রোগীর ভিড়ে হিমশিম খাচ্ছেন খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তাররা

0
322
Print Friendly, PDF & Email

রুপসীবাংলা, খুলনা ১৬ অক্টোবর :
চল্লিশোর্ধ্ব কবির হোসেন ঘাড়ে ব্যথার চিকিৎসার জন্য মোরেলগঞ্জের নিশানবাড়িয়া গ্রাম থেকে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এসেছেন। দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে তিনি ১০ টাকা দিয়ে একটি টিকিট সংগ্রহ করেন। যান দোতলার চিকিৎসকের কক্ষে। মিনিটখানেক পরই সাতটি ওষুধের নাম লেখা একটি কাগজ হাতে নিয়ে বাইরে আসেন। বাইরে দাঁড়ানো এক নারীকে তিনি হাসপাতালের কর্মী ভেবে কাগজ দেখিয়ে বলেন, ‘ডাক্তার সাহেবকে আমি একটু গায়ে হাত দিয়ে দেখার কথা বললেও তিনি শুনলেন না। কাগজখানি ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ওষুধগুলো খান, ভালো হয়ে যাবেন।
ঘটনাস্থল খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগের সামনের করিডর। রোগী তাঁর ক্ষোভের কথা যে নারীকে বললেন, জানা গেল তিনি হাসপাতালের বহির্বিভাগের একজন কর্মী। তবে তাঁর পদটি স্থায়ী নয়। এখানে কাজ করেন অনেক দিন ধরে। মূলত রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে পাওয়া বকশিশই তাঁর আয়। প্রতিদিন চিকিৎসাপ্রার্থীর উপচেপড়া ভিড়, চিকিৎসক ও সহযোগীদের দায়সারা ভাব, বেসরকারি ক্লিনিক ও প্যাথলজিক্যাল প্রতিষ্ঠানের দালালদের সীমাহীন উৎপাত আর নানা অনিয়মের মধ্য দিয়ে চলছে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।
চিকিৎসকরা রোগীদের ঠিকমতো দেখেন না এ অভিযোগ মানতে নারাজ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. পরিতোষ কুমার কুণ্ডু। তিনি বলেন, প্রকৃতপক্ষে অল্প সময়ে অনেক রোগী দেখতে হয়। এ কারণে রোগীকে সন্তুষ্ট করা যায় না। হাসপাতালটি শুরু হয়েছিল ১২৫ শয্যা নিয়ে। পরে ২৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এখন এটি ৫০০ শয্যার হাসপাতাল। কিন্তু জনবল কাঠামো সেই ২৫০ শয্যার। এখনো ৫০০ শয্যার জনবল পাওয়া যায়নি। কিন্তু হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৭৫০-এর মতো রোগী থাকে। আর বহির্বিভাগে প্রতিদিন গড়ে এক হাজারেরও বেশি রোগী হয়। চিকিৎসক সংকটে রোগীদের দুর্ভোগ কথা স্বীকার করেন তিনি।
দালালদের দৌরাত্ম্য : রবিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে হাসপাতালের বহির্বিভাগে ঢোকার সময় মাইকে ঘোষণা শোনা গেল, ‘দালাল-প্রতারকদের থেকে সাবধান। কেউ দালালদের কথা শুনবেন না। ১০ টাকা দিয়ে টিকিট কাটুন এবং নির্দিষ্ট ডাক্তারকে দেখান।’ অনুসন্ধান ডেস্কে বসা ব্যক্তিটি এ ধরনের ঘোষণা মাঝেমধ্যেই দিয়ে যাচ্ছেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালের সামনে গড়ে ওঠা বেসরকারি ক্লিনিকগুলোর দালালরা এখানে আসা রোগীদের ভুল বুঝিয়ে নিয়ে যায়। তারা কম ভিজিটে ভালো ডাক্তার দেখাবে বলে নিয়ে গিয়ে ওই সব ডাক্তারকে দিয়ে একাধিক টেস্ট লেখায়। আর সেসব টেস্ট থেকে তারা টাকা আয় করে। এতে রোগীর উপকার কিছু হয় না, তবে হাসপাতালের বদনাম হয়। একারণে আমরা রোগীদের সতর্ক করতে এব্যবস্থা নিয়েছি।
