্যাসহ চকপাড়া, জুড়িপাড়া, পালপাড়া, সোনাপাড়া এলাকায় ৩৮ জনকে হত্যারও অভিযোগ রয়েছে আলীমের বিরুদ্ধে, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের।
গত ১৫ মার্চ আলীমের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করেন প্রসিকিউশন। এতে একাত্তরে হত্যা, লুণ্ঠনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আলীমের বিরুদ্ধে তিন হাজার ৯০৯ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। গত ২৭ মার্চ ট্রাইব্যুনাল-১ আলীমের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ আমলে নেন।
আনুষ্ঠানিক অভিযোগে আব্দুল আলীমের বিরুদ্ধে ২৮টি অভিযোগ আনা হয়েছিল। এর মধ্যে ১৭টি আমলে নিয়ে অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল-২।
পরে গত ১৬ এপ্রিল আলীমের মামলাসহ তিনটি মামলা ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ট্রাইব্যুনাল-২ এ স্থানান্তর করা হয়।
উল্লেখ্য, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গত বছরের ২৭ মার্চ জয়পুরহাটের বাড়ি থেকে আলীমকে গ্রেফতার করা হয়। ৩১ মার্চ তাকে ১ লাখ টাকায় মুচলেকা এবং ছেলে ফয়সাল আলীম ও আইনজীবী তাজুল ইসলামের জিম্মায় জামিন দেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর বেশ কয়েক দফা এই জামিনের মেয়াদ বাড়ানো হয়।সাবেক এই সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীকে দেওয়া জামিনের অন্য শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে- আলীমের পাসপোর্ট জমা থাকবে ট্রাইব্যুনালের নিবন্ধকের কাছে। ছেলে ফয়সাল আলীমের বনানীর বাসায় তাকে থাকতে হবে। ট্রাইব্যুনালের অনুমতি ছাড়া ঠিকানা বা অবস্থান পরিবর্তন করা যাবে না।গণমাধ্যমে কোনো ধরনের বক্তব্যও দিতে পারবেন না আলীম। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের সাক্ষী, একাত্তরে নির্যাতিত কেউ, ক্ষতিগ্রস্ত কোনো পরিবার, কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি বা দলের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে, ফোনে বা ব্যক্তির মাধ্যমে কোনো ধরনের যোগাযোগ করা যাবে না।
নিউজরুম