রুপসীবাংলা, পটুয়াখালী ১৬অক্টোবর :
আবদুল খালেক মাতুব্বরের পেশা কৃষি। তাঁর বাড়ি পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলার মুরাদিয়া গ্রামে। প্রায় সাত একর জমি চাষ করে উৎপাদিত ফসলে চলে তাঁর সংসার। দীর্ঘ দিন ধরে ওই জমির মধ্যে প্রায় তিন একরে আউশ ধান আবাদ করে আসছেন তিনি। কিন্তু সদ্য চলে যাওয়া আউশ মৌসুমে বৃষ্টির ছোঁয়া না পাওয়ায় একটি ধানবীজও রোপণ করতে পারেননি তিনি। প্রতিবছর তাঁর জমিতে প্রায় ৫০-৬০ মণ ধান উৎপাদন হতো। বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল আউশ আবাদ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে চলে যাওয়া আউশ মৌসুমে বৃষ্টি না হওয়ায় পটুয়াখালী অঞ্চলের আবাদ অনেকটা কমে গেছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। শুধু কৃষক আবদুল খালেক নন, পটুয়াখালীর বেশির ভাগ কৃষক বৃষ্টিপাতের অভাবে এ মৌসুমে পর্যাপ্ত আউশ আবাদ করতে পারেননি। গত বছর ৬৭ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ হলেও এবার ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে আউশ আবাদ হয়েছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়েছে গড়ে মাত্র ১৪০ মিলিমিটার।
নথি অনুযায়ী ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত গড় বৃষ্টিপাত হয়েছে ২০০ মিলিমিটারের নিচে। এদিকে লবণপানির প্রভাবে ক্রমেই আবাদি জমি উর্বরতা শক্তি হারাচ্ছে। পাঁচ থেকে সাত বছর আগেও এর প্রভাব ছিল না। ক্রমেই সমুদ্রপৃষ্ঠে পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়া এবং নদী ও খালগুলো নাব্যতা হারানোর কারণে ধীরে ধীরে লবণপানি ধেয়ে আসছে উপকূলের নদ-নদীতে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এরই মধ্যে এক লাখ ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে লবণের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
ওইসব জমিতে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। এর মধ্যে ৩৯ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদের ফলাফল হবে হতাশাজনক এবং প্রায় ৬০ হাজার হেক্টর জমি চাষের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। পরিকল্পনা গ্রহণ করে নদী খনন করা না হলে কয়েক বছরের ব্যবধানে খাদ্য উৎপাদনে অক্ষম হবে কয়েক লাখ হেক্টর জমি। ফলে উৎপাদন বহুলাংশে কমে যাওয়াসহ দেখা দেবে খাদ্য ঘাটতি।
জেলা মৃত্তিকা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. ইখতিয়ার উদ্দিন জানান, বৃষ্টিপাত কম হওয়া, উজানে পানি কমে যাওয়া, নদ-নদীর নাব্যতা হারানো এবং পানির উৎস বাধাগ্রস্ত (বিশেষ করে ফারাক্কা বাঁধ) হওয়ায় মিঠাপানি কমে গিয়ে লবণপানি ক্রমেই উত্তরে ধেয়ে আসছে। ফলে যতই ইরি কিংবা বোরো আবাদে পরিকল্পনা কিংবা প্রকল্প নেওয়া হোক না কেন, লবণপানির দাপট অব্যাহত থাকলে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে না। এ ছাড়া টিপাইমুখ বাঁধ হলে লবণপানির প্রভাব দ্রুত বাড়বে এবং অল্প সময় ব্যবধানে তা চলে যাবে ভৈরব পর্যন্ত। গত বছরের সমীক্ষা অনুযায়ী লবণপানি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তেঁতুলিয়া নদীর দশমিনা উপজেলার আমখোলা, পায়রা নদীর পায়রাকুঞ্জ, বিশখালী নদীর বেতাগী এবং বলেশ্বর নদের পানি চরখালী পর্যন্ত পৌঁছেছে। সাত-আট বছর ধরে লবণপানি ক্রমেই উত্তরে চলে আসছে।
অন্যদিকে অব্যবস্থাপনার জন্য শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে সম্ভাবনাময় আলু চাষ। ৯০ দশক থেকে এ জেলায় শুরু হওয়া আলু চাষ প্রায় তিন হাজার হেক্টরে পৌঁছলেও গত মৌসুমে তা নেমে আসে মাত্র ২৪০ হেক্টর জমিতে। তবে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর দাবি করে, ওই মৌসুমে এক হাজার ১৪০ হেক্টর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত ছিল তাদের। চাষ কমে যাওয়া সম্পর্কে কৃষকরা জানান, দাম না পাওয়া এবং সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণের উপপরিচালক এ জেড এম মমতাজুল করিম বলেন, জলবায়ু পরির্বতনের ফলে কৃষিতে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সরকারি বা স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে নদী ও খাল খনন করে মিঠাপানি ধরে রাখা জরুরি। এখনই পদক্ষেপ না নিলে দুই-এক দশকের মধ্যে শুধু লবণাক্ততার কারণে আবাদি জমি কার্যক্ষমতা হারিয়ে খাদ্য উৎপাদনে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অনুষদের কোর্স সমন্বয়কারী অধ্যাপক আ ক ম মস্তফা জামান বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সমুদ্রে লবণপানি তেড়ে আসা এবং পানির উৎস ভারত ও চীন কর্তৃক বাধাগ্রস্তসহ নানা বিপর্যয়ের ফলে আশঙ্কা করা হচ্ছে পাঁচ থেকে সাত বছরের মধ্যে ৩০ শতাংশ খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে।
এখনই এ ব্যাপারে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে পদক্ষেপ নিয়ে বাস্তবায়ন করা না হলে আমাদের চরম দুর্ভোগে পড়তে হবে।’
নিউজ প্রতিবেদক