‘ এত সতর্কতার মধ্যেও একাধিক রোগীকে নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করতে দেখা গেল। ঘটনাটি জানতে চাওয়ায় আরিফ নামের একজন বলে, ‘উনি কোথায় ভালো টেস্ট করতে পারবেন সেই পরামর্শ দিচ্ছিলাম।’ আরিফ একটি নির্দিষ্ট প্যাথলজিক্যাল প্রতিষ্ঠানের লোক। তাদের লক্ষ্য গ্রামাঞ্চল থেকে আসা সাধারণ রোগী। শরিফুল ইসলাম নামের একজন চিকিৎসাপ্রার্থী বলেন, হাসপাতালের এক শ্রেণীর কর্মচারী-কর্মকর্তা-চিকিৎসকের সঙ্গে বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোর যোগাযোগ রয়েছে। ফলে যারা সরকারি হাসপাতালে আসে তাদের বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে বাধ্য করা হয়।
হাসপাতালের বহির্বিভাগের বাইরে দক্ষিণ পাশের খোলা জায়গায় দেখা গেল ওষুধ কম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিদের ভিড়। যেসব রোগী প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে হাসপাতালের বারান্দা ছেড়ে নিচে নামছে, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ওই সব রোগীর কাছ থেকে চেয়ে, কখনো কখনো কেউ কেউ ছিনিয়ে নিচ্ছেন প্রেসক্রিপশন। কোন চিকিৎসক কী ওষুধ লিখছেন, তা যেমন টুকে নেওয়া হচ্ছে, তেমনি কেউ কেউ আবার ছবিও তুলে নিচ্ছেন।
এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে একজন সিনিয়র চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘দেশে ৮০টিরও বেশি ওষুধ কারখানা। ওই কারখানাগুলো আমরা চিকিৎসকরাই টিকিয়ে রেখেছি। এ কারণে বিক্রয় প্রতিনিধিরা আমাদের ওপর নজর রাখেন আমরা ঠিকমতো তাঁদের কম্পানির ওষুধ লিখছি, নাকি তাঁদের কাছ থেকে শুধু সুবিধা নিয়ে চলেছি।’
জনবলের অভাব : হাসপাতালটি ২৫০ শয্যা থেকে করা হয় ৫০০ শয্যা। তবে জনবল কাঠামো সেই ২৫০ শয্যা হাসপাতালের। সব পদে লোক নেই। সিনিয়র কনসালট্যান্টের আটটি পদের মধ্যে তিনটি পদ (চক্ষু, শিশু ও মেডিসিন) শূন্য রয়েছে। রেজিস্ট্রারের সাতটি পদের মধ্যে একটি পদ, সহকারী রেজিস্ট্রারের ১৬টি পদের মধ্যে দুটি পদ শূন্য রয়েছে। নিরাপত্তা প্রহরীর ৯টি পদের ছয়টিই শূন্য। হাসপাতালটির বর্তমান ৫০০ শয্যার বিপরীতে একনেক (জাতীয় অর্থনেতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি) ৮১৬টি পদের অনুমোদন দিয়েছে। তবে এখনো জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে হাসপাতালের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রায় দুই বছর ধরে চিঠি চালাচালি চলছে। এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক পরিতোষ কুমার কুণ্ডু বলেন, ‘তারা একের পর এক নানা বিষয়ের ব্যাখ্যা চেয়ে চলেছে, আমরা জবাব দিয়ে চলেছি। এ প্রক্রিয়ার শেষ হচ্ছে না। অথচ এখানে কার্ডিওলজি বিভাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে রেজিস্ট্রার, সহকারী রেজিস্ট্রার পদে লোক নেই। ক্যান্সার ও মানসিক রোগ বিষয়ে প্রফেসর আছেন কিন্তু ইউনিট নেই। চিকিৎসাপ্রার্থীরা তো এসব অসুবিধার কথা মানতে চায় না, শুনতেও চায় না। এ কারণে আমরা সব সময় অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে পড়ার আতঙ্কে থাকি।’

নিউজ প্রতিবেদক

শেয়ার করুন