রুপসীবাংলা, কুড়িগ্রাম (১৯ নভেম্বর): ভোররাতে হঠাৎ করেই চিৎকার শুরু হলেঘর থেকে বের হয়ে কুয়াশা ছাড়া আর কিছু চোখে পড়লো না। কিন্তু সকাল হলে, কুয়াশা আস্তে আস্তে সরে গেলে, সাড়ে সাত অথবা আটটার দিকে দেখি কাঁটাতারেরবেড়ায় ফেলানী ঝুলে আছে। ততোক্ষণে এখানে স্থানীয় মানুষ, বিডিআর, এই পারেরপুলিশ এসে ভয়াবহ অবস্থা।তবে ফেলানী মারা যাবার আগে পানি পানি বলেখুব চিৎকার করছিল, কিন্তু কে তারে ওখানে পানি দিতে যাইবো, যে যাইবো তারেইমাইরা ফেলবো বিএসএফ। আর ফেলানীর বাবার অবস্থাও খুব ভালো ছিল না, কাঁটাতারেরআঘাতে সেও রক্তাক্ত ছিল, কিছু দূর দৌড়ে আসার পর অজ্ঞান হয়ে যায়।
পরে তারেআমরা সুস্থ করে তুলি। ‘ফেলানী ঝুলছে না, ঝুলছে বাংলাদেশ’ সেইফেলানীর রক্তাক্ত মৃতদেহ কাছ থেকে দেখেছেন ৮০ বছরের বৃদ্ধ মো. আকবর আলী।সেদিনের কথা জিজ্ঞেস করলে এভাবেই তিনি এসব কথা বললেন।তিনি আরও বলেন, প্রায় সাড়ে ৪ ঘণ্টা পর সকাল ১১টার দিকে ফেলানীর লাশ নামিয়ে নিয়ে যায় বিএসএফ।
এ প্রতিবেদক যেখানে দাঁড়িয়ে মো. আকবর আলীর সঙ্গে কথা বলেছেন সেখান থেকেফেলানী যেখানে ঝুলে ছিল সেই কাঁটাতারের বেড়ার দূরত্ব মাত্র ১৫০ গজ। তাই খুবকাছ থেকেই দেখা যাচ্ছিল কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে বিএসএফ’ ক্যাম্প।নির্দিষ্ট সময় পরপর একাধিক বিএসএফ জওয়ান আসছিলো সেখানে। সেখান থেকে ফেলানীরবাড়ি গিয়ে কথা হয় ফেলানীর বাবা এবং মায়ের সঙ্গে।
‘আল্লাহ তুমিআমার মেয়েটারে দেখো বলেই দৌড় দেই আমি। তারপর আমি অজ্ঞান হয়ে যাই’- বলেনফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম। মেয়েকে হারানোর কথা বলতে গিয়ে মনের বাঁধ, চোখেরবাঁধ সব ভেঙ্গে যায়। চোখের কোণে দেখা যায় সরু অশ্রুরেখা। বাবার আকুলতাছুঁয়ে যায় সবাইকে। সবাই বাকহারা, সবার চোখেই পানির ধারা।বাবা বলেচলেন, অনেক ছোট বেলায় আসাম গিয়ে সেখানেই থাকতে শুরু করি। বনগাইগঞ্জ গ্রামেদোকান করতাম। কিন্তু সেখানে আর বেশিদিন থাকার ইচ্ছা ছিল না। নিজ দেশেই ফিরেআসার আশায় সেখানে মেয়েটাকে বিয়ে না দিয়ে ওর খালাতো ভাইয়ের সাথে বিয়ে ঠিককরি। ৮ জানুয়ারি ছিল ওর বিয়ের তারিখ।৬ তারিখ সকালে রওনা দিয়েসীমান্তে পৌঁছাই সন্ধ্যায়। দালালের মাধ্যমে সীমান্ত পার হতে হয়। সেদিনসন্ধ্যা থেকেই পার হওয়ার জন্য সুযোগ খুঁজি, কিন্তু পাই নাই। ভোর বেলা দালালআমাদেরকে পার হতে বলে। কাঁটাতারের বেড়ার পিলারের ওপরে উঠি মেয়েকে নিয়ে।আমার এক হাতে মেয়ে আরেক হাতে মেয়ের বিয়ের জিনিসপত্র। হঠাৎ গুলির শব্দ।
‘১৫থেকে ২০ গজ কাছ থেকে আমার ফেলানীকে গুলি করে বিএসএফ’। এবার মেয়ে হারানোবাবা শব্দ করে কেঁদে উঠেন। সেই সঙ্গে ডুকরে কেঁদে ওঠেন সেখানে উপস্থিতফেলানীর মা।বাবা বলে যান, “আমি দেখছি বিএসএফ বসা ছিল। কিন্তুআমাদের সাথে তো দালাল ছিল। দালালরে গুলি না করে আমাদের গুলি করে। তাকিয়েদেখি মেয়েটা আমার পিলারের ওপর দাঁড়ানো গুলিবিদ্ধ অবস্থায়। আর আমি হঠাৎকাঁটাতারের বেড়ার এপাশে চলে যাই। আমি নিজেও তারের আঘাত পাই। শরীরে রক্তঝরে।“
