রুপসীবাংলা কৃষি ডেস্ক : শত শত বছর ধরে মাটির উর্বরা শক্তির ওপর ভর করে এ দেশের কৃষকউৎপাদন করে আসছেন প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য। তবে কয়েক যুগ ধরে উর্বরা শক্তিহারাচ্ছে সোনা ফলানো এ দেশের মাটি।
বর্তমানে দেশের ৬৫ শতাংশ কৃষিজমিরউর্বরা শক্তি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম। চাষযোগ্য প্রায় কোনো জমিতেই নেইপ্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন।
জৈব পদার্থের অভাব রয়েছে, এমন জমির পরিমাণও ছাড়িয়েগেছে ৩৮ শতাংশ। এসব তথ্য জানা গেছে বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণাইনস্টিটিউট (এসআরডিআই) সূত্রে।মাটির উর্বরা শক্তি হারানোর কারণ হিসেবেজমির অপরিকল্পিত বহুমুখী ব্যবহার, চাষাবাদে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ওকীটনাশক প্রয়োগ এবং কৃষকের সচেতনতার অভাবকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।পাশাপাশি জনসংখ্যার বাড়তি চাপ, কৃষি খাতে উন্নত প্রযুক্তি ও উপকরণের অসমব্যবহার, উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বৈশ্বিকজলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ছাড়াও সার্বিকভাবে ভূমি ব্যবস্থাপনায় সমন্বিতপরিকল্পনার অভাবও এতে প্রভাব ফেলছে।
এ বিষয়ে এসআরডিআই পরিচালক ওমৃত্তিকা বিশেষজ্ঞ মো. খোরশেদ আলম বলেন, বাড়তি চাহিদার কারণে কৃষক বেশিউৎপাদনে মনোযোগী হচ্ছেন। কিন্তু জমিকে যে প্রয়োজনীয় পুষ্টি দেয়া প্রয়োজন, তা তারা ভাবছেন না। এ ক্ষেত্রে কৃষক পর্যায়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়া হয় না।তার ওপর মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকর রাসায়নিকের ব্যবহার তো আছেই। ফলে সময় এসেছেজমির উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তার গুণাগুণ ধরে রেখে উর্বরা শক্তিবজায় রাখায়
ব্যবস্থা নেয়ার।
বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, উর্বরাশক্তি ধরে রাখতে জমিতে নাইট্রোজেন ও জৈব উপাদানের পাশাপাশি ফসফরাস, পটাশিয়াম, সালফার, জিংক, বোরন, ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম থাকতে হবেপ্রয়োজনীয় মাত্রায়। কিন্তু দেশের প্রায় ৯৬ লাখ হেক্টর জমিতে প্রয়োজনীয়নাইট্রোজেন নেই। জৈব উপাদানের ঘাটতিতে রয়েছে ৩৬ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর জমি।ফসফরাসের অভাব রয়েছে ৩৭ লাখ হেক্টর ও পটাশিয়ামের ২৭ লাখ ২০ হাজার হেক্টরজমিতে; যা মোট কৃষিজমির ৩৮ দশমিক ৬ ও ২৮ দশমিক ৩ শতাংশ। এ ছাড়া সালফারেরঅভাব রয়েছে ৩৩ লাখ ১০ হাজার ও জিংকের ২৭ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে।
উর্বরাশক্তি কমে যাওয়ার কারণে মাটির ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়ছে, তা নিয়ে কাজ করছেবাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি)। ‘ল্যান্ড সুইট্যাবলিটিঅ্যাসেসমেন্ট অ্যান্ড জোনিং ফর মেজর ক্রপস অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণায়জমিবিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ সাতটি বিষয় উঠে এসেছে। মাটির প্রবেশভেদ্য, গভীরতা, পর্যাপ্ত আর্দ্রতা ধরে রাখার সক্ষমতা, পুষ্টিকর পরিপোষকের প্রাপ্যতা, বিক্রিয়া, উপরিভাগের সামঞ্জস্য ও আচরণ সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে ১২টি ফসলকোন অঞ্চলে উপযোগী হবে, তা নির্ধারণ হয়েছে এ গবেষণায়।
এ বিষয়ে বিএআরসিরনির্বাহী চেয়ারম্যান কৃষিবিদ ড. ওয়ায়েস কবীর বলেন, জমির উর্বরা শক্তি ধরেরাখাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। দেশের যেকোনো এলাকায় অধিকাংশ ফসল ফলানো সম্ভব।কিন্তু বাড়তি খাদ্যচাহিদা মেটাতে ও কৃষিজমি কমে যাওয়ার কারণে একই জমিতেঅধিক ফসল ফলাতে হচ্ছে। এতে মাটির উর্বরা শক্তি কমছে। তাই দেশে শস্য অঞ্চলপদ্ধতি চালু করতে হচ্ছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, উর্বরা শক্তি ছাড়াও জমিরঅন্যান্য গুণাগুণ পরিবর্তনের কারণে উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ জেলার জমি আমন, গম, মুগ ও আলু চাষের উপযোগী হলেও বোরো ধান ও মসুর ডালের জন্য উপযোগী নয়। এছাড়া দক্ষিণের জেলাগুলোর জমি বোরো, আমন, আউশ ধানের উপযোগী হলেও ভুট্টা, গম, মুগ ডালের জন্য কম উপযোগী। অন্যদিকে আখ ও পেঁয়াজ-রসুন উৎপাদনেদক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল এবং রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ ও ময়মনসিংহ বেশি উপযোগী।মরিচ উৎপাদনে ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী এবং বাদামউৎপাদনে উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ জেলা ও মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা সবচেয়েউপযোগী।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলেও এর সত্যতামিলেছে। উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর, নওগাঁ ও রংপুরের কৃষকরা জমির উর্বরা শক্তিরপরিবর্তন নিজেরাও দেখতে পাচ্ছেন। বোরো আবাদে ১০ বছর আগের তুলনায় এখন তাদেরপ্রায় দ্বিগুণ সেচ দিতে হচ্ছে। বাধ্য হয়ে আমন ও আলু চাষে বেশী মনোযোগী হতেহচ্ছে।
এদিকে ভূমি অবক্ষয় ও জমির উর্বরা শক্তি হারানোর কারণে আর্থিকক্ষতির পরিমাপ করেছে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)। ‘বাংলাদেশে টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক গবেষণায় ভূমি অবক্ষয়ে আর্থিকক্ষতি দেখানো হয়েছে বছরে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা।
এ অবস্থায় জমিরউর্বরা শক্তি ধরে রাখতে সমন্বিত পরিকল্পনার পাশাপাশি জৈব সার ব্যবহারবাড়ানো, জমি চাষে রোটেশন ও মিশ্র চাষ পদ্ধতি অনুসরণ এবং কৃষি উপকরণব্যবহারে সচেতনতা বাড়ানোর সুপারিশ করেন বিশেষজ্ঞরা।
বিআইডিএসের সাবেকগবেষণা পরিচালক ড. মো. আসাদুজ্জামান বলেন, জৈব সারের কারখানা স্থাপন এবংমাটির গুণাগুণ পরীক্ষার জন্য দেশব্যাপী ল্যাবরেটরি স্থাপনে এখনই নজর দিতেহবে। এ ছাড়া বিষয়টি নিয়ে সব মন্ত্রণালয়কে একসঙ্গে কাজ করার পরামর্শ দেনতিনি।
কৃষিজমিতে জৈব পদার্থের উপস্থিতি ১ দশমিক ৭ শতাংশ হলে স্বাভাবিক ধরা হয়। কিন্তু উঁচু ভূমিতে এর পরিমাণ গড়ে মাত্র ১ দশমিক ৬৩ শতাংশ।এবিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মনজুর হোসেন বলেন, ভূমির সর্বোত্তমব্যবহারের পর সঠিক মাত্রায় গুণাগুণ রক্ষা করতে সচেষ্ট রয়েছে কৃষিমন্ত্রণালয়। জমি থেকে শুধু বেশি বেশি ফসল ফলানো নয়, জৈব গুণাগুণ রক্ষায়ওপ্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
কৃষককে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সারব্যবহারে সচেতনতা বাড়ানোই এর মূল লক্ষ্য। এ ছাড়া কৃষি সম্প্রসারণকর্মকর্তাদের মাধ্যমে অন্যান্য সহায়তা দেয়ার পরিকল্পনাও সরকারের রয়েছে।
নিউজরুম