ফেলানীর মায়ের দিকে তাকাতেই তিনি বলেন, ‘মেয়ে আমার খুব সুন্দর ছিল। ভারতে সবাই বলতো, মেয়েকে সেখানে বিয়ে দিতে। কিন্তু সেটা চাই নাই।মেয়েমারা যাওয়ার ৩ দিন পর আমি খবর পাই। এখানে আসি ৪১ দিন পর। ভারতে যেখানেথাকতাম, সেখানে কান্নাকাটিও করতে পারতাম না, আমরা যে বাংলাদেশি সেটাতো বলাযায় না। যদি কাঁদি তাহলে লোকজন জানবে, পুলিশ আমাদের আটক করবে।
আমারবড় মেয়ে ফেলানী। সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে ওর জন্য বিয়ের কেনা কাটা করেছি। ওযখন চলে আসে তখন ওর সাথে ২২ ভরি রূপা, দেড় ভরি স্বর্ণ আর ৮০ হাজার টাকাছিল। কিন্তু এগুলোর কিছুই বিএসএফ পরে ফেরত দেয় নাই।‘
ফেলানীর মাবলেন, ‘মাইয়া মারা যাওয়ার পর সাহারা খাতুন (তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী)এসেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ফেলানীর কবর পাকা করবো, বাড়ির সামনের রাস্তা পাকাকইরা নাম দিবো ফেলানী রাস্তা, ফেলানীর মৃত্যুবার্ষিকী পালন করবো প্রতিবছর, বাচ্চাদের লেখাপড়া, ভরণ-পোষণের ভার নিবো। কিন্তু কিছুই করে নাই।‘ এতোক্ষণেরদুঃখ যেন ক্ষোভে রূপান্তরিত হয় ফেলানীর মায়ের। তিনি বলেন, ‘সাহারা খাতুননিজে এসব বলেছেন, তার বলা যেই কথা, আর রাস্তা হওয়াতো একই কথা। সরকার মানুষহইয়া যে এতো মিথ্যা কথা কয়! যদি মন্ত্রীর সাথে দেখা হইতো, হেরে আমি কিছুকথা কইতাম।‘ বাংলাদেশের নাগরিক হইয়া সরকারের থেকে কোন ক্ষতিপূরণ পাই নাই।
তবেফেলানীর মৃত্যুর পর জেলাপ্রশাসন থেকে বাজারে কিছু জমি আর বিজিবির পক্ষথেকে দোকান ঘর তুলে দেওয়া হয়েছে আর ৩ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে পরিবারকে। সেইটাকা দিয়ে দোকানের মালামাল ও পাওনা দিয়েছেন তারা।দুঃখিনী মাকেযেন কথায় পেয়ে বসেছে। তিনি বলে চলেন, ‘ভারতে বাচ্চা নিয়ে সমস্যা ছিল না, ভোট দিতে পারতাম না সেখানে, আইডি কার্ড পর্যন্ত ছিল না কিন্তু ঐখানে আরামেছিলাম। ঐখানে ব্যবসা করলে ভালো আয় হতো, কিন্তু এখানে আয়ও নাই, সরকারও কোনসাহায্যও করে না। ভারতে বাচ্চাদের কেজি স্কুলে পড়াইছি আর নিজ দেশে সরকারিস্কুলেও পড়াইতে পারি না। তাইলে তো ভিন দেশেই ভালো ছিলাম।‘
‘গত বার, ফেলানীর মৃত্যুদিবসের আগে কতো জনের কাছে গেলাম, ডিসি সাহেবের কাছে গেলাম, বলেন ফান্ড নাই, তারপর খালি ঘুরাইলেন কিন্তু টাকা দিলেন না। কিন্তু আমরা তোমা বাপ, আমরা তো ভুলতে পারি না’, বলেন ফেলানীর বাবা।
ফেলানীরবাড়িতে থাকতে থাকতেই জানা গেল আরেকটি তথ্য। বাংলাদেশে যখন ফেলানীরপোস্টমর্টেম হয় তখন তিন সদস্যের সেই টিমের একজন, ডা অজয় কুমার বলেছিলেন, ‘ফেলানীকে যদি সঙ্গে সঙ্গে কাঁটাতার থেকে নামানো যেত তাহলে তাকে বাঁচানোযেতো।‘যখন চলে আসি তখন কানে কাছে ফেলানীর মায়ের কথা, ‘একটা কবরেরজন্য এখন কতোগুলি মানুষ কষ্ট করছে। কবরটারে একলা রাইখ্যা তো আর যাওন যাইবোনা।‘
নিউজরুম